আমার পেইন্টিং করতে ভালো না লাগলে, ভাস্কর্যের কাছে গিয়েছি। ভাস্কর্য করতে ভালো না লাগলে নিউ মিডিয়া আর্ট করেছি। স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল করেছি, বডি পেইন্টিং করেছি। ঘুরে এসেছি শিল্প নামের মৃত্যুহীন গাছটির নানা শাখাপ্রশাখায়। গাছ আমার ওই একটাই। সারাজীবন সেখানে জল দিয়ে চলেছি। ফল খেয়েছি, ফুলের গন্ধ শুঁকেছি প্রাণভরে। নানা শাখায় উঠে বসেছি। সেই গাছের ছায়ায় আমি বসে থেকেছি দিনের পর দিন।
১০.
একই পথে হাঁটতে ইচ্ছে করে না। একই রাস্তায় ক্ষয়ে যাক সুকতলা, চাই না। একই রকম জিনিস, ক্রমাগত করে যেতে ইচ্ছে করে না। তা গতানুগতিক সাফল্য দিলেও না। এক জিনিস নিরন্তর করে যাওয়ায় এক ধরনের অশান্তি হয়। শিল্পের অশান্তি। শিল্প তো রোজ বদলে বদলে যাবে। দেশে-বিদেশে-পৃথিবীতে-মহাপৃথিবীতেও। সেখানে দিনের পর দিন, একই কাজ, ক্রিয়েটিভ কাজ করে যাব কেন?
আমার সে কারণেই সরে আসা দুর্গাপুজো শিল্পের থেকে। মানসিক দিক থেকে বা শারীরিক দিক থেকেও মনে হয় পেরে উঠব না। এত উন্নতমানের পুজো হচ্ছে এখন, তার এত শিল্পীত ধরন, এত রকমের আঙ্গিক– তার সঙ্গে হয়তো পাল্লা দিয়ে উঠতে পারব না। ফিরে আসব পুজোয়, কিন্তু তৈরি হয়ে। নতুন দিনের, নতুন শিল্পভাবনার বাতাস গায়ে লাগাব আবার। সেজন্য আত্মপ্রস্তুতি দরকার। আমার এই ৫০-৫১ বছরের জীবনে একই রকম, একই ধারার কাজ অনবরত করে গিয়েছি– তা নয়। আমার পেইন্টিং করতে ভালো না লাগলে, ভাস্কর্যের কাছে গিয়েছি। ভাস্কর্য করতে ভালো না লাগলে নিউ মিডিয়া আর্ট করেছি। স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল করেছি, বডি পেইন্টিং করেছি। ঘুরে এসেছি শিল্প নামের মৃত্যুহীন গাছটির নানা শাখাপ্রশাখায়। গাছ আমার ওই একটাই। সারাজীবন সেখানে জল দিয়ে চলেছি। ফল খেয়েছি, ফুলের গন্ধ শুঁকেছি প্রাণভরে। নানা শাখায় উঠে বসেছি। সেই গাছের ছায়ায় আমি বসে থেকেছি দিনের পর দিন।
আসলে আমার গন্তব্য একটাই। শিল্পের পথ। হাঁটা শুরু করেছি। কোথায় গিয়ে থামব জানি না। আসলে হাঁটাটাই শিল্প। গন্তব্য তো একটা বিন্দু। সেখানে পৌঁছে গেলে তবে কি গন্তব্য শেষ? না, আবার নতুন একটা গন্তব্য তৈরি হয়ে যায়। আজ দুর্গাপুজো শিল্পের দিকে মাথা দিচ্ছি না, কারণ আমি চাইছি না। আমি একটু হাওয়া বদল চাই। অনেক দিন হোয়াইট কিউবের কাছে বসিনি। ক্যানভাসের চ্যালেঞ্জটা দারুণ। আমি বারবার শিল্পমাধ্যম ছেড়েছি, আবার ফিরেও এসেছি তাতে। অনেকবারই পুরনো যে ছবি, তা আবার কারেকশন করেছি।
মনে পড়ে যায়, সের্গেই বুবকার কথা। আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। বুবকাও বহুবার নিজের পুরনো লেখালিখির কাছে ফিরে এসেছেন। সেই ফিরে আসা, সময়ের বিরতি মেনে, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে, সময়কে আরও নিজের মধ্যে ধারণ করে, আধুনিক হয়ে ফিরে আসা। আমি সেই ফিরে আসায় বিশ্বাস করি। একটা ছবি কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। সময়ের পরিবর্তনে সেই ছবির পরিবর্তন ঘটানোই উচিত।
আমি এর পরের যে সিরিজ আঁকছি, সেই পথ আসলে রাজা রবি বর্মা এবং বিকাশ ভট্টাচার্যের ছেড়ে যাওয়া পথ। আজ শিল্প-ঐতিহাসিকরা অচ্ছুত করে ফেলছে এই ধরনের কাজ। মানে, ন্যাচারালিজম ও রিয়ালিজমের ধরনকে। মানে, অয়েল পেইন্টিং বা অ্যাক্রিলিক মাধ্যমকে। আমি দেখাব, এগুলোও হয়। নইলে আমার সন্তানরা কী শিখবে? আজকের আর্ট কলেজে কিছু শেখানো হয়? সন্দেহ হয়। ছাত্র তৈরি করতে পারছি কি আমরা? পারছি না। গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের কি এই অবস্থা হওয়া উচিত ছিল? তার ঐতিহ্যর কথা ভেবে দেখুন। অয়েল পেইন্টিংয়ের ক্লাস হলে, শিক্ষকরা বলেন, প্র্যাকটিস করে আসি, তারপর শেখাব। আমার জীবনে যেভাবে আমার শিক্ষকরা আছেন, সেভাবে আজ কি একজন তরুণ শিল্পী তৈরি হয়? গণেশ হালুই, বাঁধন দাস, দীপালি ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন প্রধান, দীপক মুখোপাধ্যায়, ঈশা মহম্মদ, অশেষ মিত্র এবং আরও অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাঁরা আমাদের লালন-পালন করতেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মনে পড়ে যায়, সের্গেই বুবকার কথা। আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। বুবকাও বহুবার নিজের পুরনো লেখালিখির কাছে ফিরে এসেছেন। সেই ফিরে আসা, সময়ের বিরতি মেনে, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে, সময়কে আরও নিজের মধ্যে ধারণ করে, আধুনিক হয়ে ফিরে আসা। আমি সেই ফিরে আসায় বিশ্বাস করি। একটা ছবি কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। সময়ের পরিবর্তনে সেই ছবির পরিবর্তন ঘটানোই উচিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কীরকম লালন-পালন? শুনুন তাহলে…
কলেজের থার্ড ইয়ারে বাড়ির অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই কলেজ ছেড়েছিলাম। যাইনি একমাস। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বাড়ির রোয়াকে বসে রয়েছি, হঠাৎ দূর থেকে দেখি, একজন প্যান্ট শার্ট পরা, আরেকজন মস্তানের মতো আমার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। হাতে জ্বলছে সিগারেট। আমি পালাব পালাব করছি, ওঁরা বললেন, ‘অ্যাই কোথায় যাচ্ছিস? চল, গঙ্গার ধারে চল!’ ওঁরা ছিলেন গণেশ হালুই আর বাঁধনদা। গণেশ হালুই বেশি কিছু বলেননি। বাঁধনদা বললেন, ‘কাল থেকে কলেজ আসবি। তোর ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। পল্টুকে বলে দেব, তোর রং বা ক্যানভাস যা লাগবে ওর থেকে নিয়ে নিবি। আমরা টাকা দিয়ে দেব।’
কী যে পরম পাওনা। আজ মনে হয়, মাস্টারমশাইরা আর সংকল্প করেন না। কে.জি. সুব্রহ্মণ্যম কিংবা নন্দলাল বসু কিংবা বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো এখন কাউকে পাওয়া যাবে? বিকাশ ভট্টাচার্যর সরাসরি ছাত্র আমি নই। কিন্তু ওঁর কাছে গিয়ে কাজ করেছি, ওঁর কাজ দেখে ছবি আঁকা শিখেছি। এখনও কোনও সমস্যা হলে দীপালীদিকে ফোন করি। ওঁকে আমি ‘মা’ বলে ডাকি। কত স্নেহ, কত আদর, কত ভুল– শুধু ছবির নয়, জীবনের। আমাকে আমার শিক্ষকরা বলেছেন, তোর দুঃখের কথা বল, বলে হালকা হ। তাঁরা দায় নিতেন। আজ এমন কোনও শিক্ষক কি আছেন? থাকলে তাঁরাই বাংলা শিল্পজগতের টিমটিমে আশার আলো। সে আলো এসে পড়ুক আমাদের ক্যানভাসে। সেই আলোর ইতিহাস খুঁজলে আমরা ফিরে পেতে পারি ছাত্র-শিক্ষক পরম্পরা।
(চলবে)
কপিতে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী– সনাতন দিন্দা
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।