এখন ‘পাবলিক আর্ট’ বলতে আমি বুঝি দুর্গাপুজোকেই। চাঁদা তুলে পাবলিকের টাকায় শিল্প হচ্ছে! আমাদের শিল্প-ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাব যে, আমার পূর্বসূরিরা যথেষ্ট শিল্প মনোযোগী। তাঁরা নিজের মতো করে বেঁচেছেন। হয় বিখ্যাত হয়েছেন, প্রচুর রোজগার করেছেন। নয়তো বিখ্যাত হননি, রোজগার কম করেছেন। শেষমেশ এই দু’ধরনের শিল্পীরাই কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাধারণের সঙ্গে শিল্পের যে সাঁকো– তা গড়ে তুলতে পারেননি। ধরুন, যামিনী রায়। নিঃসন্দেহে বিরাট শিল্পী। তাঁর কাজ ভারতীয় কেন, বিশ্বের নিরিখে যে শিল্প-ইতিহাস, তাকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কি শিল্পমনস্ক হয়েছে?
৫.
ছবি এঁকে চলেছিলাম আমি। নিজের মতো করে। নতুন পথের সন্ধানে। কলকাতা, কলকাতার বাইরের নানা প্রদেশ, এমনকী, বিদেশেও টুকটুক করে আমার ছবির কথা কেউ কেউ জানেন। কিন্তু আমাকে এই চেনা, তেমন করে চেনা নয়– যেমন আমি চেনাতে চেয়েছিলাম নিজেকে। ভেতরে ভেতরে খুঁজছিলাম এক নবত্ব। নতুন কোনও প্রকাশভঙ্গি। যে ভঙ্গিতে চেনা যাবে আমাকে। যে ভঙ্গিতে আমি, জুড়ে নিতে পারব অগণন সাধারণ মানুষকে। আমি উঠে এসেছি কুমারটুলির ফুটপাথের ঘুম থেকে। আমি উঠে এসেছি ভাঙা, ফেটে যাওয়া দেওয়ালের স্মৃতি নিয়ে। সেই স্মৃতি আমাকে জুড়ে থাকার কথা বলে। বলে, সাধারণ হতে। সেই সাধারণের পথ– শিল্প ও আমআদমির যোগাযোগের সেতু আমি পাব কোথা থেকে?
’৯৭ সাল। দেখলাম আমারই বন্ধু লাল্টু, দুগ্গা পুজো করল তোড়জোর করে। ‘এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান’ও সে বছর পেল ও-ই। তখন ‘এশিয়ান পেইন্টস’ খায় না ছাই মাথায় দেয় জানি না! বিশ্বাস করুন, আমার শারদ সম্মানে কোনও লোভ হয়নি, লোভ হল মাইকে যখন শুনতে পেলাম শিল্পীর নাম। টানা প্রায় দশ দিন ধরে ঘোষণা হয়ে চলে। শিল্পীর নাম ছড়িয়ে যায়, পুজোর এই ক’দিন। বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঢাকের আওয়াজ, পুরোহিতের কণ্ঠ, লোকজনের ভিড়, তার মধ্যেও মাঝে মাঝেই ওই মাইক জানিয়ে যায়, এবারের শিল্পী কে। মণ্ডপ নির্মাণ কীভাবে ঘটেছে। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, এই হল আমার যোগাযোগের পথ। আমার শিল্প এই আঙ্গিকে ছড়িয়ে যেতে পারে। আমি তখন আরও বুঝতে পারলাম, আমার শিল্পের সঙ্গে সাধারণের যোগাযোগ ছিল খুব কম। শিল্পকে সাধারণের থেকে আমরা দূরে রাখি সবসময়ই। আমদর্শকের দু’চোখের থেকে দূরের কোনও গ্রহে রেখে আসি যেন। তারপর বুদ্ধিমান বিবেচক শিল্পতাত্ত্বিকের পোশাক পরে নিই। এই দূরত্বে শিল্পের কোনও লাভ হয়নি কোনও দিন।
এখন ‘পাবলিক আর্ট’ বলতে আমি বুঝি দুর্গাপুজোকেই। চাঁদা তুলে পাবলিকের টাকায় শিল্প হচ্ছে! আমাদের শিল্প-ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাব যে, আমার পূর্বসূরিরা যথেষ্ট শিল্প মনোযোগী। তাঁরা নিজের মতো করে বেঁচেছেন। হয় বিখ্যাত হয়েছেন, প্রচুর রোজগার করেছেন। নয়তো বিখ্যাত হননি, রোজগার কম করেছেন। শেষমেশ এই দু’ধরনের শিল্পীরাই কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাধারণের সঙ্গে শিল্পের যে সাঁকো– তা গড়ে তুলতে পারেননি। ধরুন, যামিনী রায়। নিঃসন্দেহে বিরাট শিল্পী। তাঁর কাজ ভারতীয় কেন, বিশ্বের নিরিখে যে শিল্প-ইতিহাস, তাকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কি শিল্পমনস্ক হয়েছে? বোদ্ধারা এক্ষুনি হয়তো চেপে ধরবেন আমাকে, আপনি এ ব্যাপারে কথা বলার কে? কিন্তু আমি বলতে চাই এটাই। আমার মনে হয় এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে যাওয়া এই সময় অতি জরুরি। কালীঘাটের পট, বাংলার পট নিয়ে যামিনী রায় যে কাজ করেছেন, তা অসামান্য– কিন্তু এ নিয়ে তারপর কাজ হয়েছে কি? একের পর এক নকল হয়েছে। নির্ভুল নকল করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাটিক করা হচ্ছে, দেওয়ালে ঝোলানো হচ্ছে ছবি, কিন্তু তাতে শিল্পের কী ছাই হল?
তাহলে কেউ কি ভাবাননি আমাকে? কেউই গড়ে তোলেননি যোগাযোগ?
না, তা নয়। আমার মতে, সাধারণকে ভাবিয়েছেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোর, রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী, প্রমুখ। মানুষের কাছাকাছি এসে মানুষের কথা বলেছেন। আমি শুধু আমার মতো করে এই পথের পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছি।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
প্রথম পর্ব: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত
দ্বিতীয় পর্ব: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
তৃতীয় পর্ব: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
চতুর্থ পর্ব: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না