হে পাঠক, ঠাকুরদালান কলাম আপাতত ঢাকা পড়বে হৈমন্তী কুয়াশায়। বিসর্জনের বাদ্যি বলে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ! তাকে তো বিসর্জন যেতেই হবে। তবে, ঠাকুরদালানের বিসর্জন হয় না। আবার ফিরে আসার চিরন্তন আশা হয়ে তা সদা জাগর। না, ঠাকুরদালান শুধু আচার-নিষ্ঠার নামাবলি নয়। আবার সেসবকে তুচ্ছ করাতেও তার সায় নেই। আসলে আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে যে বহুস্বর আছে, সেই সব নিয়েই ঠাকুরদালান ভাস্বর। আমি চাই, এ কলাম ফুরোলেও সকলের অন্তরে জেগে থাক এক অলৌকিক ঠাকুরদালান।
ফিরে এলাম বিরতির পর।
বিরতি বেশ দীর্ঘই। প্রায় হপ্তা তিনেক। ‘ঠাকুরদালান’-এর পাঠকরা হয়তো একটু অবাক হবেন। ধারাবাহিক কলাম-এর এমন টেলিভিশন-সুলভ বিরতি নেওয়ার অভ্যাস তো তেমন চেনা অভিজ্ঞতা নয়। সচরাচর তা হয়ও না। তা কেন যে এমনটা হল, সেটাই আজ খুলে বলব। তার আগে, হে পাঠক, আপনাকে জানাই বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
ভাবছেন তো, বড্ড দেরি হয়ে গেল! না হয়ে যে উপায়ও নেই। গত মাসের ১ তারিখে জানিয়েছিলাম, পুজোর ছুটি আর কী! পুজো মানে তো শুধুই ছোটাছুটি। তা সেই ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল জোরকদমে। আক্ষরিক অর্থে পুজো পাঁচদিনের। প্রস্তুতি যে তার বহু আগে থেকে, তা-ও সকলেই জানেন। তবে একেবারে লাস্ট মিনিটের যে রিভিশন, তাই-ই চলতে থাকে দিন দশেক আগে থেকে। অতএব ঠাকুরদালান যখন সত্যিই রমরম করছে, তখন অক্ষরের ঠাকুরদালানে যে বিরতি নামবে, তাই-ই কি স্বাভাবিক নয়!
এদিকে চলছে বিশ্ব-ক্রিকেটে কাপপুজো। অন্যদিকে আমার প্রাণের দুর্গাপুজো। সংবাদমাধ্যমে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জানেন পুজোর দিন সবার আগে ঘড়িকে ট্যাঁকে তুলে রাখতে হয়। কেননা এই সময়টায়, রাত-ই প্রকৃতপক্ষে দিন। আর দিন তো দিনের হিসাবে চলছেই। আমার কাছে আবার দুয়ের হিসাবই জরুরি। সেই হিসেব কষতে গিয়েই দেখি, পঞ্চমী যে কী করে পেরিয়ে গেল ঠাহরই করতে পারিনি। বাড়ির ঠাকুরদালান ততক্ষণে সেজে উঠেছে শারদ-সাজে। পুরোহিতরা তৈরি তাঁদের মতো করে। দেখতে দেখতে ষষ্ঠীর বাজনা বেজে উঠল। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ঠাকুরদালানের আনাচে-কানাচে, কোনায়-কোনায়। ফুলের সাজ থেকে নৈবেদ্য, চাঁদোয়া টাঙানো থেকে প্রদীপে তেল আছে কি না খেয়াল রাখা– এই করতে করতে কখন যে দিন গড়িয়ে রাত নামল, খেয়ালই করতে পারিনি।
এদিকে অফিস থেকে নানা কারণে ফোন আসছে। ফাঁকে ফাঁকে সেইসব কথাবার্তা চলছে। গভীর রাতেও যখন ফোনে কথা হচ্ছে, বুঝলাম আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই কলাবউ স্নান। অর্থাৎ সপ্তমীর পুজো শুরু। দু’-চোখের পাতা আর এক হল না। ফোন ধরা আর ফোন রাখা– এই করতে করতেই সপ্তমীর সকাল চোখ মেলে তাকাল। আর কলাবউয়ের গায়ে গঙ্গাজল পড়া মানেই পুজোর শাস্ত্রবিহিত সব নিয়ম ঘড়ি ধরে শুরু। আমিও এগিয়ে চললাম সেই নিয়মে কাঁটায় কাঁটায়।
এই ক’দিনে বহু মানুষ এলেন ঠাকুরদালানের সামনে। তাঁদের সঙ্গে খানিক খানিক কথা বলা; অফিসের সহকর্মীরা কেউ কেউ এসে দেখা করে গিয়েছেন; অতএব একচিলতে আড্ডা; এরই মধ্যে ঠাকুরমশাই ডাক দিচ্ছেন। আরতি সাজানো হচ্ছে। সন্ধিপুজোর প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। পদ্মকুঁড়ি ফুটিয়ে রাখা হচ্ছে। অষ্টমীটা এবার একটু অন্য কারণে স্পেশাল। পুজোর কারণে বাইরে বেরিয়ে আড্ডা বা খাওয়া-দাওয়া তো হয়ই না। অতএব এবার বাড়িতেই বসেছিল ফুচকা, আইসক্রিমের আসর। আমার মা নিজে উদ্যোগ নিয়ে বসিয়েছিলেন সেই আনন্দমেলা। পুজো উপলক্ষে আমরা ভাইবোনরা সব এক বাড়িতে, এই অবকাশে মেতে উঠলাম সেই আনন্দে। এই ভাবেই চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই পেরিয়ে গেল নবমী আর শেষমেশ দশমীর বাদ্যি।
এই পর্যন্ত যাঁরা পড়লেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছে, এ তো ভীষণ ব্যক্তিগত রোজনামচা। সত্যি বলতে, গত একমাসের দিনলিপি জুড়েই ছিল পুজো, আর তা একান্ত ব্যক্তিগতই। পুজোর আয়োজন, তার বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের দিক তো আছেই। তবে, এই কলামের একেবারে গোড়া থেকেই আমি যা বলছিলাম, ঠাকুরদালান আমার কাছে নিজের শিকড় ও সংস্কৃতির উদযাপন। ঠাকুরদালান এক অর্থে আমার নিজের কাছে নিজে ফিরে আসারই এক অবকাশ। অতএব পুজো চলাকালীন এই সময়টা আমার ভিতর বসত করে দুইজনা। একজন বাইরের সব অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়ে যায়। অন্যজন, অন্তরে অন্তরে উপলব্ধি করি এই ভারতধর্মকে। ভারতের এই আবহমান সংস্কৃতিকে। যে দেবীমাহাত্ম্যের সামনে আমি নতজানু, তা তো অশুভ বিনাশের কথাই বলে। অন্তরের কলুষনাশের হেতু যে উজ্জ্বল প্রতিমার সামনে আমি আমার আর্তি নিবেদন করি– তাঁকে এমন নিবিড় করে পাওয়ার দিন আর কোথায়! বিসর্জন অন্তে মণ্ডপে জেগে থাকে একা জাগপ্রদীপ। আমি বলি, সেই আলোটুকুই আমাদের সম্বল, কেননা তাই-ই আমাদের সুচেতনা।
হে পাঠক, ঠাকুরদালান কলাম আপাতত ঢাকা পড়বে হৈমন্তী কুয়াশায়। বিসর্জনের বাদ্যি বলে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ! তাকে তো বিসর্জন যেতেই হবে। তবে, ঠাকুরদালানের বিসর্জন হয় না। আবার ফিরে আসার চিরন্তন আশা হয়ে তা সদা জাগর। না, ঠাকুরদালান শুধু আচার-নিষ্ঠার নামাবলি নয়। আবার সেসবকে তুচ্ছ করাতেও তার সায় নেই। আসলে আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে যে বহুস্বর আছে, সেই সব নিয়েই ঠাকুরদালান ভাস্বর। আমি চাই, এ কলাম ফুরোলেও সকলের অন্তরে জেগে থাক এক অলৌকিক ঠাকুরদালান। যেখানে গিয়ে দু’-দণ্ড বসা যায়। নিজেকে ফিরে পাওয়ার মন্ত্র যেখানে থাকে। আত্মদর্শনের থেকে বড় পুজো আর কিছু হয় না। ঠাকুরদালান তারই প্রতীক হয়েই অপেক্ষা করুক আগামীর। ব্যক্তিগত এই ঠাকুরদালান, একদিন হয়ে উঠুক সর্বজনীন।