রামজীবন রায় চৌধুরী তারাপীঠ মন্দিরের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন, মায়ের নিত্য ভোগরাগাদি, পান্ডাদের ভোগের বরাদ্দ প্রভৃতি সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে মন্দিরে ভক্তদের জন্যেও নানা ব্যবস্থা করেছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নানা সময়ে মন্দিরের উন্নতি সাধনে এগিয়ে আসেন। ফলে তারাপীঠ ক্রমশই আগের চেয়ে বেশি প্রচার পেতে থাকে। যদিও বিশাল শ্মশান, ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশের কারণে তীর্থযাত্রীদের ভিড় তুলনায় কম ছিল। ভিড় যা ছিল তা হল তন্ত্রপথের অনুসারীদের। আর সেই সময়েই আবির্ভূত হলেন তারামায়ের কোলের ছেলে বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়, যাকে ভারতবাসী চেনেন ‘বামাক্ষ্যাপা’ নামে।
৭.
কিছু কিছু তীর্থক্ষেত্রে এমন এক সাধক আসেন, যাঁর সাধন জোরে দেবতা জেগে ওঠেন, তখন ভক্তদল ছুটে যায় সেই মন্দিরে মনের কামনা নিয়ে। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ, তারাপীঠে বামাক্ষ্যাপা এমনই সব সাধক। নতুবা সেই কবেই তো তারাপীঠে বশিষ্ঠ মুনি সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তারপর লোকে কতদিনই বা সে-কথা মনে রেখেছিল! বামাক্ষ্যাপা এসে যেন তারা মায়ের মন্দিরে নবীন প্রাণের সঞ্চার ঘটালেন। যদিও বামাক্ষ্যাপার জন্মের বহু আগে থেকেই এই মন্দির এক মহাতীর্থ ছিল, ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ ঋষি এই তারাপীঠে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। জড়িয়ে আছে অজস্র অলৌকিক ঘটনা, তবু বামাক্ষ্যাপাই যেন তারাপীঠকে ফিরিয়ে দিলেন তার হৃত গৌরব।
মহামুনি বশিষ্ঠ নানা তীর্থে ঘুরে ঘুরে তপস্যা করেও সিদ্ধি লাভ করতে পারেননি। মহাচীনাচার তন্ত্রমতে সাধনার জন্য কামাখ্যার মতো মহাতীর্থে গিয়েও সফলতা আসেনি। তবে সেখানে থেকেই তিনি জানতে পারেন এই তারাপীঠের কথা। তারাপীঠে এসে শুরু হল কঠোর সাধনা, দিন যায়, বছর ঘোরে, সিদ্ধি লাভ আর হয় না। প্রায় হতাশ হয়ে আত্মবিসর্জন দেবেন ঠিক করেছেন, এমন সময় একরাত্রে দৈববাণী শুনলেন বশিষ্ঠ, তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। বশিষ্ঠ চাইলেন দেবীর দর্শন, মাতৃরূপে দেবী যেন আবির্ভূতা হন। দেবী বললেন, ‘তথাস্তু’। প্রকটিত হল এক অপরূপ মাতৃমূর্তি। দ্বিভূজা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী, বামক্রোড়ে বালকরূপী মহাদেব। দেবীর উন্মুক্ত স্তনপানে রত। সমুদ্র মন্থনের কালে উঠেছিল হলাহল, শিব ভিন্ন অন্য কেউ সেই হলাহল পান করতে সমর্থ ছিলেন না, অন্যথায় সারা সৃষ্টিই হত বিপন্ন। গ্রহণ করলেন সেই তীব্র বিষ, কণ্ঠ তাঁর নীল হয়ে গেল, যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন, তখন আদ্যাশক্তি মহামায়া তাঁর স্তন উন্মুক্ত করে সুধা পান করালেন, তিনি যে জগন্মাতা। তবে কি না এই বিশেষ রূপের বিষয়ে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে স্কন্দপুরাণে।
বলাসুর নামের এক দুর্ধর্ষ অসুরের অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে সমস্ত দেবতা, নর, মুনি আদ্যাশক্তি মহামায়ার শরণাপন্ন হলেন। দেবীও প্রচণ্ড ক্রোধে অসুর নিধনে এগিয়ে গেলেন। অসুর আর তার দলবল সকলেই নিহত হলেও দেবীর উন্মত্ততা স্তিমিত হল না, সৃষ্টি ধ্বংসের সম্মুখীন। দেবতারা মিলে এসে ধরলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। মহাদেব সদ্যজাত শিশুর রূপ নিয়ে দেবীর সামনে দাঁড়ালেন। নিমেষে দেবীর মাতৃসত্তা জাগ্রত হল। সংহাররূপ পরিত্যাগ করে মাতৃরূপে শিশুকে স্তন পান করালেন। বশিষ্ঠের দেখা সেই অপরূপ শীলামূর্তি ও মায়ের চরণ চিহ্ন সমৃদ্ধ পাথর ব্রহ্মশিলা রূপে আজও পূজিত হয়ে চলেছে।
তারামূর্তি মোট আট ধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়– তারা, উগ্রতারা, মহা উগ্রতারা, বজ্রা, নীলা, সরস্বতী, কামেশ্বরী ও ভদ্রকালী। এই অষ্টতারা মূর্তির মধ্যে ভদ্রকালীর পরিবর্তে কোথাও কোথাও চামুণ্ডার নামোল্লেখ পাওয়া যায়, তবে বৌদ্ধতন্ত্রে তারাকে নীলসরস্বতী বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। তারাপীঠে তারার ধ্যানমন্ত্রে একটি অদ্ভুত শব্দ পাওয়া যায়, ‘প্রত্যালীঢ়া পদাং ঘোরাং’ এই ‘প্রত্যালীঢ়’ পদ অবশ্যই এক যুদ্ধ ভঙ্গিমা। আভিধানিক অর্থ হল, শরসন্ধানকালে বামপদ প্রসারিত ও দক্ষিণ পদ সঙ্কুচিত করে উপবেশন। এই বিশেষ ভঙ্গিমার মূর্তি সত্যিই বিরল। এই তীর্থ সিদ্ধপীঠ রূপে পরিচিত। বশিষ্ঠে সাধনায় তৃপ্ত হয়ে দেবী আশীর্বাদ করেন– শুধুমাত্র মন্ত্র-নির্দিষ্ট জপেই সাধকমাত্রেই সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন। ক্রমে সেইকাল অতিক্রান্ত হলে, তারা মায়ের মন্দিরও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকে। এরপর শুরু হয় কিংবদন্তির।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তারামূর্তি মোট আট ধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়– তারা, উগ্রতারা, মহা উগ্রতারা, বজ্রা, নীলা, সরস্বতী, কামেশ্বরী ও ভদ্রকালী। এই অষ্টতারা মূর্তির মধ্যে ভদ্রকালীর পরিবর্তে কোথাও কোথাও চামুণ্ডার নামোল্লেখ পাওয়া যায়, তবে বৌদ্ধতন্ত্রে তারাকে নীলসরস্বতী বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। তারাপীঠে তারার ধ্যানমন্ত্রে একটি অদ্ভুত শব্দ পাওয়া যায়, ‘প্রত্যালীঢ়া পদাং ঘোরাং’ এই ‘প্রত্যালীঢ়’ পদ অবশ্যই এক যুদ্ধ ভঙ্গিমা। আভিধানিক অর্থ হল, শরসন্ধানকালে বামপদ প্রসারিত ও দক্ষিণ পদ সঙ্কুচিত করে উপবেশন। এই বিশেষ ভঙ্গিমার মূর্তি সত্যিই বিরল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জয়দত্ত নামের এক বণিক দ্বারকা নদী বেয়ে বাণিজ্যযাত্রার কালে মধ্যাহ্নে ভোজনের আয়োজন করেন এইখানে। কেউ কেউ আবার বলেন, কোন এক পাথরে ধাক্কা লেগে নৌকা ফুটো হয়ে গেলে জয়দত্ত বাধ্য হয়ে এখানে বেশ অনেক সময় ব্যয় করতে থাকেন। একদিন বিষাক্ত এক সাপের কামড়ে তাঁর একমাত্র পুত্র মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওদিকে জনৈক মাঝি একটি বড়সড় মাছ ধরে কেটেকুটে জলে ধুতে গেলে হঠাৎ-ই কাটা মাছ জ্যান্ত হয়ে জলে পালিয়ে যায়। বণিক সেই ঘটনায় বিস্মিত তো হলেনই, সঙ্গে আশার একচিলতে রশ্মিও যেন উদিত হল তাঁর মনে। সেই জলাশয়ের জল তুলে এনে মৃত ছেলের গায়ে ছিটিয়ে দিলে খানিক বাদেই ছেলে চোখ মেলে তাকাল। জয়দত্ত বুঝলেন এই নিশ্চয়ই দৈবীমায়া। চিন্তা করতে রইলেন, রাতে স্বপ্ন দেখলেন তারা মায়ের ইচ্ছায় এইসব ঘটে চলেছে, আর মায়ের আদেশে তাঁর মন্দির গড়ে দিতে হবে তাঁকে। গড়া হল মন্দির। আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে জয়দত্ত মন্দিরে দেবী দর্শন করে ধন্য হলেন। শোনা যায়, বশিষ্ঠও নাকি ওই তিথিতে দেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। সেই থেকে ওই তিথিটিকে তারাপীঠে তারামায়ের আবির্ভাব দিবস বলে মান্য করা হয়।
কিংবদন্তি পেরিয়ে ইতিহাসের কাল শুরু হলে দেখা যায়, রামজীবন রায় চৌধুরী একদা এই অঞ্চলের মহলদার ছিলেন। তখন মুর্শিদকুলি খাঁর আমল, সেই কালে ১৭১১-’১২ নাগাদ নাটোর রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর দত্তক পুত্র রামকান্ত, তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাণী ভবানীর। রামজীবন রায় চৌধুরী তারাপীঠ মন্দিরের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন, মায়ের নিত্য ভোগরাগাদি, পান্ডাদের ভোগের বরাদ্দ প্রভৃতি সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে মন্দিরে ভক্তদের জন্যেও নানা ব্যবস্থা করেছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নানা সময়ে মন্দিরের উন্নতি সাধনে এগিয়ে আসেন। ফলে তারাপীঠ ক্রমশই আগের চেয়ে বেশি প্রচার পেতে থাকে। যদিও বিশাল শ্মশান, ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশের কারণে তীর্থযাত্রীদের ভিড় তুলনায় কম ছিল। ভিড় যা ছিল তা হল তন্ত্রপথের অনুসারীদের। আর সেই সময়েই আবির্ভূত হলেন তারামায়ের কোলের ছেলে বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়, যাকে ভারতবাসী চেনেন ‘বামাক্ষ্যাপা’ নামে।
জন্মাবধি তারাপীঠের এই সাধক সঙ্গ পেয়েছেন একাধিক তান্ত্রিক সাধুর, কৈলাশপতিবাবা তাঁকে তারা মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে তান্ত্রিক সাধনপথে পরিচালনা করেছেন। কৌল মোক্ষদানন্দের পরে তারামায়ের সেবায় তিনি স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে কিংবদন্তি আজও ছড়িয়ে, জড়িয়ে আছে তারাপীঠে। তাঁর টানে এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এসেছিলেন তন্ত্রাভিলাষী সাধুদের সঙ্গ করতে প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়। এসেই চলেছেন কত না সাধু, তান্ত্রিক আর অগণিত আতুর কৃপাপ্রার্থী। অলৌকিক ঘটনায় অবিশ্বাসী কত মানুষ তারাপীঠের এই শিবাবতারকে দর্শন করে বিশ্বাসের বেদিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ইষ্টদেবতাকে। তিনি গুরু থেকে ইষ্টে পরিণত হয়েছেন ক্রমে।
তারাপীঠ আজও এক মহাতীর্থ, শুধু বীরভূম বা পশ্চিমবঙ্গে নয় ভারতের নানা প্রান্ত থেকে নিত্যদিন কত না পুণ্যার্থী ছুটে আসেন এই তীর্থে। ভাদ্রমাসের অমাবস্যা তিথি, যা কৌশিকী অমাবস্যা নামে খ্যাত সেইদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন তারাপীঠ তীর্থে। কথিত, ওইদিন জগজ্জননী বিশ্ব প্রসব করেছেন। প্রতি অমাবস্যা তিথি, বিশেষ করে দীপান্বিতা কালীপূজার রাত্রে, মাঘমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রোটন্তী কালীপূজার রাত্রে মায়ের বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। সূর্যোদয়ের আগেই নিত্যদিন মায়ের শিলামূর্তি স্নানের পর সারাদিন ভক্তেরা মায়ের সেই মূর্তির ওপর রূপার বিশেষ আবরণ পরিয়ে বস্ত্র ও ফুলের সজ্জায় সজ্জিত রূপ দর্শন করে থাকেন। সারাদিন মায়ের মন্দিরে অসংখ্য ভক্তদের সামনেই চলে আরতি ও পূজা। মায়ের মূর্তি স্পর্শ করে প্রণাম করতে পারেন ভক্তদল। রামপুরহাট রেল স্টেশন থেকে ভাড়ার গাড়িতে সামান্য সময়েই মাতৃ মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়। দুপুরে মায়ের অন্নপ্রসাদ অর্থের বিনিময়ে পাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব