ময়দানে একটি ফুটবল ক্লাবের র্যাম্পারটের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি, একা। একটু এগিয়েই শুনতে পাই ঝোপের মধ্যে থেকে নারীকণ্ঠে খিলখিল হাসি আর পুরুষের শীৎকার। আরেকজন পুরুষ, আমার থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে, দ্বাররক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝোপটার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে। হাতে মদের বোতল। যেন ঘাসে পড়ে থাকা দু’জোড়া চটি পাহারা দিচ্ছে, যেমন দেখা যায় কোন উপাসনাস্থলের প্রধান ফটকের বাইরে। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটি গাছের আড়ালে দাঁড়াই। চোখ থাকে ঘটনাস্থলের দিকে। মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই ঝোপ থেকে একটি পুরুষ বেরিয়ে আসে, মুখে তৃপ্তির হাসি।
বেশ্যা কী? বেশ্যা কে? এই অনুসন্ধান চলে ছেলেবেলা থেকে। বেশ্যা কেন– এই প্রশ্ন মাথায় আসে অনেক পরে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে। সেই দিন, শীত তখনও জাঁকিয়ে পড়েনি, ঠিক সন্ধে নামার আগে ময়দানে কৌস্তুভের কাঁধকে স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে লো লাইট ফোটোগ্রাফি রপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ফোকাসে রেখেছি ভিক্টোরিয়া, তখন আবছায়ায়। একটা শট নিয়েছি। ওয়াইন্ড করে আরেকটা নিতে যাব, খস করে শব্দ হল পিছনে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সাদার ফুল-পাতা ছাপ ময়লা নাইটি। আমরা ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি ক্যামেরা গোটাই। স্রেফ ভয় পেয়ে হাঁটা দিই উল্টোদিকে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি উনি ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন, ভিক্টোরিয়ার দিকে চেয়ে। পাশে রেড রোড তার স্বাভাবিক ব্যস্ততায়। ধরে নিয়েছিলাম উনি বেশ্যা এবং পুলকিত হয়েছিলাম, কারণ এর কিছুদিন আগেই এই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল। সুযোগ? ওই বয়সে তাই মনে হয়েছিল।
ময়দানে একটি ফুটবল ক্লাবের র্যাম্পারটের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি, একা। একটু এগিয়েই শুনতে পাই ঝোপের মধ্যে থেকে নারীকণ্ঠে খিল খিল হাসি আর পুরুষের শীৎকার। আরেকজন পুরুষ, আমার থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে, দ্বাররক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝোপটার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে। হাতে মদের বোতল। যেন ঘাসে পড়ে থাকা দু’জোড়া চটি পাহারা দিচ্ছে, যেমন দেখা যায় কোন উপাসনাস্থলের প্রধান ফটকের বাইরে। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটি গাছের আড়ালে দাঁড়াই। চোখ থাকে ঘটনাস্থলের দিকে। মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই ঝোপ থেকে একটি পুরুষ বেরিয়ে আসে, মুখে তৃপ্তির হাসি। সে হাত বাড়িয়ে বোতলটা অন্যজনের হাত থেকে নেয়, দু’-ঢোক গলায় ঢালে। তারপর অন্য পুরুষটি ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলে সে দ্বাররক্ষী হয়ে যায়। আমি উসখুস করি, কারণ নারীকে দেখা যায় না। ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খালি গা, হাফ প্যান্ট, হাতে ছড়ি, কয়েকটা বাচ্চা। তাদের লিকপিকে চেহারা, নাক থেকে গড়াচ্ছে শিকনি। তারাও হাঁ করে ওই লীলাক্ষেত্রর দিকে তাকিয়ে। এক পাল ছাগল, গলায় ঘণ্টি বাঁধা, এগিয়ে এল আমার দিকে, আমি বিরক্ত হই।
তাই অন্য একটি সন্ধে। বউবাজার থেকে শর্টকাটে আমহার্স্ট স্ট্রিট পৌঁছনোর জন্য ঢুকে পড়েছি হাড়কাটায়। মন্দিরের পাশের রাস্তা। ততদিনে চিনেছি ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, সোনাগাছির ঢিল ছোড়া দূরত্বে এক দোকানে খেয়েছি স্বর্গীয় দই-ফুচকা! হাড়কাটা আমার চোখের সামনে হুতোম প্যাঁচার নকশা এঁকে দিয়েছিল রাস্তা জুড়ে। পানের দোকান, বেলফুল, মাতাল। এবং নারী। কেউ কেউ সায়া আর ব্লাউজ পরে ফুটপাথে, ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে আবেদন ছড়াচ্ছেন। কেউ বারান্দায় শাড়ি-গয়না, আবার ছাদেও দেখেছি অনেককে, পাঁচিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছেন নৈবেদ্য। পাশ দিয়ে রিকশা চলে গেল, তাতে কোনও এক বাবু। নয়ের দশকের গোড়ার কথা, তাই জুরিগাড়ি নেই। এখানে রইস, ছোটলোক সব সমান। আমার হাত ধরে কেউ টানেনি, তবু বড় রাস্তায় পৌঁছে লম্বা শ্বাস ছেড়েছিলাম।
‘বেশ্যাবৃত্তি’ কথাটায় ‘বৃত্তি’ শব্দের গুরুত্ব বুঝি এক বিকেলে, গ্র্যান্ড হোটেলের মেইন গেট থেকে একটু এগিয়েই। আমি আর এক বন্ধু দুরন্ত বেগে হেঁটে চলেছিলাম লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকে। বন্ধুটির বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। হঠাৎ পাশ থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলায়– ‘খোকাবাবু একটু শুনবেন?’ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে, ‘ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন।’ খাটো ধুতি, ফতুয়া, গলায় মাদুলি, পান চিবনো ব্যক্তিকে আমরা রক্তচক্ষু দেখাই, ‘দালাল’ বলে গালাগাল দিই। গজগজ করতে থাকি, আমরা কি বেশ্যা না কি? বন্ধু বলে, ৪০০ পাওয়া যেত কিন্তু! বড় হয়ে কর্মসূত্রে যখন আমস্টারডাম গেছি, বেশ্যার সংজ্ঞা বদলে গেছে নিজের কাছে। রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টের যে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করেছি নিয়মিত, সেখানে বেশিরভাগ টেবিলেই ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে যৌনকর্মীদের ভিড়। তাঁদের কাজের এত তাড়া যে, অন্তর্বাস পরেই খেতে চলে এসেছেন। সেই অন্তর্বাস যে আসলে ফ্লুরোসেন্ট, তা বুঝেছিলাম রাতে। অনেক দূর থেকে দেখা যায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির জানলায় তারা ঝিকমিক করছে। কাছে না যাওয়া অবধি মানুষগুলো অন্ধকারেই।
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?