শুধুমাত্র ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’ এবং ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস পড়ে মনে হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমসাময়িক বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে বেগম রোকেয়ার একটি স্বচ্ছ ধারণা ছিল। প্রথম দিকে অবিশ্যি, বাংলা ভাষার কোনও কোনও গবেষকের দৃষ্টিতে বেগম রোকেয়ার একটি বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় স্বীকৃত হলেও কেউই নারীস্থানকে সুস্পষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে আখ্যায়িত করেননি। কেউ বলেছেন ওটি ব্যঙ্গ রসাত্মক রচনা, কেউ বলেছেন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কল্পনার কথা।
৩.
‘We are volcanoes. When we women offer our experience as our truth, as human truth, all the maps change. There are new mountains.’ – Ursula K. Le Guin.
১৯০২ সালে কলকাতার ‘নবপ্রভা’ পত্রিকায় ‘পিপাসা’ রচনার লেখিকা ‘মিসেস আর. এস. হোসেন’ নামের আড়ালে বেগম রোকেয়া লেখালেখির জগতে পদার্পণ করলেন। ১৯০৪-এ প্রকাশিত হল সাতটি দীর্ঘ প্রবন্ধ সমন্বিত তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই ‘মতিচূরের প্রথম খণ্ড’। সহজ গতিশীল ভাষার কাঠামোয় কখনও নির্মল কৌতুক, কখনও তীব্র ব্যঙ্গ, কখনও প্রতীকে-রূপকে, আবার কখনও বা সোজাসাপ্টা যুক্তিবাদের অবতারণায় তিনি একের পর এক প্রবন্ধে লিখে যাচ্ছিলেন। মেয়েদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবরুদ্ধতার কথা লিখছিলেন। জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মেয়েদের দুঃসহ দুর্দশার জন্য মতিচূরের প্রবন্ধগুলিতে তিনি সরাসরি দায়ী করেছিলেন সনাতন আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলিকে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পর্দাপ্রথার মতো সমস্যাগুলির সমালোচনা করছিলেন। ‘আমাদের অলংকার গুলি… এগুলি দাসত্বের নিদর্শন… অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু প্রভৃতি লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে… সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি হার পরিয়াছি… দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্ব সূচক গহনাও ভালো লাগে…।’
স্বপ্ন দেখার পরিসর। এই স্বপ্নটা দেখার অপেক্ষা ছিল শুধু। আর তাই, রোকেয়া এগিয়ে গেলেন আরও এক ধাপ। স্বাধীনতা অর্জনের কামনা থেকে এক পা এগিয়ে বেরিয়ে যাওয়া স্পেকুলেটিভ ফিকশনের দুনিয়াতে। ১৯০৫-এ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন’-এ বেরলো ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’ নামক এক বিস্ময়কর কল্পবিজ্ঞানমূলক উপন্যাস। এখানে ‘নারীস্তান’ নামের এক কল্পরাজ্যের গল্প শোনালেন রোকেয়া। যেখানে পুলিশ নেই, যুদ্ধ নেই। অশান্তিও নেই। কারণ পুরুষ সে দেশে অবরুদ্ধ আর মেয়েরা মুক্ত-স্বাধীন। নারীস্তানে পুরুষেরা করে দৈহিক শ্রমের কাজ আর মেয়েরা বিজ্ঞান ও মস্তিষ্কের যাবতীয় কাজ। মেয়েরাই যেহেতু সেই দেশ চালায়, তাই তারা সবাই সেখানে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচ-নিরাপদ-নিশ্চিন্ত, ফলে ভীষণরকম সুখী।
শুধুমাত্র ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’ এবং ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস পড়ে মনে হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমসাময়িক বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে বেগম রোকেয়ার একটি স্বচ্ছ ধারণা ছিল। প্রথম দিকে অবিশ্যি, বাংলা ভাষার কোনও কোনও গবেষকের দৃষ্টিতে বেগম রোকেয়ার একটি বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় স্বীকৃত হলেও কেউই নারীস্থানকে সুস্পষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে আখ্যায়িত করেননি। কেউ বলেছেন ওটি ব্যঙ্গ রসাত্মক রচনা, কেউ বলেছেন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কল্পনার কথা। গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘প্রথম নারীবাদী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বিজ্ঞান বিষয়ক গভীর আগ্রহ এবং সাধারণ জ্ঞান তাঁর চিন্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল। বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ছাপ মুদ্রিত বিশেষ করে তাঁর সুলতানার স্বপ্নে।’ তিনি যেগুলোকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলছেন, মনে রাখতে হবে সোয়াশো বছর আগে তা মোটেও সাধারণ ছিল না। ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’-এর উপাদানগুলো ছিল তখনকার দিনের অতি উচ্চতর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। বারেবারে এই আলোচনা হয়েছে।
মার্কিন কিংবদন্তি কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের মতে, কল্পবিজ্ঞান হচ্ছে ‘সাহিত্যের একটি শাখা, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত হয়’, (Science fiction can be defined as that branch of literature which deals with the reaction of human beings to changes in science and technology)। আর এক জায়গায় আসিমভ বলেছিলেন, ‘মানুষ যতক্ষণ বিজ্ঞানের যথার্থতা বা যৌক্তিকতা বুঝতে পারবে না এবং তা তাদের গল্পের উপযোগী করে ব্যবহার করতে পারবে না, ততক্ষণ সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞানের জন্ম হবে না’ (True science fiction could not really exist until people understood the rationalism of science and began to use it with respect to their stories)। নানা মুনির নানা মত হলেও গড় মতে কল্পবিজ্ঞান হল প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকে কল্পনা দ্বারা প্রসারিত করে ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনও অবস্থাকে গল্পে রূপ দান।
এভাবে কল্পবিজ্ঞান রচনার প্রথম শর্ত হচ্ছে, এটি হতে হবে কাল্পনিক। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, কল্পনাটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। আর অধিকাংশ লেখকের মতে, কল্পবিজ্ঞানের তৃতীয় শর্তটি হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী বা স্পেকুলেটিভ। আজকের বৈজ্ঞানিক-কারিগরি তথ্য বা জ্ঞান ভবিষ্যতে অনেক উন্নত হয়ে কী দাঁড়ায়, এবং সে সময়ে উদ্ভুত নতুন কোনও সমস্যার সমাধানে কীভাবে কাজে আসে, তাই নিয়েই কাল্পনিক গল্প। সেই ভবিষ্যৎটি হতে পারে যৌক্তিক বা বাস্তব অথবা ফ্যান্টাসি বা অবাস্তব। বিখ্যাত ফরাসি লেখক জুল ভার্নের লেখা ‘এরাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’, ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দি সি’, এবং ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’। তিনটি বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি যার সবগুলো কল্পনাই ভবিষ্যতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কল্পনাটি যদি বাস্তবসম্মত না হয়, তবে সেটি হয়ে যেতে পারে আষাঢ়ে, আজগুবি, জাদু অথবা রূপকথার গল্প। তাহলেও সেটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, হতে পারে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বইটি এই গোত্রের। মেরি শেলির লেখাও ভবিষ্যৎমুখীই ছিল।
বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি ওপরে উল্লিখিত কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল? এককথায়, হ্যাঁ।
‘ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর কল্পনাটি ছিল যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মত; মস্তিষ্কের লাগামহীন চিন্তা-প্রসূত নয়। ফলে আজ থেকে সোয়াশো বছর পূর্বে ভবিষ্যতের যে যে অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতির কথা তিনি লিখে গেছেন, বিগত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর থেকে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়ে চলেছি আজও।’ (আশরাফ আহমেদ)
প্রাতিষ্ঠানিক কোনও স্কুলে না গিয়ে, ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে (‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’ প্রকাশের সময় তাঁর বয়স) রোকেয়া উন্নততর বিজ্ঞানের কথা লিখেছেন। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, আজকের গবেষকরা তাঁকে নিয়ে কাজ করছেন আবার।
শেষ করি একটা অ্যানেকডোট দিয়ে। ১৯০৫ সালে দু’দিনের সরকারি সফর শেষে ডেপুটি মেজিস্ট্রেট স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি ফিরে রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার অবর্তমানে আপনি কী করছিলেন? উত্তরে রোকেয়া ‘‘সুলতানা’স ড্রিম’’-এর পাণ্ডুলিপিটি তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ পাঠশেষে স্বামী মন্তব্য করেছিলেন এ তো দেখছি এক ‘ভয়ংকর প্রতিশোধ’! এরপর ইংরেজি ভাষা সংশোধনের জন্য তিনি পাণ্ডুলিপিটি ভাগলপুরের ইংরেজ কমিশনার মিস্টার ম্যাকফারসনের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র সংশোধন না করে মিস্টার ম্যাকফারসন ফিরতি চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইহাতে যে ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে তাহা অত্যন্ত আনন্দপ্রদ ও স্বকীয়, এবং তা লেখা হয়েছে নির্ভুল ইংরেজিতে।…আমি ভাবছি ভবিষ্যতের কোনও এক সময়ে আমরা বায়ু-পথে কীরূপে ভ্রমণ করিব তিনি তাহার অগ্রিম বার্তাই দিয়াছেন। এই ব্যাপারে তাহার পরামর্শটি (কল্পনাটি– লেখক) সবচেয়ে অসাধারণ’। (বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল, বেগম রোকেয়া পৃ. ২৯২)।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই