কলকাতার টাউন হলে জড়ো হয়েছেন কলকাতার বেশ কিছু ভদ্রমানুষ। উদ্দেশ্য তখনকার বই, খেউড়, কবিগান, যাত্রা বা সংমিছিলের অশ্লীলতা নিবারণ। অথচ তখনকার কলকাতার সংস্কৃতিতে এই অশ্লীলতার প্রকোপ ছিলও বেশি। কিন্তু ভদ্রজনেরই বা উপায় কী? সং-রা সমাজের সব কিছু ফাঁস করে দিচ্ছে। ভদ্রবাবুদের ইংরেজের দালাল বলছে, কে গোপনে হিন্দু অথচ ভাবে ব্রাহ্ম, কে রাতের অন্ধকারে বেশ্যাবাড়ি যায়– সব কিছু ওই সংওলাদের নখদর্পণে।
প্রায় দেড়শো বছর আগেকার কথা। ১৮৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। কলকাতার টাউন হলে জড়ো হয়েছেন কলকাতার বেশ কিছু ভদ্রমানুষ। উদ্দেশ্য তখনকার বই, খেউড়, কবিগান, যাত্রা বা সংমিছিলের অশ্লীলতা নিবারণ। অথচ তখনকার কলকাতার সংস্কৃতিতে এই অশ্লীলতার প্রকোপ ছিলও বেশি। কিন্তু ভদ্রজনেরই বা উপায় কী? সং-রা সমাজের সব কিছু ফাঁস করে দিচ্ছে। ভদ্রবাবুদের ইংরেজের দালাল বলছে, কে গোপনে হিন্দু অথচ ভাবে ব্রাহ্ম, কে রাতের অন্ধকারে বেশ্যাবাড়ি যায়– সব কিছু ওই সংওয়ালাদের নখদর্পণে। লোকে ভিড় করে ওদের কথা শোনে, হাসে আর পরে আলোচনা করে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন, গাজনের মেলায়, স্নানযাত্রায় বা বারোয়ারি পুজোয় ওরা বেরিয়ে পড়ে।
রূপচাঁদ পক্ষী, রসরাজ অমৃতলাল বসুর মতো মানুষ ওদের জন্য গান লেখেন। প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালও ওদের উৎসাহ দিতেন। বিশেষভাবে তৈরি ঘোড়ার কাটরা গাড়ি বা মোষ-টানা ট্রাকে করে সঙের দল বের হত। সুদীর্ঘ হত সঙের মিছিল। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানলায় আবালবৃদ্ধবণিতা সংযাত্রা দেখতে ভিড় করত। পথের ওপর শামিয়ানাও টাঙিয়ে দেওয়া হত। সংমিছিল যেন হয়ে উঠেছিল একরকম মিলনমেলা।
সংদের এরকম আচরণে ব্রাহ্ম-ব্রাহ্মণ আর খ্রিস্টানরা তাই জোট বাঁধল। সিদ্ধান্ত নিল ঠেকাতেই হবে অশ্লীলতা! গঠন হল কমিটি। ব্রাহ্মদের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের রেগে যাওয়ার কারণ তো যথেষ্টই ছিল। নিজে ঘোষণা করেছিলেন, মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স হবে ১৪। আর তিনিই কিনা নিজের মেয়েকে বাল্যাবস্থায় বিয়ে দিলেন কোচবিহারের রাজপুত্রের সঙ্গে। সঙের দলের বুঝতে বাকি ছিল না, রাজপরিবারের সঙ্গলাভ এই বিবাহের অন্যতম কারণ। ঘটনাটি ঘিরে সঙের গান তখনকার মানুষদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। স্বনামধন্য বা প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান বা ধনী কাউকেই ছাড়ত না সং। ‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ প্রতিষ্ঠা হলে তা নিয়েও গান বেঁধেছিল সঙের দল।
‘বসন্তক’ পত্রিকায় দেখা যায়, ১৮৭৪ সালে কাঁসারীপাড়ার সঙের মিছিলে গান গাওয়া হয়েছিল–
‘শহরে এক নূতন
হুজুগ উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই
বৎসরান্তে একটি দিন
কাঁসারিরা যত
নেচেকুদে বেড়ায় সুখে
দেখে লোকে কত
যদি ইহা এত মন্দ
মনে ভেবে থাকো
নিজের মাগকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখো।’
নতুন ইঙ্গবঙ্গ যুবকরাও ছাড় পায়নি সঙের বিদ্রুপ-বাণ থেকে। দুর্নীতি আর সামাজিক অনাচারও হয়ে উঠত সঙের গানের বিষয়। তবে, কালে কালে সং জাতীয়তাবাদী ভাবধারায়ও উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাতে খুশি হয়েছিল জনসাধারণ সবাই। তবে সংদের ভাব প্রকাশে প্রায়ই ভদ্রজনের ভ্রু কুঁচকে যাওয়ার মতো কথা ও ভঙ্গির আশ্রয় নিত, যাকে তারা শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করার মতোই দোষনীয় ভাবত।
তাই ‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ হলে তার স্বেচ্ছাসেবকরা কম হয়রানি করেনি বটতলার বইয়ের ফেরিওয়ালাদের। হামলা এবং মামলাও হয়েছে অনেক। ‘তত্ত্ববোধিনী’ থেকে ‘বঙ্গদর্শন’– অনেক সাময়িকপত্রই তখন অশ্লীলতা নিবারণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
সুকুমার সেন তাঁর ‘বটতলার বই’ প্রবন্ধে বলছেন, সেকালে শোভাবাজার অঞ্চলে একটা বটগাছ ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীরা বসে বিশ্রাম নিত, আড্ডা দিত, গানবাজনা করত। বইয়ের পশরাও বসত। অনুমান করা হয়, এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা, ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন। বহুকাল পর্যন্ত এই বাঁধা বটতলাতেই উত্তর কলকাতায় পুস্তক প্রকাশকদের ঠিকানা চালু ছিল। গড়ে ওঠে ছোট সস্তার প্রেস। এখান থেকে প্রকাশিত বইগুলোকে বলা হত বটতলার পুঁথি। পাঁচালি, পঞ্জিকা, পুরাণ, লোককাহিনি ও পুঁথির সঙ্গে পরকালে হত গুপ্তকথা, রতিশাস্ত্র, যৌনতা উদ্রেগকারী প্রহসন, বেশ্যাকাহিনির মতো রগরগে বই এবং সর্বোপরি শহরের নামী পরিবার বা সমাজপতিদের পরিবারের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথাও প্রকাশিত হত পুস্তকাকারে। বটতলায় ছাপা পঞ্জিকা তখন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় ঝাঁকায় করে বিক্রি করত ফেরিওয়ালার। আর সেই পঞ্জিকার ফাঁকেই অন্তঃপুরে ঢুকে পড়ত কেচ্ছাকাহিনি। তাই তৎকালীন ভদ্রসমাজ বটতলার সাহিত্যকে ভাল চোখে দেখেনি।
বটতলার বইয়ের খ্যাতি ছিল আদিরসাত্মক বইয়ের জন্যই । তাই ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামের একটি সেন্সর বোর্ড ১৮২০ সালে চারটি আদিরসাত্মক বইকে চিহ্নিত করে, সেগুলি হল– ‘রসমঞ্জরী’, ‘রতিমঞ্জরী’, ‘আদিরস’ ও ‘শৃঙ্গারতিলক’। ১৮৫৫ সালে রেভারেন্ড জেমস লংয়ের বাংলা বইয়ের তালিকায় নাম ছিল ‘বেশ্যারহস্য’, ‘প্রেমবিলাস’, ‘রসসাগর’, ‘রতিকেলির’-ও। তিনি এগুলোকে ফরাসি সাহিত্যের কুৎসিত রূপের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বইগুলোতে উডকাট ব্লকে আঁকা ছবিও থাকত। লেখকদের মধ্যে পঞ্চানন ব্যানার্জি পরিচিত ছিলেন ‘আদিরসের শেক্সপিয়র’ বলে। ওই সময়ে আদিরসের অত চাহিদা কেন দেখা দিল?
নতুন গজিয়ে ওঠা বাবুরা সেই সময় নিত্যনতুন আদিরসের সাহিত্য খোঁজ করতেন। বেশ্যাবাড়িতে যা পাঠ করলে গা গরম হয়ে ওঠে। বাবুদের গা গরমের রসদ তখন জুগিয়েছে বটতলা। লং সাহেবের চেষ্টায় ইংরেজ সরকার ১৮৫৬ সালের জানুয়ারিতে একটি আইন প্রণয়ন করে, যাতে কুৎসিত ছবি ও শৃঙ্গাররসঘটিত পুস্তক প্রকাশ ছিল দণ্ডনীয়। আইনত ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হল। এই দেশে অশ্লীলতা নিয়ে আইন সেই প্রথম। এর পরের বছরই ইংল্যান্ডে এই আইন কার্যকর করা হল। লং-এর আবেদন অনুযায়ী তিন শীল গ্রেপ্তার হলেন। মহেশ, বিশ্বম্ভর আর মধুসূদন। প্রথম দু’জন দোষ স্বীকার করে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিয়ে রেহাই পান। তাঁরা এটাও স্বীকার করেন গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগেই সে এই ধরনের কয়েকশো বই পুড়িয়ে ফেলেছে। জীবনে আর এসব ছাপাবে না। মধুসূদনের একশো টাকা জরিমানা হয়, কারণ সে প্রকাশকের পাশাপাশি এই ধরনের বইয়ের লেখকও ছিল।
আইনের চোটে কিছুদিন চুপ ছিল বটতলা। তারপর আবার ১৮৬৩ সালে ছাপা হয় ‘লজ্জতন্নেছা’, যাতে ২৩টি উত্তেজক ছবি ছিল, বইটিও হয়েছিল ‘বেস্টসেলার’। তারপরই গঠন করা হয়েছিল ‘অশ্লীলতা নিবারণ সমিতি’। এদের স্বেচ্ছাসেবকরা ঘরে ঢুকে ঢুকে অশ্লীল বই খুঁজত, ফেরিওয়ালার ঝাঁকা নামিয়ে দেখত, অশ্লীল বই আছে কি না। কেউ রাস্তায় অশ্লীল গান করলেও তুলে দিত পুলিশের হাতে। এঁরা হানা দিতে আসছে শুনে আতঙ্কে চুঁচুড়ার প্রকাশক যদুনাথ মুখোপাধ্যায় নিজের প্রকাশনার ৮০০টি বই পুড়িয়ে ফেলেন। শেষে বটতলার প্রকাশকেরা চাঁদা তুলে উকিল নিয়োগ করলেন। মামলার ফল অবশ্য প্রকাশকদের বিপক্ষেই গিয়েছিল। তাতে সমিতির উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল দশগুণ। মামলার ফল প্রকাশকদের বিরুদ্ধেই গেল। সমিতির সদস্যরা সেই দিনই মামলার ফলে উৎসাহিত হয়ে কয়েকজন গরিব হকারকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন।
দাশরথি রায়ের পাঁচালী বন্ধ হল। ভারতচন্দ্রর নাম উচ্চারণ করলে পুলিশের কাছে জরিমানা দিতে হত। সেইরকম আলিপুরের এজলাসে এক হকারকে উপস্থিত করা হল অশ্লীল বই বিক্রির দায়ে। ডেপুটি তাঁকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে, সে আগেও একই কাজ বহুবার করে শাস্তি পেয়েছে। এক অপরাধে কতবার সে শাস্তি পাবে? ডেপুটির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিরক্ত হয়ে লোকটিকে তিনমাসের জেলের সাজা দেন। বাজেয়াপ্ত বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।
তবে তাদের বাড়াবাড়িতে একসময় লোকেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সমিতিও প্রমাদ গোনে আর উৎসাহেও ভাটা পড়ে। ব্যঙ্গ করে বলা হয়, এরা এবার বটতলার বদলে নিমতলায় গেলে ভাল করবে। নিমপাতায় স্নান করে হতে পারবে শুদ্ধ-শুভ্র। ২০২৩-এ আমাদের সমাজ আর ‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ করে না। কিন্তু ‘অশ্লীলতা’ শব্দটি কি একেবারে উবে গিয়েছে? যে কালে আমরা দেখতে পেয়েছি খালি পায়ে দীর্ঘ দীর্ঘ মাইল হেঁটে আসছে পরিযায়ী শ্রমিকের দল, যে দেশ পেয়েছে র্যাগিংয়ে এক তরুণের মৃত্যু, যে দেশে ফ্রিজে গোমাংস আছে– এই সন্দেহে এক নিরীহকে মেরে ফেলা হয়, সেই দেশ অশ্লীলতায় এখনও টগবগে। যদিও আজ তা আর কোনও যৌথ নিবারণী সভা দিয়ে মিটে যাবে না। নিজেদের প্রশ্ন করা ছাড়া, আত্মোপলব্ধি ছাড়া, দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই।