কঙ্কালীতলার বর্তমান মন্দিরে কোনও মূর্তির পূজা হয় না, একটি কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে ঢাকা কালীর পট পুজো করা হয়, পুরোহিতের দাবি অনুযায়ী পটখানি হাতে আঁকা, যদিও সাধারণভাবে মনে হয়, একটি ফটো মাত্র। দেবীর নিত্য অন্নভোগের আয়োজন হয়। মন্দিরে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে। বিস্তৃত মন্দির চত্বর ও প্রশস্ত নাটমন্দির ছাড়িয়েও আশপাশে সব সময়েই ভক্তেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। মন্দিরের ডানদিকে ছোট্ট একটি যূপকাষ্ঠ, অধিকাংশ সময় সেখানে বলিদান চলে।
১৮.
সতীর দেহ যে একান্নটি স্থানে পড়েছিল, তার প্রতিটিই সতীক্ষেত্র বা সতীপীঠ নামে খ্যাত। এর মধ্যে সতেরোটি পীঠ পশ্চিমবঙ্গে, তায় আবার শুধু বীরভূম জেলাতেই পাঁচটি সতীপীঠ দেখা যায়। এরই অন্যতম বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলায় মা কঙ্কালী, যেখানে নাকি সতীর কাঁকাল পতিত হয়। সংশ্লিষ্ট বইপত্রে অবশ্য লেখা আছে কাঞ্চী দেশে সতীর কাঁকাল পতিত হয়, আর সেই কাঞ্চীদেশের অবস্থান নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পীঠনির্ণয় তন্ত্রে লেখা আছে, কাঞ্চীদেশে দেবীর কঙ্কাল পড়েছিল, আর সেখানে ভৈরবরূপে বিরাজ করেন রুরু ভৈরব। মহাপীঠ নিরূপণ বইতেও ওই কথারই পুনরাবৃত্তি করা আছে। তবে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন,
কাঞ্চীদেশে পড়িল কাঁকালি অভিরাম।
বেদগর্ভা দেবতা ভৈরব রুরু নাম।
একথা সত্যি যে, বীরভূমের কঙ্কালীতলায় ভৈরবের নাম রুরু, দেবী কঙ্কলী, কিন্তু এটিই সেই কাঞ্চীদেশ কি না জোর দিয়ে বলা যায় না। আর ‘বেদগর্ভা’ নামটি সেই পীঠনির্ণয় তন্ত্রতেই উল্লেখিত। বস্তুত দীনেশচন্দ্র সরকার, কিংবা বীরভূমের ভূমিপুত্র তথা সাহিত্যসেবক ও ইতিহাসবিদ (বীরভূম বিবরণের রচয়িতা) হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বীরভূমে একটিই মাত্র পীঠ, বক্রেশ্বর। বাকি সব উপপীঠ বা সিদ্ধপীঠ। বস্তুত, বীরভূম কখনও কাঞ্চীদেশ ছিল না, ছিল কামকোটি। তবে বীরভূমে তন্ত্রের ব্যাপ্তি ছিল প্রশ্নাতীত, এখানে সিদ্ধপীঠ, সতীপীঠ ও উপপীঠের আধিক্য পশ্চিমবঙ্গের অন্য জেলার তুলনায় চোখে পড়ার মতো। আর কাঞ্চীদেশ মানে তো অধুনা তামিলনাড়ুর কাঞ্চীপুরম, একদা চোল রাজাদের রাজধানী। তাঞ্জোরের বৃহদীশ্বর শিবের মন্দির যাঁদের অন্যতম কীর্তি। এই বংশীয় রাজেন্দ্র চোল প্রথম মহীপালের রাঢ় বাংলা আক্রমণ করেছিলেন দশম শতাব্দীতে। শিবভক্ত রাজেন্দ্র চোল সেইকালে কাঞ্চীশ্বর শিবের প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। তবে কি ওই সময়ে বীরভূম, রাজেন্দ্র চোলের স্মৃতিবাহী হয়ে কাঞ্চীদেশে পরিণত হয়?
পরের প্রশ্ন বেদগর্ভা কেন বলা হয়? ইনি কি বৈদিক কোনও দেবী? সম্ভবত না। বিশিষ্ট গবেষকদের মতে, আদিশূরের সময়ে আগত বীরভূমের সাবর্ণগোত্রীয় ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ বেদগর্ভ, তিনি কঙ্কালীপীঠে শক্তি সাধনা করেছিলেন। তাঁর পূজিতা দেবীই কি বিশীর্ণ চামুণ্ডা মূর্তি, যার সঙ্গে কাঁকাল ভাঙার কাহিনি জুড়ে আছে? সম্ভবত এই মতটিই ঐতিহাসিকভাবে অধিক গ্রহণযোগ্য, বিশেষ করে কঙ্কালী-মায়ের পুরাতন পুরোহিত বংশের কুলজি ঘাঁটলে অমনটাই মনে হয়।
প্রশ্ন অনেক, যার উত্তর মেলা ভার। কালের অতলে কোনও পাথুরে বা লিপিবদ্ধ প্রমাণ ছাড়াই আত্মগোপন করে করে আছে। যেমন দেবীর কাঁকালখানি বর্তমান মন্দিরের ঈশাণকোণে কুণ্ডের জলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আছে। কুণ্ডের পাড় চারদিকে বাঁধানো। সন্ধ্যার সময় সেই কুণ্ডের পাড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করা হয়। সামান্য দূরে শ্মশান, মাঝে শীর্ণা কোপাই নদী। দেবীকুণ্ডে দেবীর সঙ্গে আছেন পঞ্চশিব, চৈত্রমাসে গাজনের সময় জল থেকে তুলে তাঁদের পুজো হয়, আবার পুজো শেষে কুণ্ড মধ্যে রেখে দেওয়া হয়।
…………………………………………………………………………………
একথা সত্যি যে, বীরভূমের কঙ্কালীতলায় ভৈরবের নাম রুরু, দেবী কঙ্কলী, কিন্তু এটিই সেই কাঞ্চীদেশ কি না জোর দিয়ে বলা যায় না। আর ‘বেদগর্ভা’ নামটি সেই পীঠনির্ণয় তন্ত্রতেই উল্লেখিত। বস্তুত দীনেশচন্দ্র সরকার, কিংবা বীরভূমের ভূমিপুত্র তথা সাহিত্যসেবক ও ইতিহাসবিদ (বীরভূম বিবরণের রচয়িতা) হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, বীরভূমে একটিই মাত্র পীঠ, বক্রেশ্বর। বাকি সব উপপীঠ বা সিদ্ধপীঠ।
…………………………………………………………………………………
কঙ্কালীতলার অদূরে আদিত্যপুর গ্রামেও শিব মন্দিরের শিবলিঙ্গটি পাশের এক কুণ্ডে সারা বছর নিমজ্জিত থাকে, আর চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে জল থেকে তুলে এনে মাসখানেক মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে পুজো করা হয়, তারপর ফের কুণ্ডে নিমজ্জিত করা হয়। এই পঞ্চশিব অনেকের মতে শিবের পঞ্চমুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। উপরন্তু চোল রাজাদের শিবভক্তি, শিবপূজনের আধিক্যকেও মনে করিয়ে দেয়। একদা যখন রাজেন্দ্র চোল এই অংশে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, তখন নানাস্থানেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও পুজো করার সম্ভাবনা থেকেই যায়। হয়তো আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে এনে ওই পাঁচটি শিবকে কঙ্কালীতলার দেবীকুণ্ডে দেবীর দেহাংশ বলে কথিত পাথরের সঙ্গে একত্রে রাখা আছে। দেবীকুণ্ডের জল ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র, চৈত্র মাসে কোনও কোনওবার সেই কুণ্ডের পাঁক তুলে ফেলা হয়, আর সেই সময়ে দেবীর দেহাংশের আভাস মাত্র পাওয়া যায়। লোকমতে, দেবীর দেহাংশ দর্শন অমঙ্গলের সূচনা করে, তাই সাধক ভিন্ন অন্যদের দর্শন না করাই ভালো।
কঙ্কালীতলার বর্তমান মন্দিরে কোনও মূর্তির পূজা হয় না, একটি কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে ঢাকা কালীর পট পুজো করা হয়, পুরোহিতের দাবি অনুযায়ী পটখানি হাতে আঁকা, যদিও সাধারণভাবে মনে হয়, একটি ফটো মাত্র। দেবীর নিত্য অন্নভোগের আয়োজন হয়। মন্দিরে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে। বিস্তৃত মন্দির চত্বর ও প্রশস্ত নাটমন্দির ছাড়িয়েও আশপাশে সব সময়েই ভক্তেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। মন্দিরের ডানদিকে ছোট্ট একটি যূপকাষ্ঠ, অধিকাংশ সময় সেখানে বলিদান চলে।
রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে এক চিঠিতে এই বলির বীভৎস দৃশ্যের কথা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলা বলে এক তীর্থে বৎসরে একবার বিশেষ পরবে নানা ভক্তের মানৎরূপে বহু শত পাঁঠার বলিদান হয়, নিকটের জলাশয় রক্তে লাল হয়ে ওঠে’। রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়াই মন্দিরে মন্দিরে দেবদেবীর সামনে রক্তপাতের বিরোধী ছিলেন। আর যে ‘পরব’-এর কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, সেটি হল বাৎসরিক কঙ্কালী মেলার অনুষ্ঠান, যে উৎসব প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির তিথিতে। লোকবিশ্বাস যে, ওই দিন মা কঙ্কালী কল্পতরু হয়ে ভক্তদের সকল বাঞ্ছা পূরণ করেন।
“শম্ভু বাজিকর এ মেলায় প্রতি বৎসর আসে। তাহার বসিবার স্থানটা মা কঙ্কালীর এস্টেটের খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত কায়েমী হইয়া গিয়াছে। লোকে বলে বাজি, কিন্তু শম্ভু বলে ‘ভোজবাজি ছারকাছ’। ছোট্ট তাঁবুটার প্রবেশ পথের মাথার উপরেই কাপড়ে আঁকা একটা সাইন বোর্ডেও লেখা আছে ‘ভোজবাজি– সার্কাস’।”
তারাশঙ্করের ‘বেদিনী’ গল্পের শুরুটা হয়েছে এভাবেই। আবার ‘কবি’ উপন্যাসেও এসেছে কঙ্কালী-মেলার কথা। তারাশঙ্করের লাভপুরের বাড়ির কাছে ফুল্লরা মন্দির। স্থানীয়দের দাবি, সেটিও না কি এক সতীপীঠ, সেখানেও সারা বছর চলে ভক্তদের আনাগোনা, মেলা। কিন্তু এই অঞ্চলে কঙ্কালীতলার মেলার গুরুত্ব ও পরিচিত খুবই বেশি। যদিও সাম্প্রতিককালে সেই জৌলুস অনেক কমে গেছে। গ্রামীণ মেলার যে সাবেকী ছবি, তার অনেকটাই আজ আর নেই। তাতে লেগেছে আধুনিকতার স্পর্শ। আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগের কঙ্কালী-মায়ের খোড়ো মন্দির চত্বরে বাউল, বৈষ্ণবের ছোট ছোট আখড়ায় সুরেলা গান, টিমটিমে আলোয় অনুজ্জ্বল এলাকায় মাটির বাসন বা দেশি ঘরোয়া খাবারের দোকান ঘিরে যে গমগমে পরিবেশ ছিল, তা আজ আর নেই। মার্বেল-ছাওয়া মন্দির, বিজলিবাতি আর মাইকের নিদারুণ কর্কশ ঘোষণায় গ্রামীণ, প্রাচীন মেলার স্বাদ গন্ধ সবই উধাও।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
বেশ কিছু শক্তিসাধকের নাম এই তীর্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে এখানে সাধনা করেছেন ও সিদ্ধ হয়ে মাতৃ দর্শন লাভ করেছেন বলে শোনা যায়। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জগদীশ বাবার জন্ম হয় ১৩০৮ সনে বীরভূমের অন্যতম সিদ্ধপীঠ তারাপীঠের কাছে এক গ্রামে। শোনা যায়, মাত্র আট বছর বয়সে তিনি এক ডোবায় পড়ে মারা যান, তারপর তাঁর বাবা মা ছুটে যান বামাক্ষেপার কাছে। বামা আবার আটজন মহাপুরুষকে আমন্ত্রণ জানান, তাঁরা এসে আটদিন একটানা এক বদ্ধ ঘরে ধ্যানমগ্ন থাকার পর ধীরে ধীরে জগদীশের মৃত শরীরে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। সেই থেকেই বামাক্ষেপার প্রতি বালক জগদীশের এক গভীর আকর্ষণ তৈরি হয়। যদিও তাঁর যখন মাত্র ১৭ বছর বয়স, তখন বামাক্ষেপার দেহাবসান হয়, পরে মুর্শিদাবাদের এক বৈষ্ণব সাধক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে দীক্ষা হয়। এরপর তিনি হিমালয়ে ৩০ বছর যাবৎ তপস্যা করে ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ কঙ্কালীতলায় আসেন, আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। বিবাহিত এই মানুষটি নাকি প্রভূত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সাতু ক্ষেপা নামের আরেক উচ্চশ্রেণির সাধক দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন কঙ্কালী মায়ের থানে, তিনি জাতে বাগদি হলেও প্রচুর মানুষ তাঁকে দেবজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। ছিলেন নীরেন ঘটক, ভৈরবী মা, ভৈরব গিরি, সনাতন বাবা প্রমুখ।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। শ্রীরাধার মূর্তিকে কনের সাজে যুগল কিশোর মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
পর্ব ১৬। যে দেবীর পুজোর নির্ঘণ্ট ঠিক করা হয় জলঘড়ির সাহায্যে
পর্ব ১৫। হেস্টিংসের নজর থেকে গুহ্যকালীর মূর্তি রক্ষা করেছিলেন মহারাজা নন্দকুমার
পর্ব ১৪। সারা বছর দেবী থাকেন জলের তলায়, পুজো পান কেবল বৈশাখের সংক্রান্তিতে
পর্ব ১৩। দ্বিধাগ্রস্ত বিবেকানন্দকে পথ দেখিয়েছিল যে কন্যাকুমারী
পর্ব ১২। রানি অহল্যাবাইয়ের উদ্যোগে পুনর্নির্মাণ ঘটে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরের
পর্ব ১১। বৈজু গোয়ালা যেভাবে পেয়েছিল শিবের দর্শন
পর্ব ১০। নবদ্বীপ বরাবর সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র, সেই সমাহার আজও বর্তমান
পর্ব ৯। দেবী কামাখ্যার পুজোর নেপথ্যে রয়েছে আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব