ছুটির দিনগুলোয় বা কলেজের পরে ফুরসত পেলেই গিয়ে হাজির হতাম কালীঘাটে। চুটিয়ে আঁকতাম দেহাতি ভক্তের দল, সার সার পেঁড়া, ফুল, ঠাকুর-দেবতার ছবি আর ডালার দোকান, পান্ডাদের হুড়োহুড়ি, যত্রতত্র ছোট-বড় মন্দির, আধমজা খাল। দুঃখের কথা, সেইসব কাজ বহুকাল আগেই হারিয়ে গিয়েছে। আঁকা ও লেখায় দেবাশীষ দেব।
১
দীর্ঘ ৪৫ বছর বাদে, ছবি আঁকব বলে আবার গিয়ে হাজির হলাম কালীঘাটের মন্দির চত্বরে। ১৯৭০-এর দশকে যখন আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলাম আউটডোর স্কেচিংটা নিয়মিতভাবে করতে হত, আর প্রথম থেকেই এই জায়গাটা হয়ে উঠেছিল আমার প্রিয় হান্টিং গ্রাউন্ড। আঁকার সাবজেক্ট হিসেবে কত বিচিত্র রকমের মানুষ, চূড়ান্ত ভিড়ভাট্টা, গমগমে দোকান-বাজার– এইসব খুব পছন্দ করতাম। কালীঘাট আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরেও নয়, ফলে ছুটির দিনগুলোয় বা কলেজের পরে ফুরসত পেলেই গিয়ে হাজির হতাম। আর চুটিয়ে আঁকতাম দেহাতি ভক্তের দল, সার সার পেঁড়া, ফুল, ঠাকুর-দেবতার ছবি আর ডালার দোকান, পান্ডাদের হুড়োহুড়ি, যত্রতত্র ছোট-বড় মন্দির, আধমজা খাল। দুঃখের কথা, সেইসব কাজ বহুকাল আগেই হারিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: আমার ছবি আঁকার ভিডিও করতে গিয়ে একজন কেভেন্টার্সের ছাদ থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন!
যাই হোক, এরপর যখন চাকরিজীবন শুরু করলাম অবস্থাটা পাল্টে গেল। তখন এইভাবে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকেছি শুধুমাত্র বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে, আর বরাবর এড়িয়ে গিয়েছি নিজের শহরকে। এতদিন বাদে হঠাৎ কালীঘাট আমাকে নতুন করে টানল, পরপর ক’দিন গেলাম, বেশ কিছু স্কেচ তো হলই এছাড়া অলসভাবে ঘুরে বেড়ালাম এদিক-ওদিক, ভাব জমালাম বিশালবপু ফুলওয়ালি মায়াদির সঙ্গে, ভাত, রুটি তরকার হোটেল চালায় মোহনদাস, ওর কাছ থেকে জেনে নিলাম মেটে গলির ইতিহাস, মন্দিরে ঢোকার মুখে সানাইয়ের সুর শুনে ছোট্ট ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখা পেলাম তরুণ এক সানাইবাদকের, সোয়াশো বছরের প্রাচীন মিষ্টির দোকান হারাণ মাঝির চ্যাপ্টা রসগোল্লা আর তোতা পুলি খেয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করলাম। স্কাইওয়াকের মতো আধুনিক ব্যাপারস্যাপার এখানে জোরকদমে তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মূল জায়গা আর মানুষগুলো তেমন পাল্টেছে বলে মনে হল না, সাবেক কলকাতার এই গন্ধটা টিকে থাকলেই বোধহয় ভাল।
দু’জন মানুষ– একজন রাষ্ট্রের প্রধান, আর একজন বিজনেস টাইকুন– যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত নন, তাঁদের সিদ্ধান্তে গত দু’-তিন সপ্তাহে এত মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে, এত সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, হিসাব রাখা যাচ্ছে না।