অনেকেই কথা বলছেন দুর্গাপুজো নিয়ে, কেন হবে এই পরিস্থিতির পর, তা নিয়েও। আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম আমি কাজ না করলে, আমার মতো আরও অনেক প্রতিমাশিল্পী কাজ না করলে, বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবেন। আমি চাই উৎসবটা হোক, এর মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ হোক। উৎসব তো শুধু ফুর্তির জন্য না। উৎসবের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, আমাদের চিন্তা জুড়ে থাকে। আমার দুর্গার মধ্যে এবার বিষণ্ণতার সুর থাকবে। এই ২৫-২৬ বছর আমার দুর্গা অস্ত্র প্রায় ধরেইনি। খুব সিম্বলিক পদ্ধতিতে কখনও ব্যবহার করেছি সেই অস্ত্রকে। কিন্তু এবার, সরাসরি আমার দুর্গা অস্ত্র ধরবে। কারণ এখন দরকার আছে। কিন্তু তাতে কি বদলে যাবে খুব? শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা করে এই পৃথিবীটা কতদূর বদলেছে? কয়েকটা মানুষ বদলায়, অন্যরকম হয়ে যায়, কিন্তু এই নীল রঙের গ্রহখানা?
২০.
কোনও কাজেই মন দিতে পারছি না। আগেও কত দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমি, যৌথভাবে আমরা। কিন্তু তারপরও দৈনন্দিন কাজের কি খুব বদল ঘটেছিল কোনও? মনে পড়ছে না। রোজকার রুটিনে তার প্রভাব ছিল সামান্যই। প্রতিবাদ হয়তো ছিল। কিন্তু এভাবে ছিল না। স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারছি না। কাজ করতে পারছিই না সেভাবে। একজন শিল্পী হিসেবে আমার যা কাজ, ছবি আঁকা– সে এখন বহু দূরের বস্তু। শিল্পীরা সম্প্রতি একটা মিছিল করলেন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, এমনকী, সেখানে গিয়েও নিথর হয়ে বাইরে চার-পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলাম। জমায়েতে ঢুকে যেতে পারিনি। তুলি দিয়ে একটা প্রতিবাদী আঁচড়ও টানতে পারিনি। মনে হচ্ছে, যে, তুলির আঁচড়, কবিতার ভাষা, সাহিত্যের ভাষা– সবই ফেল করেছে এই প্রতিবাদে। একমাত্র, একমাত্র রাস্তায় নেমে চিৎকার করলে খানিক শান্তি পাব হয়তো।
২০১১ সালে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তো ছিলাম। রাস্তাতেই ছিলাম। তিনমাস। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের একত্র করেছিলাম। দিনের পর নানা জায়গায় যাওয়া বক্তৃতা দেওয়া। তখন একটা সামাজিক দায় ছিল। সামাজিক পট পরিবর্তন করার দায়। আজও এক কন্যাসম, তাঁর ধর্ষণের জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাদ যাচ্ছেন না।
দুর্গার ড্রয়িং এবারেও করে রেখেছিলাম। আমারই মেয়ের সঙ্গে বসে। পরিকল্পনা করে। ও বলল, ‘বাবা, অনেক দিন তো হল, ২৫-২৬ বছর ধরে, এবার অন্যরকম কিছু করো না।’ আমি করছিলাম স্কেচটা। ওর পছন্দ হল খুব। আজ সেই কাজটা করতে গিয়ে আমূল পরিবর্তন করতে হবে, জানি। কারণ এখন একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমার দুর্গাও বদলে গিয়েছে। উওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট আর দুর্গার সম্পর্ক কি নিছকই রূপক? আমি যে কাজ করছি এবারে ভবানীপুরে, আগেই ভেবেছিলাম তিলোত্তমা নিয়ে কাজ করব। এই তিলোত্তমা আমাদের এখনকার তিলোত্তমা না, এই তিলোত্তমা জীবনানন্দর। ‘সুচেতনা’ কবিতায় ছিল তা। ওদের হোর্ডিংয়ে তুলে দিয়েছিলাম জীবনানন্দর লেখা: ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;/ তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়’। আজ বলতে লজ্জা লাগছে, হৃদয়?
তারপরও আমরা আশাবাদী। পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের পরও। অনেকেই কথা বলছেন দুর্গাপুজো নিয়ে, কেন হবে এই পরিস্থিতির পর, তা নিয়েও। আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম আমি কাজ না করলে, আমার মতো আরও অনেক প্রতিমাশিল্পী কাজ না করলে, বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবেন। আমি চাই উৎসবটা হোক, এর মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ হোক। উৎসব তো শুধু ফুর্তির জন্য না। উৎসবের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, আমাদের চিন্তা জুড়ে থাকে। আমার দুর্গার মধ্যে এবার বিষণ্ণতার সুর থাকবে। এই ২৫-২৬ বছর আমার দুর্গা অস্ত্র প্রায় ধরেইনি। খুব সিম্বলিক পদ্ধতিতে কখনও ব্যবহার করেছি সেই অস্ত্রকে। কিন্তু এবার, সরাসরি আমার দুর্গা অস্ত্র ধরবে। কারণ এখন দরকার আছে। কিন্তু তাতে কি বদলে যাবে খুব? শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা করে এই পৃথিবীটা কতদূর বদলেছে? কয়েকটা মানুষ বদলায়, অন্যরকম হয়ে যায়, কিন্তু এই নীল রঙের গ্রহখানা?
পুজোর কাজ প্রতি বছর শুরু করি আনন্দে। আজকে কাজ শুরু করতে গিয়ে হাত-পা কাঁপছে। অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। মনকে বোঝাতে পারছি না, আমি কী করতে চলেছি। এ বছর প্রথম আমি কাজ করতে গিয়ে কনফিউজড। যাঁরা সচেতন মানুষ, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের দৈনন্দিন যাপনে একটা দ্বিধাবোধ হয়তো তৈরি হয়েছে। আনন্দ করায়, আড্ডা দেওয়ায়, রোজের আরাম-বিলাসে।
আমার মেয়ে বাড়িতে বসে রয়েছে। আমিও। দু’জনে কথা বললেই আলোচনা শুধুই এই ঘটনায় এসে পড়ছে। এমনভাবেই বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে ভাবা যায় না। মেয়ে আজ বলেছে, ‘দুর্গার হাসিমুখ রেখো না আর।’ আমি বলেছি, ‘হ্যাঁ মা, রাখব না আর। হাসিতে রাখব তাচ্ছিল্য আর চোখে ভয়ংকর রাগ থাকবে।’
এখন আমি কোনও শান্তির বার্তা দিতে চাই না। কীসের শান্তি? এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, মেয়েদেরকেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারাই তাদের কথা বলবে। দুর্গা এমন একটা মেয়ে যার কোনও শৈশব নেই, পুরুষরা তাদের নিজের কাজ চরিতার্থ করতে গিয়েছে তৈরি করেছে এই মেয়েটিকে। ষোড়শী সুন্দরীকে তৈরি করেছে যজ্ঞের আগুন থেকে। তাকে পুরুষরা শক্তিশালী করছে। পুরুষদের দম্ভটা বুঝুন পাঠক। দশটা পুরুষ দেবতা কিছু পারেনি কিন্তু! অসুররূপী সেই মহামানবকে পরাস্ত করল মেয়েটিই। তাকে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে। দ্রৌপদীকে দেখুন– তারও শৈশব নেই। যাজ্ঞসেনী অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। চাও বা না-চাও বিবস্ত্র হতে হচ্ছে। ব্যাসমুনির সময় থেকে আজকে বিল গেটসের রাজপথ– মেয়েদের পরিস্থিতি কিছু কি বদলেছে? শুধুই অনেক শকুনি, ধৃতরাষ্ট্র আর পঞ্চপাণ্ডব হাজির।
আজ আমরা একটা মানবিক জায়গা দেখতে পাচ্ছি। এইটাই হয়তো আমাদের সবথেকে আশ্বাসের জায়গা। এক শিক্ষকের স্বরূপ আমরা জানতে পারলাম এই নৃশংস ঘটনার পরে। সকলে তোল্লাই দিয়েছে তাকে। কেউ কিছু জানত না? হতে পারে?
এই সমস্ত প্রশ্ন ঘুরে বেড়াক। রাস্তায়। চিৎকারে। নইলে আমাদের ছবি অসফল। আমাদের কবিতা অসফল। আমাদের প্রতিবাদ অসফল রয়ে যাবে।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৮: এখনও ভয় হয়, আমার তৈরি দুর্গাপ্রতিমা মানুষ ভালোবাসবেন তো?
পর্ব ১৭: পুজোসংখ্যার প্রচ্ছদে দুর্গা থাকতেই হবে, এটাও একধরনের ফ্যাসিজম
পর্ব ১৬: সাধারণ মানুষের কাছেই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত