সীতাকে বাদ দিয়ে ভারতের সংস্কৃতি চলে? রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কথা, পুজোআচ্চা– সবই চলছে, কিন্তু সেই সখী– বৃন্দাদ্যুতির কথা বলবে না কেউ? যে কৃষ্ণকে এত ভালোবেসেছিল? তাঁকে উপেক্ষা করাই কি সমাজের কাজ? সবাই যদি মহামানবদের নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সমাজের আঁতের কথা কে বলবে? কে পৌঁছবে সেই সাধারণতম অনুভূতিগুলোয়?
১৫.
একটা মেয়ে– তার দশটা হাত। এটা কি সাররিয়াল নয়? আজগুবি বলছি না, বলছি ‘সাররিয়াল’। আজ দুর্গার রেফারেন্স বাদ দিয়ে কোনও সিনেমায়, বা পেইন্টিংয়ে যদি এমন করা হত, মনে হত সেকথা? দুর্গার রূপ আমাদের সঙ্গে এমন লৌকিকতায়, বিশ্বাসে মিশে আছে যে, এই সাররিয়ালিটি আমাদের সচরাচর চোখে পড়ে না। ভালো করে ভেবে দেখবেন, গোটা পরিবারই কিন্তু এই সাররিয়ালের অংশ। মজাটা যদিও এখানেই লুকিয়ে, তা নয়।
মজাটা এইখানে যে, এত আশ্চর্যজনক ব্যাপারস্যাপার সত্ত্বেও, সেই মেয়েকে একটা মানুষ হিসেবে, আমাদেরই কাছের মেয়ে হিসেবে, ঘরের মা হিসেবে, আমরা লোকায়ত করে রেখেছি। সত্যজিৎ যা করেছিলেন ‘দেবী’তে। এখানেই বিপুল বিস্ময়ের জাগে আমার, যে, আমরা অবিশ্বাস করছি না। আমরা মেনে নিচ্ছি এই ব্যাপারটাকে। তা মেনে নিচ্ছি, কারণ শিল্প আমাদের সেই বিশ্বাসের ক্ষমতা, সেই অকল্পনীয় চিন্তার ঔদার্য দিয়েছে। এই ঔদার্য থেকে আমরা, সম্ভবত গোটা ভারত বিচ্ছিন্ন হতে চায় না এখনও। কোনও রাজনৈতিক দল এসে এই চিন্তনের ধারা ভারতের শিকড় থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে না। বিদেশে কি এমন আছে? নেই। আবার, শুধুই কি মেয়ের বেলাতেই এই অপরূপ? তাও তো নয়। মনে করে দেখুন, আমাদের এখানে কি এমন কোনও চরিত্র নেই, যার দশটা মাথা? রাবণ! এগুলোই দিনের পর দিন শিল্পে ঢুকে গিয়েছে। সেই শিল্প ক্যানভাসে দেখলে আমরা না বোঝার ভান করছি, আর দুর্গাপুজোয় দেখলে প্রণাম করছি না তো?
গুহামানব, আমি বলি ‘মহামানব’, তাঁদের যে সমস্ত ছবি এখনও বেঁচে রয়েছে, দেখুন। তা শিকারের ছবি, জীবনযাত্রার ছবি। মানুষের অস্তিত্ব চেনার ছবি। মানবতার ছাপ। বেঁচে রয়েছে এখনও আলতামিরা। কিন্তু এর বাইরে? খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধদের যে ধর্মের সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগ, তাই তো আমার মনে হয় ঈশ্বর চর্চার দিকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেবলই একপাক্ষিক হতে পারে না শিল্প। শিল্প সবসময়ই মুক্ত চোখে দেখতে শেখায়। রাষ্ট্র যদি রামের কথা নিরন্তর বলে যায়, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা। এ সময় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের কী অধিকার আছে যে, শুধু রামের মন্দির নির্মাণ করবে? যেখানে সীতার ঠাঁই নেই? ভারতের মতো বিশাল প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা আমরা জানি। শিল্পীর দায় সীতাদের কথা বলা। সীতাদের পুরুষশাসিত সমাজ বারবার উপেক্ষা করেছে, কাছে টেনেছে নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে ব্যবহার করতে। বারবার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে বাধ্য করেছে। সীতাকে বাদ দিয়ে ভারতের সংস্কৃতি চলে? রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কথা, পুজোআচ্চা– সবই চলছে, কিন্তু সেই সখী– বৃন্দাদ্যুতির কথা বলবে না কেউ? যে কৃষ্ণকে এত ভালোবেসেছিল? তাঁকে উপেক্ষা করাই কি সমাজের কাজ? সবাই যদি মহামানবদের নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সমাজের আঁতের কথা কে বলবে? কে পৌঁছবে সেই সাধারণতম অনুভূতিগুলোয়?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, পাশ্চাত্যে একের পর এক হিরো এসেছে। আমেরিকায় সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান। ইউরোপ পেরেছে তাদের নিজেদের হিরোদের বাঁচিয়ে রাখতে, লেনিন, চে গেভারাদের। কিন্তু আমাদের হিরোদের দেখুন। আমাদের স্মরণীয়-বরণীয় যাঁরা, তাঁদের আমরা সঠিকভাবে গ্রহণ করিনি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, মাতঙ্গিনী হাজরা– আমাদের কাছে প্রণম্য, অথচ বাংলার বাইরে গেলে ওঁদের কতজন চেনে? নারায়ণ দেবনাথ যে বাঁটুল দি গ্রেট আঁকলেন, তা তো আমাদের আঞ্চলিকতার মধ্যেই বহুদিন আটকা পড়ে থাকত। কয়েক বছর আগে তা অনূদিত হয়েও কি তেমন সর্বভারতীয় হতে পেরেছে? রক্তমাংসের মহামানবদের আমরা রক্ষা করতে পারিনি। সেই না-পারার জন্যই পুরাণ থেকে এই অতিলৌকিক হিরোদের টেনে আনা হচ্ছে। হিরো ওয়ারশিপ চলছে।
অথচ উচিত ছিল আমাদের নিজস্ব পথে হাঁটা। যে পথ বাংলার বিপ্লবীদের, মনীষীদের, শিল্পীদের। সংস্কৃতি কি শুধুই পাড়ার মাচায় আর রবীন্দ্রসদনে হয়? যুদ্ধের সংস্কৃতি, রাস্তায় নেমে বিপ্লবের সংস্কৃতি কি সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? কোনও তারিখে এই পথ দুটো আলাদা হয়ে গিয়েছে, আমরা জানতে পারিনি। একদল বিপ্লব করবে আর একদল শুধুই শিল্প করবে গজদন্তমিনারে বসে– অদূর অতীতেও কি এই দেওয়াল তৈরি হয়েছিল?
এই দুটো দলকে এক করতে পারিনি বলেই, ‘বিপ্লব একদিন আসবে’ বলে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়েছি আমরা। মেনে নিতে হবে, আমরা অসফল বলেই পুরাণ থেকে টেনে আনা হয় আমাদের অলৌকিক হিরো। পুরাণের চরিত্রকে ইতিহাসের চরিত্র করে দেওয়ার মতলব আঁটে রাষ্ট্র, তা খানিক সাফল্যও পায়। হায়!
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
(চলবে)
লেখায় সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই সনাতন দিন্দার।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত