লোকের দুয়ারে দুয়ারে মাথা কুটছি কাজের জন্য, আর তারা কী প্রশ্ন করছে জানেন? বলছে, তুমি কি স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছ, নাকি তোমার স্বামী তোমায় ছেড়ে চলে গেছে? আমি পরিষ্কার সত্যি কথাই বলতাম। বলেছি, আমি স্বামীকে ছেড়ে এসেছি। একা আসিনি। নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়েই স্বামী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। একথা বলতেই, মানুষগুলো ভাবত– নিশ্চয়ই আমার (চরিত্রে)দোষ আছে। আমি মন্দ। খারাপ মেয়েমানুষ। এই রকম চিন্তাভাবনা ছিল সমাজের! শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে যেত। নিজেকে বলতাম, দেখি, কতদূর যেতে হয় আমাকে। আমি লড়ব। এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, আমি দেখতে চেয়েছিলাম।
শুরু করি একটা সত্যিকারের গল্প দিয়ে। চেনা গল্প। এই ভারতের নানা প্রান্তে এরকম হয়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন।
একটি মেয়ে। তার দুই সন্তান। ঘর-সংসার সামলায়। স্বামীর সেবা করে। কোনওরকমে কেটে যাচ্ছিল জীবন। স্বামী ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। নেশাসক্ত। একদিন ওর স্বামী বাড়ি ফিরে দেখে মেয়েটি হাজির নেই। কোথায় গিয়েছে তবে? সে চিৎকার করে, ডাকে, ছানবিন করে। পাড়াজুড়ে তার চিৎকার ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে।
মেয়েটি অন্য একজনের বাড়িতে বসে টিভি দেখছিল। সে টের পায়, স্বামী এসে পড়েছে। স্বামী নেশায় ডুবে। তার রাগ সপ্তমে। সে কী করে এই রাগ বের করবে? কী শাস্তি দেবে টিভি দেখতে যাওয়ার মতো গর্হিত অপরাধের জন্য? প্রথমেই সে হাত তোলে। মারধর শুরু করে। চড়চাপাটি, চুলের মুঠি ধরা, লাথি-ঘুসি– কিন্তু না। রাগমোচন হচ্ছে কই?
এবার অন্য উপায় বের করতে হবে। কী উপায়? সে খুঁজতে থাকে। মনে পড়ে, গ্যাস ফ্যাক্টরি থেকে আনা অ্যাসিডের বোতলটা তো মজুত আছে বাড়িতেই। সে অ্যাসিড ছুড়ে মারে মেয়েটিকে। চিৎকার করতে থাকে মেয়েটি। তার চামড়ায় অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু এখনও, এখনও পুরুষটির রাগ কমছে না। সে বলছে, তবে অন্য উপায়। অন্য পথে যেতে হবে রাগ কমাতে।
পকেট হাতড়ে এবার বের করে দেশলাই বাক্স। একটা কাঠি জ্বালায়, তারপর ছুড়ে দেয় মেয়েটির দিকে।
এরপর সে বোধহয় ক্ষান্ত দেয়। যতক্ষণ মেয়েটার দেহে প্রাণ ছিল, বাঁচার জন্য কাকুতিমিনতি করে চলে। কিন্তু কীভাবে বাঁচা সম্ভব? জ্বলে-পুড়ে গিয়েছে ওর শরীর। চামড়া গলে পড়ছে। তাও যতক্ষণ প্রাণ ছিল, বাঁচার চেষ্টা করেছে। ওই অবস্থায় শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে। স্বর বের হচ্ছে না। ‘উ…উ…’ গোঙাচ্ছে। সেই অবস্থায় বাইরের একটা মেয়ে ওকে দেখে ফেলে। দেখে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। আর্তনাদ শোনা যায়:, ‘মা, মা, বউদি শেষ হয়ে গেছে! মা, বউদি শেষ হয়ে গেছে!’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমার জীবনেও রাগ আছে। তবে তার চেয়েও বেশি করে আছে দুঃখ। অনেক দুঃখ পেয়েছি। মেয়েরা তো দুঃখই পায় বেশি করে। মেয়েরা দুঃখ পেয়েই রেগে যায় সচরাচর। একটা সময় এমন গিয়েছে, লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। কেউ কাজ দিচ্ছে না। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রাগে-হতাশায় মনে হয়েছে, ধুর! এ কেমন সমাজ, যেখানে ব্যাটাছেলের সঙ্গে থাকলে তাহলেই মেয়ের ইজ্জত আছে, নয়তো নেই! যেহেতু আমি একা থাকি, তাই আমাকে কাজ দিচ্ছে না কেউ। লোকের দুয়ারে দুয়ারে মাথা কুটছি কাজের জন্য, আর তারা কী প্রশ্ন করছে জানেন? বলছে, তুমি কি স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছ, নাকি তোমার স্বামী তোমায় ছেড়ে চলে গেছে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ওই অবস্থায় লোক জড়ো হয়ে ওকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিল। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল, মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ ওর কাছে জানতে চেয়েছিল, কীভাবে এ অবস্থা ওর হল? সেই অবস্থাতেও মেয়েটা কী করল জানেন? বলেছিল, ‘আমি নিজেই ঢেলেছি অ্যাসিড। গায়ে আগুন দিয়েছি।’ কেন বলেছে? কারণ তার দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছিল। স্বামীকে যদি এখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, যদি জেল হয়, তাহলে বাচ্চা দুটোর কী হবে!
এসব শুনেও বলবেন না, মেয়েদের রেগে যাওয়া জরুরি? আলবাত জরুরি। মেয়েদের রাগা দরকার। মেয়েরা যদি চুপ করে থাকে, আপোষ করে প্রতি পদক্ষেপে, তাহলে যেমন তাদের ক্ষতি, তেমনই ক্ষতি হবে সমাজের।
আমার কথা জানতে চান?
আমার জীবনেও রাগ আছে। তবে তার চেয়েও বেশি করে আছে দুঃখ। অনেক দুঃখ পেয়েছি। মেয়েরা তো দুঃখই পায় বেশি করে। মেয়েরা দুঃখ পেয়েই রেগে যায় সচরাচর। একটা সময় এমন গিয়েছে, লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। কেউ কাজ দিচ্ছে না। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রাগে-হতাশায় মনে হয়েছে, ধুর! এ কেমন সমাজ, যেখানে ব্যাটাছেলের সঙ্গে থাকলে তাহলেই মেয়ের ইজ্জত আছে, নয়তো নেই! যেহেতু আমি একা থাকি, তাই আমাকে কাজ দিচ্ছে না কেউ। লোকের দুয়ারে দুয়ারে মাথা কুটছি কাজের জন্য, আর তারা কী প্রশ্ন করছে জানেন? বলছে, তুমি কি স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছ, নাকি তোমার স্বামী তোমায় ছেড়ে চলে গেছে?
আমি পরিষ্কার সত্যি কথাই বলতাম। বলেছি, আমি স্বামীকে ছেড়ে এসেছি। একা আসিনি। নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়েই স্বামী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। একথা বলতেই, মানুষগুলো ভাবত– নিশ্চয়ই আমার (চরিত্রে)দোষ আছে। আমি মন্দ। খারাপ মেয়েমানুষ। এই রকম চিন্তাভাবনা ছিল সমাজের! শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে যেত। নিজেকে বলতাম, দেখি, কতদূর যেতে হয় আমাকে। আমি লড়ব। এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, আমি দেখতে চেয়েছিলাম। চাইলেই ফিরে যেতে পারতাম স্বামীর ঘরে। যাইনি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমার কপালে কত দুঃখ লেখা আছে। আমি সেই দুঃখের সঙ্গে লড়ে গিয়েছিলাম। একটা জেদ নিয়ে, রাগ নিয়ে আমি লড়াই করেছি। দিনের পর দিন। মানুষ কম অপমান করেনি। কিন্তু দমে যায়নি। সেই লড়াই বিফলে যায়নি। তাতে আমার সন্তানের ভালো হয়েছে, আখেরে আমার ভালো হয়েছে।
অনেকে চুপ করে সব সহ্য করে যায়। তাতে সমাজের ভালো হয় কি? হয় না। মেয়েদের তাই আরও বেশি রেগে যাওয়া উচিত। এই যে ঝাঁসির রানি। তার রাগ ছিল বলেই না ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে পেরেছে। রাগটা ছিল বলেই ইংরেজদের মনে ভয় ধরাতে পেরেছিল। মেয়েরা আরও বেশি করে রাগ করুক। এই সমাজটাকে বদলে দিক। কিন্তু একটা কথাই বলব, মেয়েরা রাগ করুক মাথা ঠান্ডা রেখে, সেই রাগেই মঙ্গল। আমি দেখেছি, মেয়েরা রাগ করে ভালোর দিকেই পা বাড়ায়।
কাজের জায়গায় প্রতিনিয়ত মেয়েদের ওপর অত্যাচার চলে। শুধু কাজের জায়গা কেন, নিজের ঘরে কি সে মার খায় না? খায় তো। যে মেয়েটাকে দিনের পর দিন মারধর করা হচ্ছে, মার খেতে খেতে তার মনের মধ্যেও ধিক্কার চলে আসে। নিজের জীবনের ওপর। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় মেয়েদের সামনে খোলা নেই। যে পুরুষটা অত্যাচার করছে, যে লাঠি দিয়ে মারছে। একটা দিন আসা উচিত, মেয়েটা তার হাত থেকে প্রবল আক্রোশে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে পাল্টা মার শুরু করবে। অত্যাচারীকে দু’ঘা বসিয়ে দেবে। এই পাশবিক রাগটা যতক্ষণ না আসবে, ততক্ষণ সেই মেয়েটা নিজেকে বদলাতে পারবে না।
আমাদের সমাজে বেশকিছু চিন্তাভাবনা এখনও আছে, যে স্বামীকে মেনে চলতে হয়। স্বামীর মুখের ওপর কথা বলতে নেই। স্বামীর গায়ে হাত তুলতে নেই। কিন্তু আর কতদিন এই বস্তাপচা চিন্তাভাবনা নিয়ে মেয়েরা বেঁচে থাকবে! নিজেদের মানসম্মান বাঁচাতে গেলে পাল্টা স্পর্ধা দেখাতে হবে। রাগতে হবে। নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে। রাগই এক্ষেত্রে মেয়েদের একমাত্র হাতিয়ার। প্রথম প্রথম আমিও পারিনি। আমারও সাহসে কুলায়নি। অত্যাচার তো আমার ওপরেও কম হয়নি। দিনের পর দিন মারধর করা হয়েছে। কিন্তু লাঠিটা কেড়ে নিতে পারিনি। তবে মার খেতে খেতে একদিন লাঠিটা হাতের মুঠোয় আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করেছি। কারণ আমার ছেলে, আমার বাচ্চাটা তখন আমার কোলে থাকত। লাঠির ঘা থেকে বাঁচতে যদি লাঠিটা হাতে চেপে না ধরতাম, তাহলে আঘাতটা ছেলের মাথায় গিয়ে লাগত। অনেকে বলেছে তখন, মারতে পারিস না তুই, দু’ঘা মারতে পারিস না! আমি পারিনি লাঠি দিয়ে মারতে। আমার হাত ওঠেনি।
তবে কলম উঠেছে।