প্রতিপক্ষ দলে স্ট্রাইকার ইয়াকুবু। আর আমাদের দলের এক নম্বর স্টপারই ম্যাচটা খেলতে পারবে না। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য চার্চিলের শুধু মাত্র একটা ড্র। আর আমাদের ম্যাচটা জিততেই হবে। আমাদের মাথায় তখন সবচেয়ে বড় চিন্তা চার্চিলের বিরুদ্ধে স্টপারে কে খেলবে? কে আটকাবে বিধ্বংসী ফর্মের ইয়াকুবুকে?
৭.
প্রথম বছরেই জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন। তাও সেটা কয়েকটা ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই। তারপরেও বলছি, আমার জন্য সেরা মুহূর্ত ২০০১-২০০২ মরশুমে জাতীয় লিগ জেতা। আমার ধারণা, মোহনবাগান সমর্থকরাও নিশ্চয়ই সেই জাতীয় লিগ জয়ের মুহূর্ত ভুলতে পারেননি। এই জয়ের নেপথ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাই আজ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেব।
জাতীয় লিগ জয়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা গোয়া পৌঁছেছি। শেষ দু’টো ম্যাচ সালগাঁওকর আর চার্চিলের বিরুদ্ধে। চ্যাম্পিয়নশিপ লড়াইয়ে সেবার আমাদের সঙ্গে সমানতালে দৌড়চ্ছে চার্চিলও। তার উপর শেষ ম্যাচ চার্চিলের বিরুদ্ধে গোয়ার মাটিতে ওদের ঘরে গিয়ে খেলতে হবে। তার আগের ম্যাচটাই সালগাঁওকর। আমরা যখন গোয়াতে বসে সালগাঁওকর ম্যাচের প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেই সময় চার্চিল খুব সম্ভবত হ্যালের বিরুদ্ধে খেলতে বেঙ্গালুরু গিয়েছে। ওদের ইয়াকুবু তখন দারুণ ফর্মে। আমরা সালগাঁওকর ম্যাচ খেলে গোয়াতে অপেক্ষা করব চার্চিলের ফেরার জন্য। আমাদের কাছে দু’টো ম্যাচ তখন সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। আলভিটো তখন সালগাঁওকরে খেলছে। ওর পায়ে বল পড়লে তখন যা-তা হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় সালগাঁওকর ম্যাচটা আমরা শুরুও করলাম তেড়েফুঁড়ে।
কতটা শুনবেন? শুরুর ২ মিনিটের মধ্যেই সালগাঁওকরের জাল কাঁপিয়ে দিলাম আমি। এত দ্রুত সালগাঁওকরের জাল কাঁপিয়ে দিতে ওদের দলটা আগোছালো হয়ে গেল। ২ মিনিটের মধ্যেই গোল খেয়ে যাবে আলভিটোরা ধারণাই করতে পারেনি। এদিকে আমরা তখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছি। ফের গোল করলাম আমি। ম্যাচের বয়স তখন মাত্র ১৫ মিনিট। মানে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা সালগাঁওকরের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে। দলের পক্ষে তৃতীয় গোলটা বাসু করল ২৮ মিনিটে। সালগাঁওকর তখন বিধ্বস্ত। আর ঠিক এই জায়গাতেই বড় ভুলটা করে ফেললাম আমরা। শুরুতেই তিন গোলে এগিয়ে যাওয়ায় পুরো দলটা ভেবে নিল, সালগাঁওকর বোধহয় আর ম্যাচে ফিরতে পারবে না। ফলে টিমটা মানসিক ভাবে রিল্যাক্স হয়ে পড়ল। আর এই সুযোগেই সালগাঁওকর খেলায় ফিরল।
এতদিন পরে মনে নেই, সালগাঁওকরের হয়ে আলভিটো প্রথম গোলটা করেছিল না, দ্বিতীয় গোলটা। তবে আমাদের বিরুদ্ধে দারুণ একটা গোল করেছিল, এটুকু মনে আছে। ২৮ মিনিটের মধ্যে যে ম্যাচটা আমরা ৩-০ গোলে জিতছিলাম, সেই ম্যাচটাই শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে ৩-৪ গোলে হেরে গেলাম! ম্যাচের পর আমরা যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, সত্যিই ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছি! ড্রেসিংরুমে তখন রীতিমতো ভয় ধরতে শুরু করেছে, তাহলে কি জাতীয় লিগটা শেষপর্যন্ত হাতছাড়া হবে? শেষমেশ কি তীরে এসে তরী ডুববে? কারণ, ইয়াকুবুর গোলে হ্যালকে হারিয়ে চার্চিল তখন গোয়ায় ফিরে এসেছে। জাতীয় লিগ জেতার হিসেবটা তখন এরকম– চার্চিলকে জাতীয় লিগ জিততে হলে শেষ ম্যাচে আমাদের সঙ্গে ড্র করলেই চলবে। উল্টোদিকে আমাদের জাতীয় লিগ জিততে হলে শেষ ম্যাচে চার্চিলের বিরুদ্ধে জিততেই হবে। অর্থাৎ ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
২৮ মিনিটের মধ্যে যে ম্যাচটা আমরা ৩-০ গোলে জিতছিলাম, সেই ম্যাচটাই শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে ৩-৪ গোলে হেরে গেলাম! ম্যাচের পর আমরা যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, সত্যিই ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছি! ড্রেসিংরুমে তখন রীতিমতো ভয় ধরতে শুরু করেছে, তাহলে কি জাতীয় লিগটা শেষপর্যন্ত হাতছাড়া হবে? শেষমেশ কি তীরে এসে তরী ডুববে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঘরের মাঠে চার্চিল নামবে। পুরো সমর্থন ওদের দিকে। তার ওপর সবচেয়ে যেটা সমস্যা, তা হল আমাদের অ্যামাউরির লাল কার্ড দেখা। সালগাঁওকরের বিরুদ্ধে একটা বাজে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেছিল অ্যামাউরি। ফলে শেষ ম্যাচে চার্চিলের বিরুদ্ধে ওকে মাঠে নামানো যাবে না। ওদিকে, চার্চিলের স্ট্রাইকার ইয়াকুবু তখন মারাত্মক ফর্মে। যে কোনও ডিফেন্ডারকে হেলায় কাটিয়ে নিয়ে গিয়ে গোল করে দিচ্ছে।
ভাবুন একবার। ওদের মাঠ। ওদের সমর্থক। প্রতিপক্ষ দলে স্ট্রাইকার ইয়াকুবু। আর আমাদের দলের এক নম্বর স্টপারই ম্যাচটা খেলতে পারবে না। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য চার্চিলের শুধু মাত্র একটা ড্র। আর আমাদের ম্যাচটা জিততেই হবে। আমাদের মাথায় তখন সবচেয়ে বড় চিন্তা চার্চিলের বিরুদ্ধে স্টপারে কে খেলবে? কে আটকাবে বিধ্বংসী ফর্মের ইয়াকুবুকে?
রাতে হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে এল দেবাশিস। বলল, কোচ সুব্রত শেষ ম্যাচ খেলার জন্য কলকাতা থেকে বাঘা দা-কে (সত্যব্রত ভৌমিক) উড়িয়ে আনতে চাইছে। একটু আগেই দেবাশিসকে বলেছে ব্যবস্থা করতে। এদিকে, আমি আর দেবাশিস দু’জনেই বুঝতে পারছি, শেষ ম্যাচে বাঘাদা স্টপারে খেললে ইয়াকুবুকে আটকানোর সম্ভাবনা কম। কারণ, গোয়ায় ম্যাচ খেলার জন্য আমরা যখন কলকাতা ছাড়ি, তখনই দেখেছিলাম, বাঘাদা-র পায়ে একটা চোট রয়েছে। আমাদের সঙ্গে ঠিকভাবে প্র্যাকটিসও করতে পারেনি। ফলে বাঘাদাকে এই সময় উড়িয়ে আনলে ম্যাচটা নির্ঘাত বের করে নিয়ে যাবে ইযাকুবু। কিন্তু উপায়? আমি আর দেবাশিস দু’জনেই বুঝতে পারছি, জাতীয় লিগটা আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে যা করার সেদিন রাতেই করতে হবে। দেবাশিস আমাকে পরামর্শ দিল, সুব্রতর ঘরে গিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝাতে। বাঘাকে আনলে আমরা যে সমস্যায় পড়তে পারি, সেটা বুঝিয়ে বলতে। কারণ, সেই সময় একমাত্র আমি বললেই সুব্রত শুনতে পারে। নাহলে কোচ কারও কথা শুনবেন না। আর কোচকে এই সিদ্ধান্তর কথা বলবে, সেটাও কেউ রাজি হবে না। ফলে ঠিক করলাম, সুব্রতর ঘরে যাব। বলব, বাঘাদাকে শেষ ম্যাচে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করতে।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব