গুয়াতেমালায় তখন ঢেউয়ের মতো গণতন্ত্র আর স্বৈরশাসন আসছে আর যাচ্ছে। গণতন্ত্রের পতন হলেই ওতো রেনি কাস্তিইয়োকে গ্রেফতার হতে, বা দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হচ্ছে। তিনি ক্রমশ বুঝতে পারছেন, গণতান্ত্রিক পরিসর বলতে এতদিন যা বুঝে এসেছেন— তা আসলে পদ্মপাতায় জল। মূল শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বরকে দমন করছে তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে মোটেই নয়, অস্ত্র আর টাকার জোরে। সুতরাং কবিতা দিয়ে, শুধুই কবিতা দিয়ে এই গণশত্রুর মোকাবেলা অবাস্তব। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তৈরি হচ্ছিলেন তিনি।
৩.
কাস্তিইয়ো কিন্তু ভালোই থাকতে পারতেন। ১৯৫৯-এ পূর্ব জার্মানিতে তখন মধ্য আমেরিকার উদীয়মান কবি হিসাবে যথেষ্ট পরিচিত তিনি, তাঁর মুকুটে ইতোমধ্যেই ইজ্জতদার সব শিরোপার পালক। আর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সান্নিধ্য। তাড়া খেয়ে দেশান্তরিত হওয়া নেই, নিরাপদ জীবন, আলোক-যাপন। কিন্তু তাঁর দেশ গুয়াতেমালা, ক্ষতবিক্ষত গুয়াতেমালা তাঁকে ডাকছিল। সকলে সেই ডাক শুনতে চান না। সকলে সেই ডাক শুনতে পান না। কাস্তিইয়ো চেয়েছিলেন, এবং শুনেছিলেন। আশ্চর্য কী, সময় তাঁকে দিয়েই লিখিয়ে নেবে এমন পঙক্তিমালা:
‘চলো দেশ! আমি সঙ্গে হাঁটব, চলো।
তোমার পানপাত্রের তিক্ততা শুষে নিয়ে
তোমার গভীরে ডুব দেব, চলো।
আমি অন্ধ হয়ে যাব, যাতে তুমি দেখতে পাও,
আমি কণ্ঠরুদ্ধ হব, যাতে তুমি গাইতে পাও,
আমি মরে যাব, যাতে তুমি বাঁচতে পার,
যাতে তোমার তপ্ত মুখখানি
আমার মরা হাড়ে ফুল হয়ে ফোটে। চলো!’
এই পথই পথ, সংশয়বিহীন।
ওতো রেনি কাস্তিইয়োর কিশোরকাল জুড়ে ছিল গুয়াতেমালার সেই ‘বসন্তের দশক’ (১৯৪৪-১৯৫৪)– যখন স্বৈরতন্ত্রী জর্জ উবিকোকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত হুয়ান আরবেনজ গুজমানের সরকার ছিল দেশে। আরবেনজ দেশে একটা কৃষিসংস্কারের, এবং শ্রমিকদের পক্ষে যায় এরকম শ্রম আইন প্রণয়নের, চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাতে ঘা লেগেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঁতে, কারণ মার্কিনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উফকো (ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি)– যারা গুয়াতেমালার অর্থনীতি বলতে গেলে মুঠোয় রেখেছিল– তারা দারুণভাবে মার খাচ্ছিল এর ফলে। আর কমিউনিজম-এর লাল জুজু তো ছিলই! অতএব উফকো-র মদতে এবং ‘হার্ডলাইনার’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সিআইএ কারলোস আরমাস নামে এক মিলিটারি অফিসারের নেতৃত্বে শ-পাঁচেকের একটা দলকে ট্রেনিং, বিপুল অর্থ আর অস্ত্র জুগিয়ে গুয়াতেমালায় ঢুকিয়ে দেয় ও ক্যু করিয়ে ক্ষমতা হাতে নিয়ে নেয়। ওদেশে অন্ধকার ফিরে আসে আবার। কাস্তিইয়ো স্কুলজীবন থেকেই বাম-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ১৯৫৫-তেই তাঁকে দেশ ছেড়ে এল সালভাদোরে পাড়ি দিতে হয়। কষ্ট করে, খুব কষ্ট করে রুটি রোজগার করতে হয়েছে তাঁকে ওদেশে, কখনও মজুর হয়ে, কখনও কেরানিগিরি বা দোরে দোরে জিনিস ফেরি করে। এর মধ্যেই সান সালভাদোর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়া, বাম ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধ মেলানো, কবি হিসাবে পরিচিতি পাওয়া, রোক দালতনের মতো কবিদের সঙ্গে ‘দায়বদ্ধ প্রজন্ম’ নামের লেখকদের মঞ্চ গড়ে তোলা, এল সালভাদোরের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া… এবং অবিশ্রান্ত লিখে চলা। আর তারপর ১৯৫৫-তে খুবই ‘সেন্ট্রাল আমেরিকান পোয়েট্রি প্রাইজ ’ অর্জন করা। মধ্য আমেরিকার পাঠকদের পরিচিত করে তুলেছিলেন সিজার ভ্যালেজো, পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমাত বা মিগুয়েল হার্নানদেজের মতো কবিদের সঙ্গে। ১৯৫৭-য় বুদাপেস্টে গেলেন বিশ্ব যুব উৎসবে যোগ দিতে, ফিরলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর পোয়েট্রি’ নিয়ে। ওই ১৯৫৭-তেই ফিরতে পারলেন তাঁর স্বভূমি– গুয়াতেমালায়। ভর্তি হলেন সান কার্লোস ইউনিভার্সিটিতে আইন ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে। মেধাবি ছাত্র ছিলেন, জাতীয় স্কলারশিপ পেলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার দরজা খুলে গেল তাঁর সামনে। এরপর ১৯৫৯-এ, আবার দেশ ছাড়তে হল যখন, গেলেন পূর্ব জার্মানিতে, ভর্তি হলেন লিইপজিগ ইউনিভার্সিটিতে এবং সাহিত্যে মাস্টার্স শেষ করলেন। সেখানে বামপন্থী কবি-লেখকদের সঙ্গে– বিশেষ করে যাঁরা গুয়াতেমালা ছেড়ে এসেছেন– তাঁর নিয়ত ওঠাবসা ছিল, তথ্যচিত্রকার জোরিস ইভানসের সঙ্গে কাজ করতে করতে শিখছিলেন পরিচালনার খুঁটিনাটি। পূর্ব জার্মানিতে থাকতেই বিয়ে করা, তিন সন্তানের জনক হওয়া। নিরাপত্তা, স্থিতি, খ্যাতি। লেখালিখির অঢেল সুযোগ। ‘প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী’-র তকমা নিয়ে দিব্যি বাঁচতে পারতেন আরও কিছুদিন। কিন্তু ওই যে! স্বদেশ তাঁকে ডাকল। তাঁর স্বপ্নের মুক্ত, শোষণহীন গুয়াতেমালা!
গুয়াতেমালায় তখন ঢেউয়ের মতো গণতন্ত্র আর স্বৈরশাসন আসছে আর যাচ্ছে। গণতন্ত্রের পতন হলেই কাস্তিইয়োকে গ্রেফতার হতে, বা দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হচ্ছে। এই-ই চলল ’৬৫ অবধি। তিনি ক্রমশ বুঝতে পারছেন, গণতান্ত্রিক পরিসর বলতে এতদিন যা বুঝে এসেছেন– তা আসলে পদ্মপাতায় জল। মূল শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বরকে দমন করছে তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে মোটেই নয়, অস্ত্র আর টাকার জোরে। সুতরাং কবিতা দিয়ে, শুধুই কবিতা দিয়ে এই গণশত্রুর মোকাবিলা অবাস্তব। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। ১৯৬৬-তে শেষবারের মতো দেশে ফিরলেন– গোপনে– এবং সোজা চলে এলেন পাহাড় ও নদীতে ঘেরা সিয়েরা দে লাস মিনাস উপত্যকায়। সেখানে তখন মরণপণ লড়াই চালাচ্ছেন বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা (এফএআর–ফুয়েরজাস আরমাদাস রেবেলদেস)। কাস্তিইয়ো প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলেন তাঁদের সঙ্গে। দূরদেশে রয়ে গেল তাঁর প্রিয় পরিবার আর কবিতার মঞ্চ।
কলমের সঙ্গে তাঁর হাতে উঠল রাইফেলও। যা থেকে গুলি ছোটে, শত্রুসৈন্যের প্রাণ নেয়। লাস মিনাসের দুর্গম উপত্যকায় কঠিন গেরিলা যুদ্ধে অতিবাহিত টানা কয়েকটি মাস পেরিয়ে কাস্তিইয়ো ধরা পড়ে গেলেন শত্রুর হাতে, তাঁর প্রিয় কমরেড নোরা সারাকামোর সঙ্গে। বন্দি দু’জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জাকাপা ব্যারাকে। সেখানে তাঁদের প্রথমে জেরা করা হয়, কোনওভাবেই তাঁদের ভাঙতে না পেরে তারপর শুরু হয় অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। তাতেও তাঁদের মুখ থেকে কিছু বের করতে না পেরে ক্ষিপ্ত শত্রুপক্ষ তাঁদের দু’জনকেই আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলল। সেই তারিখটা (সম্ভবত) ১৯৬৭-র ১৯ মার্চ।
পুড়ে শেষ হল না ওতো রেনি কাস্তিইয়োর কবিতা। দুনিয়ার তাবৎ গা-বাঁচানো লেখক-শিল্পীদের সামনে এক অগ্নিশুদ্ধ দর্পণ হয়ে পলাতক, সুখী মুখগুলিকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিব্রত করতেই থাকল।
অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি
একদিন
নিচের তলার মানুষেরা
আমার দেশের
সব অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের
জেরার টেবিলে বসাবে।
জানতে চাওয়া হবে,
কী করছিল তারা
যখন আমাদের দেশ
ধিকিধিকি আগুনের আঁচে
একটু একটু করে
পুড়ে যাচ্ছিল?
কেউ তাদের
পোশাক নিয়ে কিংবা
দুপুরের ভাতঘুম নিয়ে
একটা কথাও তুলবে না,
কেউ জানতে চাইবে না
‘না-এর দর্শন’ নিয়ে তাদের
অনন্ত কুস্তি বা
দুহাতে কামানো
টাকাপয়সার ব্যাপারে।
জানতে চাওয়া হবে না
গ্রিক মিথোলজির তত্ত্ব অথবা
মরবার আগেই মরতে থাকা
তাদের অন্তরাত্মার বিষণ্ণ ঠিকুজি।
একটি কথাও উঠবে না
মিথ্যের সারে, জলে বেড়ে ওঠা
তাদের উদ্ভট সব যুক্তিগুলি নিয়ে।
সেই দিনটাতে
সহজ সরল মানুষগুলি আসবে
সেই তারা,
অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের
কোনও বইয়ের পৃষ্ঠায় বা
কবিতার পঙক্তিতে যারা
কোনোদিনই ছিল না,
কিন্তু প্রতিদিন যারা
যুগিয়ে এসেছে তাদের
পাঁউরুটি আর দুধ
তাজা ডিম আর তর্তিলা
যারা তাদের গাড়িগুলো চালাতো
কুকুর আর বাগানের দেখভাল করত
তারা শুধাবে–
“কী করছিলে,
যখন গরিব মানুষগুলো মরছিল
আর পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হচ্ছিল
তাদের ভেতরকার সব কোমলতাটুকু?”
আমার প্রিয় স্বদেশের
অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা!
তোমাদের মুখে কোনও রা সরবে না।
নৈঃশব্দের শকুন তোমাদের
বড় বড় কথাগুলিকে
ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নেবে।
তোমাদের বুক ঠেলে
উঠে আসতে চাইবে
তোমাদের দুর্ভাগ্য।
আর
অনন্ত লজ্জা তোমাদের ঠোঁট চেপে ধরবে।
(চলবে)
…আরও পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ