চিত্তপ্রসাদ, আপনি লিখেছিলেন আপনার সময়ের প্রেক্ষিতে ‘ছবির সংকট’ নিয়ে। আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছি আমার সময়ে দাঁড়িয়ে ‘চিত্রকরের সংকট’-টিকে নিয়েও। এই আলাপ আমার জন্য জরুরি; একইসঙ্গে আপনার কাজকে আমার সময়ে বসে দেখতে ও বুঝতে চাওয়া। সেখানে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রসঙ্গটিও নানাভাবে আমাদের আলাপকে প্ররোচিত করে। আপাত নিরিখে এই আলাপটি পাঠকের কাছে বোকামো মনে হতে পারে। আপনার কথাতে যেমন ‘ছবি জিনিসটির মধ্যে মানুষের মন বা চিত্ত থাকে তাই তার নাম চিত্র দেওয়া হয়েছে, আর সেই চিত্তকে গুছিয়ে দশজনের কাছে সহজবোধ্য করে প্রকাশ করবার উপায় শিল্পীরা গড়ে তুলতে পারেন, তাই ছবি আঁকার আর এক নাম সৃষ্টি করা। সৃষ্টি করার মূল তাগিদটা আসে চিত্তকে প্রকাশ করার ইচ্ছার মধ্যে।’ আপনার শরীরের মৃত্যু ১৯৭৮ সালে হলেও আপনার প্রতিটা চিত্রের মধ্যে আপনার চিত্ত আজও হাজারও সংলাপ নিয়ে জীবন্ত। তাই এই আলাপের দুঃসাহস করা খুব একটা বাড়াবাড়ি নয় বোধহয়।
‘ছবি যেমন একদিকে সমাজের ভালো হবার ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছে, তেমনি আদর্শের আর এক অঙ্গ হিসাবে ভালো হবার পথে এগিয়ে যাবার শক্তিও জুগিয়েছে, সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে– এজিটেটর হিসেবেও দেখা দিয়েছে, অর্গানাইজর হিসেবেও।’ (ছবির সংকট: চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য)
চিত্রকর চিত্তপ্রসাদ, আপনি লিখেছিলেন আপনার সময়ের প্রেক্ষিতে ‘ছবির সংকট’ নিয়ে। আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছি আমার সময়ে দাঁড়িয়ে ‘চিত্রকরের সংকট’-টিকে নিয়েও। এই আলাপ আমার জন্য জরুরি; একইসঙ্গে আপনার কাজকে আমার সময়ে বসে দেখতে ও বুঝতে চাওয়া। সেখানে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রসঙ্গটিও নানাভাবে আমাদের আলাপকে প্ররোচিত করে। আপাত নিরিখে এই আলাপটি পাঠকের কাছে বোকামো মনে হতে পারে। আপনার কথাতে যেমন ‘ছবি জিনিসটির মধ্যে মানুষের মন বা চিত্ত থাকে তাই তার নাম চিত্র দেওয়া হয়েছে, আর সেই চিত্তকে গুছিয়ে দশজনের কাছে সহজবোধ্য করে প্রকাশ করবার উপায় শিল্পীরা গড়ে তুলতে পারেন, তাই ছবি আঁকার আর এক নাম সৃষ্টি করা। সৃষ্টি করার মূল তাগিদটা আসে চিত্তকে প্রকাশ করার ইচ্ছার মধ্যে।’ আপনার শরীরের মৃত্যু ১৯৭৮ সালে হলেও আপনার প্রতিটা চিত্রের মধ্যে আপনার চিত্ত আজও হাজারও সংলাপ নিয়ে জীবন্ত। তাই এই আলাপের দুঃসাহস করা খুব একটা বাড়াবাড়ি নয় বোধহয়। এই সংলাপে অবশ্যই কেবল অনুরাগী দর্শক নই; আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই আমার সময়ের ‘ছবির সংকট ও একইসঙ্গে চিত্রকরের সংকট’ নিয়েও।
ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় ‘আরম্ভ’ নামক এক পত্রিকার আপনার, সোমনাথ হোড় ও জয়নুল আবেদিনের ছবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এর আগে আপনাদের নাম কখনও সেভাবে শুনিনি। আপনাদের ছবির মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। আমি কলকাতা শহরে পড়তে আসার পর আপনাদের কাজ বিভিন্ন লাইব্রেরি-তে নানা ছবির বইয়ের মধ্যে খুঁজতাম। তার আরও পরে ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্স’-এ (কলকাতা) পড়ার সময় আপনাদের কাজগুলোর সঙ্গে আরও গভীরভাবে সাক্ষাৎ হল, নানা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সূত্রে। ওই সময়ে ‘অরণি’ পত্রিকার কোনও এক শারদ সংখ্যায় আপনার লেখা ‘ছবির সংকট’ প্রবন্ধটি প্রথম পড়ি। তখন অতটা বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়নি। এই প্রবন্ধের আমি বারবার ফিরে যাব আপনার ওই প্রবন্ধে আপনার দেখা ও উপলব্ধির কাছে। আর আমরা নির্মাণ করব নতুন এক তর্ক।
দর্শক: আমার ছবির সঙ্গে যাত্রা শুরু বছর সাতেক আগে। তখন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘুর প্রতি হিংসায় জর্জর আমার দেশ। ছবি বোঝার শুরুর দিকে আমি তিন বাই পাঁচ ইঞ্চির টুকরো কাগজে দিনের পর দিন সমুদ্র এঁকে যেতাম। ওই ছোট কাগজের টুকরোতে রং দিয়ে বিশাল সমুদ্র কেন আঁকার চেষ্টা করতাম, তা নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে প্রতিদিনের অসংখ্য টুকরো কাগজের সমুদ্রর মধ্য দিয়ে হয়তো নিজের সময় থেকে পালিয়ে যাওয়ার জায়গা তৈরি হত। এই পালাতে পালাতে একদিন আপনার চিত্রগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন সাহস দিল। খুবই আনকোরা কাঁচা হাতে আমার সময়ের ডায়েরি লেখার চেষ্টা করলাম ছবির মাধ্যমে ২০১৮-’১৯ নাগাদ থেকে।
চিত্রকর: ছবির মধ্যে চিত্রকরের মারফত মন প্রকাশ পায়। সমাজের মন এক-এক যুগে এক-এক রকমের হয়ে থাকে, আর সমাজ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়ায় সমাজের মনও নানা রকমের হয়ে থাকে। তাই এক-এক যুগের চিত্রকর এক-এক রকমের মন ছবির মধ্যে এঁকেছেন এবং যে শ্রেণির প্রভাব চিত্রকরের মনের ওপর প্রবলতর হয়েছে, সেই শ্রেণির মনকেই এঁকেছেন। সমাজ যে কথাটা গুছিয়ে বলতে পারে না, সেটা হল তার এগিয়ে যাওয়ার বা পিছিয়ে পড়ার ইচ্ছার বা শক্তির কথা– অর্থাৎ, তার আদর্শের কথা। প্রত্যেক যুগে চিত্রের মাধ্যমে সে-যুগের সমাজের আদর্শের কথাটাই আঁকা হয়েছে; চিত্রকরের মনের ওপর যে শ্রেণির আদর্শের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে, সেই শ্রেণির আদর্শকেই ছবিতে আঁকা হয়েছে, আদর্শকে সামাজিক জীবনে সক্রিয় করে তোলার জন্য।
দর্শক: আপনার সময়ে জাতীয়তাবাদের চেতনা নতুন স্বাধীন হতে যাওয়া দেশের আদর্শ, সেখানে আপনাদের মতো শিল্পীদের কাজে শ্রেণিসমাজের প্রতি সচেতন প্রকাশ ছিল। আমার সময় তবে অন্য; আমার জন্ম সোভিয়েত ভাঙনের পর। আর ’৯২-এর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এক নতুন দেশ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের নতুন যাত্রা শুরু হল। আজকের সময়ে এই জাতীয়তাবাদ এমন উগ্র হয়ে উঠল, যাকে ব্যবহার করে গত ২০১৪ থেকে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ক্রমশ জনচেতনাকে গ্রাস করছে। ধর্মের আফিমে মন্ত্রমুগ্ধ করে নিজেদের মাটি শক্ত করছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম এই দুই দশক আমরা দেখলাম তথাকথিত গণতন্ত্রের চাদর পরে এক স্বৈরাচারের উন্মেষণ। যে সমাজে প্রকট জাতিবাদী বৈষম্যর আরও নগ্ন প্রদর্শন। আপনি যে শ্রেণিসমাজের আদর্শের কথা বলছেন, তা এমন ফ্রাগ্মেন্ট আমার কাছে; আর নতুন জটিলতা নিয়ে উপস্থিত। দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও বর্তমান উচ্চবর্ণের হাতে দলিতের নিপীড়ন, অত্যাচারের সাক্ষী হয়েও; সেই একই সমাজে নিপীড়িত দলিতের হাতেই সংখ্যালঘু মুসলমানের মবলিঞ্চ হয়। এমন সময়ে চিত্রের ভূমিকা কী? আমরা যারা নতুন, তাদের প্রকাশের জায়গাগুলো কেমন হবে?
চিত্রকর: এই জটিলতাকে বুঝতে হলে আমাদের কিছুটা অতীতে যাওয়ার প্রয়োজন। যেমন, জনতার শক্তির প্রতি এই অবিশ্বাস ও ভয়, আর অন্যদিকে ঔপনিবেশিক হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী যন্ত্রসভ্যতার হাতে এদেশের ধনিকের পরাজয়ের গ্লানি– এই দুটোই এদেশের শিক্ষিত সমাজের দেশপ্রেমের আদর্শকে সমসাময়িক সমাজের বাস্তব সম্পদ ও শক্তির ক্ষেত্রের বাইরে ও মানসিক -কাল্পনিক সম্পদ ও শক্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের কাজে। সমাজ-নিয়ন্ত্রণের কাজে ক্রমবর্ধমান নাগরিক জীবনের চেয়ে পল্লিজীবনই শিক্ষিত সমাজের কাছে আদর্শ হয়ে উঠল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাই যন্ত্রসভ্যতার চেয়ে সামন্ততন্ত্রই বড় হয়ে উঠল। প্রবল দেশপ্রেমের তাগিদেই সংস্কৃতিওয়ালারা নানা যুগের দর্শনকে, নানা কালের সামাজিক আদর্শকে পুনরুদ্ধারের সাধনা করল; সেসব দর্শন ও আদর্শের বহিরাবয়ব থেকে সমসাময়িক বাস্তব পরিবেশের ইতিহাসকে ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলা হল; এবং (যন্ত্রসভ্যতা তথা সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ইউরোপকে এবং বাস্তববাদকে তুচ্ছ ও অমানুষিক প্রমাণ করে স্বদেশের গৌরববৃদ্ধির জন্য) সকল দর্শন ও আদর্শের মধ্যে থেকে মূলসূত্রের এক নির্যাস বানিয়ে তাকে ভারতের চিরন্তনী বাণী বলে প্রচার করা আর স্বদেশের জনতার ওপর ‘আরোপ’-এর চেষ্টা চলতে লাগল। দেশমাতৃকার যে ছবি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকলেন, তা কল্পনা হিসাবে অতুলনীয় সুন্দর, কারিগরিতে নিখুঁত জীবনের প্রতীক; কিন্তু যন্ত্রসভ্যতার ক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার জন্য তখনকার জনতা যে শক্তির প্রেরণা খুঁজছিল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সন্ন্যাসিনী’র ছবি থেকে সে শক্তি মেলে না– শুধু ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগায়। এর ফলে ভারতীয় ছবি ভারতেই ঠিকভাবে গৃহীত হল না, দেশপ্রেমের নামেও না।
দর্শক: আপনার সঙ্গে সহমত অনেকটাই। জনতার শক্তির প্রতি অবিশ্বাস কোনওভাবেই করতে পারব না যখন আমার সময়েই দেখেছি দু’-দুটো বড় আন্দোলনের রূপ; সিএএ, এনআরসি-বিরোধী নারী আন্দোলন; আর পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন। যে আন্দোলনের অলিন্দে ছিল বাস্তব সময় ও পরিবেশ থেকে তৈরি হওয়া জনচেতনার এক দৃপ্ত রূপ। যা প্রবল শক্তিধর আজকের ফ্যাসিস্ট সরকারের বুকে ভয় ধরিয়েছে। আমরা অনেকেই সে সময় ছবির মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের খবরগুলো যাতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু আবার একটা দ্বন্দ্বের জায়গা– আপনি ভারতমাতার কথা বললেন; আজকে যখন আরএসএস-এর কার্যালয় বা তাদের বইয়ের প্রচ্ছদে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতাকে ফিরে আসতে দেখি, তখন সংশয় হয়। আগামীতে হয়তো দেখতে হতে পারে আপনার ‘রামায়ণ’ সিরিজ অযোধ্যার নয়া রামমন্দিরের কোনও গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে। একটি বিশেষ রাজনীতির প্রভাবে বা প্রকোপে তথাকথিত জনগণের একটা বড় অংশে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, একইসঙ্গে ভারতমাতার ‘সন্ন্যাসিনী’ রূপ ও সিংহ এবং মানচিত্র-সমেত রুদ্রমূর্তির নয়া ভারতমাতা। শিব, হনুমান-এর প্রতিকৃতিতেও নতুন জনচাহিদা তৈরি হচ্ছে, যে শরীর হবে পেশিবহুল আর পৌরুষের প্রবল শৌর্য সমেত। আবার একইসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ বা আপনার ‘রামায়ণ’ সিরিজের কাজ গৃহীত হচ্ছে এই জনচেতনার জায়গা তৈরিতে। আর তা করছেন আজকের দিনের সংস্কৃতিওয়ালারাই। আবার এমন একসময় আজকে যেখানে চিত্রকরের ভাষা ও অবস্থান কিউরেটর নির্ধারণ করে দেয়। আমাদের মতো ছোটখাটো লোকেরাও বাজারের লোভে পড়ে; বা সামাজিক মাধ্যমের তৈরি হওয়া আত্মকেন্দ্রিকতার ইন্দ্রজালে ফেঁসে কোনও এক সময় রাজনৈতিক অবস্থান থেকে, আদর্শ থেকে করা ছবির সওদা করে ফেলি।
চিত্রকর: আজকের তোমাদের সময়ের এই অবস্থা অনেক আগেই তার জমিন প্রস্তুত করেছে– যন্ত্রশিল্পের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসাবে, অর্থাৎ, দেশের ও দশের কাছে, ছাপা ছবিকে ফেলে পুড়িয়ে, হাতে আঁকা ছবিকে পৌঁছে দিতে না পারায়, ক্ষুদ্রতর সমঝদার গোষ্ঠীর সীমায় সেসব ছবিকে আবদ্ধ রেখে, ছবির মূল্য বাড়ানোর তথা চিত্রকরের মর্যাদা বাড়ানোর দিকে চিত্রকরকে প্রবৃত্ত হতে হল। একদিকে দুর্বোধ্য হওয়াকে, অন্যদিকে দুষ্প্রাপ্য হওয়াকে চিত্রের পরম সার্থকতা হিসেবে গণ্য করা শুরু হল। অন্যান্য যুগে এবং এযুগের শুরুতেও ‘গুরুর আসন’ থেকে ছবি দেখানো হত জনসাধারণের ওপর আদর্শ ‘আরোপের’ জন্য, এবং সমসাময়িক বাস্তবজীবন সম্বন্ধে সমসাময়িক সমাজের সিম্বলকে (যে সিম্বল চলতি ভাষার মতো দৈনন্দিন জীবনে প্রচলিত, তাকে) চোখের সামনে আনল না। পুরনো ইতিহাস, পুরনো দর্শন, পুরনো সমাজ– ভারতীয় ছবির মধ্যে পুরাতনের জয়জয়কার (তা না করেই বা উপায় কী ছিল, বর্তমান ইতিহাস তো ছিল– শিক্ষিত সমাজের কাছে– গভর্নরদের শাসনের কথা দিয়ে, কৃষক ও কারিগরদের হাহাকারে আর নানা কুসংস্কার ও মূর্খতার প্রমাণে পরিপূর্ণ)। কাজেই ভারতীয় ছবি সাধারণের কাছে, সংস্কৃত ভাষার মতো, দুর্বোধ্য বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ হয়ে উঠল। আর দু’-চারজন রাজা-নবাবের ঘরে, মূল্যবান গ্রন্থে, উচ্চাঙ্গের পত্রিকায়, উচ্চশ্রেণির সমঝদারের সংগ্রহশালায় আত্মনির্বাসন ঘটিয়ে দুর্লভ হয়ে উঠল। জনতার সঙ্গে তার ন্যূনতম সম্পর্ক, দৃশ্য-দর্শক সম্পর্কটাও শেষ অবধি চুকল। ছবিটা ব্যক্তিগত জীবনের খণ্ডতার মধ্যে আশ্রয় নিল, দেশপ্রেমের ‘গবাক্ষ কোথাও একটুখানি সামান্য থাকলেও ছবি আঁকার প্রেরণার পথ হিসেবে তা রইল না। ঔপনিবেশিক জীবনের দুঃখগ্লানির শেষ রেশ হিসেবে, সামাজিক মনের সৌজন্যমার্জিত বিদ্রোহের মৃদু উত্তাপ হিসেবে, সোজা কথায়, জগতের কাছে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ইচ্ছার সঙ্গে জড়িয়ে রইল সেই দেশপ্রেম। ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং কারিগরিতে ভারতীয়তা বজায় রাখার সতর্ক প্রয়াস– ছবি জনতার দখলের নয়– এমন একটা স্বাতন্ত্র্যবোধের সঙ্গে জড়িয়ে দেখা দিতে লাগল। তারই একটা ফল হল, বিষয় নির্বাচনের মধ্যে সারল্যবর্জন, কারিগরিও! এই দুরূহের পথটা গত বছর দশ-বারো পূর্বে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল– প্রথমটা, ভারতীয়তাবোধ বজায় রাখার, প্রাধান্য দেওয়ার ও ছবির দুর্বোধ্যতাকে গৌণ করার দিকে; দ্বিতীয়টা তার বিপরীত– ছবিকে দুর্বোধ্য করার বা দুর্বোধ্য জগতের ছবি আঁকাই মুখ্য, জাতীয়তাবোধকে, বিজ্ঞানের নামে, এড়িয়ে যাওয়ার পথে। নন্দলাল বসুর মতো শক্তিমান ও বিখ্যাত শিল্পী এই প্রথম নম্বর পথের পথিক। দ্বিতীয় দলের শক্তি সম্বন্ধে বলা শক্ত এবং খ্যাতিও বিশেষ শ্রেণির সমঝদারের সীমায় আবদ্ধ, কিন্তু ‘স্কুল’ হিসাবে তাঁদের ছবির বৈশিষ্ট্য শিক্ষিতদের কারও কারও নিকট পরিচিত; ইমপ্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট, ফিউচারিস্ট, সুররিয়ালিস্ট প্রভৃতি বিশেষণগুলি এই দ্বিতীয় পথের পথিকদের পরিচয়পত্রের নাম। এদেশের এই দ্বিতীয় দলটির দৃষ্টিভঙ্গি যতটা ইউরোপের চিত্র-আন্দোলনের প্রতিধ্বনি, তত তাঁদের নিজেদের আবিষ্কারের ফল নয় এবং চিত্র জগতে ইউরোপের মতো ট্রাডিশনের বিরুদ্ধে অভিযান করার চেষ্টা এবং ব্যর্থ চেষ্টা। ব্যর্থ এই জন্যে যে, যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেওয়াই এইসব ‘স্কুলের’ একমাত্র চেষ্টা ছিল, তার কোনও পাত্তাই মিলল না, মিলল ইউরোপের ওঁদেরই বুলি ও কারিগরির অনুকরণ করার পরিচয় মাত্র। প্রতি পদে ইউরোপের ওঁদের নজির দেওয়া ভিন্ন এক পা চলার শক্তির পরিচয় এদেশের এইসব স্কুলের, এঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে দেখাতে পারেননি– অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের ছবিও এই স্কুলের অন্তর্গত– আরও স্পষ্টভাবে– ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চমৎকার সৃষ্টি।
দর্শক: কিন্তু আমার সময়ে একদিকে আর্টের বীভৎস প্রাচুর্যপূর্ণ বাজার; সেই বাজারে অদ্ভুত সব জনবিচ্ছিন্ন আর্টের নতুন নতুন ভাষার নির্মাণ; প্রতিবার সেগুলোর সংস্পর্শে আসতে চাইলে নিজেকে মূর্খ থেকে মূর্খতর মনে হয়। আবার একধরণের লোভ বা আকাঙ্ক্ষাও তৈরি করে এই প্রাচুর্যের আর্ট বাজার। এসময়ে রেজিস্টেন্স আর্টেরও একটি বাজার তৈরি হয়েছে; জেনে না জেনে সেই ক্ষুদ্র প্রতিবাদী আর্ট বাজারের আমিও অংশ। অন্যদিকে আরেকটি সংকট হল আমাদের সময়ের সমাজমাধ্যম। সেখানে প্রতিদিনের কাজের মধ্য দিয়ে নিজের এক ধরনের কালচারাল ক্যাপিটাল নির্মাণের চেষ্টা। এই দুইয়ের বাইরে একজন চিত্রকরের অন্য যাত্রাপথের সন্ধান করতে চেয়েই আপনার সঙ্গে এই বাহাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলাম। সংকট তো শুধু আর চিত্রের নেই; সংকট তৈরি হয়েছে চিত্রকরের আদর্শের; চিত্রকর আজকে দিশাহীন; আর দর্শকও এমন কোনও জায়গা তৈরি করে দিতে পারছে না।
চিত্রকর: ‘শুধু এযুগের নয়, যুগযুগান্তের শিল্পের ফসল সবই শুধু একমাত্র শিল্পীসমাজের সম্পদ নয়, সকল নরনারীর ভালোবাসা না পেলে তাদের অস্তিত্ব ব্যর্থ; আজ সেই ব্যর্থতার চেয়েও বড় বিপদ দেখা দিয়েছে যে, শিল্পকলা সমাজকে আপন স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন ও উদ্দীপ্ত করে তারই বিরুদ্ধে ফ্যাসিজম পাশবিক অভিযান চালিয়েছে। সেই অভিযানের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে সকল নরনারীর সংঘবদ্ধ ও সচেতন প্রত্যাভিযান– একা কোনও শিল্পীর বা কোনও এক শিল্পী সম্প্রদায়ের সমাজসংস্পর্শহীন চেষ্টায় শিল্পসংস্কৃতির স্বাধীনতাকে ফ্যাসিজমের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।’
‘সমগ্র সমাজকে তার পরম সম্পদ, শিল্পসংস্কৃতির সম্পদ সম্বন্ধে সচেতন করে তাকে রক্ষা করবার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে হবে— এই প্রয়োজনের পথে গতানুগতিকতার জড়তার খোলস থেকে বেরিয়ে আসাটাই শিল্পীর স্বাধীনতার প্রথমপাদ; ও দ্বিতীয়পাদ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, যেমন করে কোদাল ভেঙে বেয়নেট গড়ার মধ্যে, ঠিক তেমনি করেই শিল্পের রূপান্তর ঘটানোর মধ্যে। সেই স্বাধীনতার পরিচয় দেবার বেলা আজ বয়ে যাচ্ছে”।
দর্শক: আপনার এই কথাগুলো ‘দর্শক’ থেকে ‘চিত্রকর’ হয়ে ওঠার স্বপ্নকে দিশা দেবে। তবুও সংশয় আর ভয় থাকবে। যেমন আপনার কাজগুলো নিয়ে ‘chittaprosad: A retrospective, 1915- 1974’ DAG থেকে কেনার কথা ভেবেছিলাম। তখন ছাত্র ছিলাম বলে ওত টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য হয়নি। গত সপ্তাহে আপনার নাম দিয়ে সার্চ করতে দেখি আমাজন নামক একটি কেনাকাটার সাইটে বইগুলো বিক্রি করছেন একজন ৫০ হাজার টাকা মুল্যে। তাছাড়া দিল্লি আর্ট গ্যালারির সংগ্রহে আপনার ছবিগুলো এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার সংশয় হল– এই বাঙালি সংস্কৃতিওয়ালারা প্রতিবছর আপনার জন্ম ও মৃত্যুদিনে আপনার আর্থিক দরিদ্রতা নিয়ে কাঁচালি করে আর তাদের বুকে দুঃখের বান বয়ে যায় আপনার রোগশয্যা ও নীরবে লোকজনের আড়ালে মৃত্যুর কাহিনি নিয়ে। আমার খুব বিরক্তি লাগে। আপনাকে যোগ্য সম্মান আমরা কীভাবে দিতাম? যে আপনি চিত্রকে ‘এজিটেটর, অর্গানাইজর’ বলে গেছিলেন, তাঁর উত্তরসুরি কি আমরা হতে পেরেছি? হয়তো আপনার কাজ আমাদের গ্রামের ঘরের দেওয়ালে থাকে না, তবুও আজও গ্রামের আনাচেকানাচে আপনার ছবি কোনও কোনও দেওয়ালে নতুন রাজনৈতিক শিল্পীরা এঁকেই যান। আপনার ছবি আমাদের ইলাস্ট্রেশনের মধ্যে ঘুরেফিরে আপনার সময় সমেত ঢুকে পড়ে; সূত্র তৈরি করে যায় আপনার ও আমার সময়ের।
এই লেখায় সীমিত শব্দ সংখ্যার কারণে অনেক আলাপ বাদ গেল। চিত্রকরের আরও নানা সংকট নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন আছে। এই বাহাসের সূত্র ধরে আমরা এরপরের বাহাসের জন্য প্রস্তুতি নেব। এর মধ্যে চলুন আমরা ‘কোদাল ভেঙে বেয়োনেট গড়ার’ কাজে মনোযোগ দিই।
সূত্র: অরণি, শারদীয়া সংখ্যা, আশ্বিন, ১৯৪৩
মার্কসবাদী পথ