আমি চেয়েছিলাম যতই বিবর্তন ঘটুক দুর্গাপুজোর এই বাংলার সংস্কৃতিগুলো যাতে হারিয়ে না যায়। সত্যি বলতে কী, চারপাশ এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, সেখানে পুজো যে একেবারে সাবেকি– আগের মতোই হবে, এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু তাতে কোনও ইতিহাসের ছাপই থাকবে না, তা বিস্ময়কর। লক্ষ করে দেখবেন, প্রতিমার মুখের মধ্যে চলে আসছে কমিকসের ছাপ। চোখগুলো গোল গোল, মিকি মাউসের ধরনেও দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের যে আন্তরিক সরলতা, ঘরের মেয়ের যে ছাপ, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না আর।
৪.
গতবার দৌড়েছিলাম কাশী মিত্র ঘাট থেকে। বাবাকে দেখে। আপনারাও কি দৌড়েছিলেন আমার পিছন পিছন? আমি তখন বালকবয়সি। আমার বাবা এসে পড়ার অনেক আগেই সেই দৌড়। এখন মনে হয় দূরের যা কিছু, অনেক সহজে দেখতে পেতাম সেই ছেলেবেলায়। যদিও এখনও দেখতে পাই, আমার বাবা নেমে গেলেন ঘাট থেকে গঙ্গায়। তুলে আনলেন গঙ্গার মাটি। সে মাটি দিয়ে কোনও মূর্তি গড়বেন না বাবা। আমি জানি কী করবেন। আমাদের মাটির বাড়ির যে ফাটল, সেই ফাটলে লাগাবেন। গোবর দিয়ে মেখে। কারণ সিমেন্ট কেনার পয়সা ছিল না। সেই মাটির দেওয়ালেই আমি শ্রী শ্রী দুর্গাপুজো লিখেছিলাম। আলতা দিয়ে। লিখেছিলাম ছোট করে। তা অনেক বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেওয়ালে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৯৯৮ সালে দুর্গাপুজো করতে এসেই আমি নিজেই তো ভেঙে দিয়েছিলাম অসুরবিনাশিনীর রূপকে। রাগী, প্রবল কর্তৃত্বময়ী দুর্গার যে গপ্পগাছা সে তো বহু হল এই ভেবে আমি নিয়ে এসেছিলাম মুকুন্দরামের দুর্গাকে। আমাদের পা-ফেলা যে মাটি, সেই মাটির ওপরই যেন দাঁড়িয়েছিল সেই দুর্গাপ্রতিমা। একেবারে ঘরের মেয়ে। সেখানে কোনও এলিটিজম নেই। কাঠের ঘোড়ায় লাল আটপৌরে শাড়ি পরে সেই দেবী কোলে বসিয়েছিলাম গণেশকে। গায়ত্রী মন্ত্র জপের মুদ্রা দিয়েছিলাম ৮ হাতে, আর দু’হাতে গণেশকে ধরে আছেন। আমার দুর্গাপুজোর গুরু অশোক গুপ্তর প্রভাব ছিল এতে। লম্বা আঙুলের ওই দুর্গার ধরন আমি দেখেছিলাম ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সেই ছেলেবেলাতেই আমি আঁকতে শুরু করেছিলাম দেবীঘট। বাড়িওয়ালা বাদলচন্দ্র পাল, আমার গুরুর বাড়িতেই। মনে আছে, দুর্গাপুজোর আগে প্রচুর ঘট আঁকতাম। তার একটা কারণ যদি ছবি আঁকতে ভালো লাগা, আরেকটা কারণ অবশ্যই পেটপুজো। বিশ্বকর্মা পুজোর পরের দিন রান্নাপুজোয় পঞ্চব্যঞ্জন খাওয়াদাওয়া। ২০০০ সালে আমি দুটো দুর্গাপুজো করেছিলাম। কুমারটুলি এবং হাতিবাগান সার্বজনীন। কুমারটুলির বিষয়ই ছিল বাংলার দেবীঘট চিত্রশিল্প। আমি সেই পুরনো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলাম। আমি নিজের মতো করে গড়ে তুলেছিলাম সেটা। পুজোর সময় দেবীঘটের ভূমিকা খুব সামান্যই। সে ফুল-বেলপাতা চাপা পড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়! শিল্পটাই হারিয়ে যায়। এটার মধ্যে যে আশ্চর্য রঙের ব্যবহার, ব্রাশের ব্যবহার, গায়ে আঁকা ফুলের গড়ন, কীভাবে দুটো লাইনের ব্যবহারে গড়ে তোলা যায় দুটো অবয়ব– এইসব আমি দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। আমি চেয়েছিলাম যতই বিবর্তন ঘটুক দুর্গাপুজোর এই বাংলার সংস্কৃতিগুলো যাতে হারিয়ে না যায়। সত্যি বলতে কী, চারপাশ এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, সেখানে পুজো যে একেবারে সাবেকি– আগের মতোই হবে, এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু তাতে কোনও ইতিহাসের ছাপই থাকবে না, তা বিস্ময়কর। লক্ষ করে দেখবেন, প্রতিমার মুখের মধ্যে চলে আসছে কমিকসের ছাপ। চোখগুলো গোল গোল, মিকি মাউসের ধরনেও দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের যে আন্তরিক সরলতা, ঘরের মেয়ের যে ছাপ, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না আর।
এতে কিন্তু কোনও এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার নেই। আসলে কিছু একটা অন্যরকম করতেই হবে, ইচ্ছে হল তো দেবী দুর্গাকে বার্বি ডল বানিয়ে ফেললাম, ব্যাস! কিন্তু কেন হবে এমন? কুমোরটুলিতে একসময় একচালার মূর্তি তৈরি হত। তা ভাঙলেন গোপেশ্বর পাল। এই ভাঙাটা ঠিকঠাক এক্সপেরিমেন্ট। কারণ পুতুল পুতুল যে রূপ, তা থেকে প্রতিমা পেল মানবী রূপ। গ্রিক ও রোমান স্টাইলও এসেছে তারপর। কারিগরি জগতের উন্নতি ঘটেছে নানা সময়। কিন্তু মনে রাখবেন, গোপেশ্বর পালের এই বিবর্তনে বাংলার নিজস্ব ঘরানা মিশে ছিল। প্রথম বছর ১৯৯৮ সালে দুর্গাপুজো করতে এসেই আমি নিজেই তো ভেঙে দিয়েছিলাম অসুরবিনাশিনীর রূপকে। রাগী, প্রবল কর্তৃত্বময়ী দুর্গার যে গপ্পগাছা সে তো বহু হল এই ভেবে আমি নিয়ে এসেছিলাম মুকুন্দরামের দুর্গাকে। আমাদের পা-ফেলা যে মাটি, সেই মাটির ওপরই যেন দাঁড়িয়েছিল সেই দুর্গাপ্রতিমা। একেবারে ঘরের মেয়ে। সেখানে কোনও এলিটিজম নেই। কাঠের ঘোড়ায় লাল আটপৌরে শাড়ি পরে সেই দেবী কোলে বসিয়েছিলাম গণেশকে। গায়ত্রী মন্ত্র জপের মুদ্রা দিয়েছিলাম ৮ হাতে, আর দু’হাতে গণেশকে ধরে আছেন। আমার দুর্গাপুজোর গুরু অশোক গুপ্তর প্রভাব ছিল এতে। লম্বা আঙুলের ওই দুর্গার ধরন আমি দেখেছিলাম ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
প্রতিমা গড়তে এসেই অবশ্য এত দর্শনের কথা ভাবিনি। চেয়েছিলাম শুধু প্রতিমা আমার থেকে দূরের কেউ না হোক। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকী, আমার ঘরের যে মা, তার সঙ্গে যেন বিরাট কোনও ফারাক না থাকে। সেই দূরত্বময় প্রতিমা আমি গড়তে চাই না কোনও দিন।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
প্রথম পর্ব: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত
দ্বিতীয় পর্ব: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
তৃতীয় পর্ব: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে