এক প্রবল দুর্যোগের রাতে মেরি শেলি স্বপ্নের ভিতরে পেয়েছিলেন ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ কাহিনির নির্যাস। বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস। ৫৩ বছর বয়সে প্রয়াত সেই নারী কালের নিয়মে ২২৬ বছর পেরিয়ে এলেন। তবু তাঁকে নিয়ে চর্চা অব্যাহত। আসলে এই একলা হয়ে যাওয়া বিপন্ন সময়ে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ও তাঁর তৈরি দানব আসলেই মডার্ন প্রমিথিউস।
সে এক আশ্চর্য গ্রীষ্ম! এমন অদ্ভুত ব্যাপার কেউ দেখেনি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। সময়টা ‘সামার’ হলেও বৃষ্টি আর শীতে জবুথবু সকলে! সেবারের গ্রীষ্ম বিখ্যাতই হয়ে রয়েছে ‘দ্য ইয়ার উইদাউট আ সামার’ নামে। দুর্যোগের কবলে পড়ে মারা গিয়েছিলেন ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এমনই এক সময়ে দুঃস্বপ্ন দেখলেন এক অষ্টাদশী। দেখলেন হাঁটু গেড়ে বসে থাকা বিবর্ণ মুখের এক তরুণ ও তার পাশে পড়ে থাকা এক মৃতদেহকে। সেই মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো তরুণটি পাগলের মতো ভয় পেয়ে পালাচ্ছে। আর অসহায়ের মতো বিছানার পাশে এসে আবিষ্কার করছে সেই জীবন্মৃতকেই। যে তার স্রষ্টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তার ‘হলুদ, জলে ভরা, কৌতূহলোদ্দীপক চোখ’ নিয়ে…
২০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নের কথা এখন সারা বিশ্ব জানে। যে স্বপ্ন দেখে সেই অষ্টাদশী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেছিলেন ‘আই হ্যাভ ফাউন্ড ইট’। ভোর হতেই কলম টেনে নিয়ে সাদা পাতায় লিখে ফেলেছিলেন প্রথম বাক্যটি– ‘ইট ওয়াজ অন আ ড্রিরি নাইট অফ নভেম্বর।’ পরবর্তী সময়ে সেই লেখাই হয়ে উঠল আস্ত উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’। এক প্রবল দুর্যোগের রাতে এভাবেই মেরি শেলি (তখনও অবশ্য তিনি গডউইন) স্বপ্নের ভিতরে পেয়েছিলেন তাঁর কাহিনির নির্যাস। বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের তকমা পাওয়া যে উপন্যাস হাড়হিম আতঙ্কেরও। ৫৩ বছর বয়সে ব্রেন টিউমারে প্রয়াত সেই নারী কালের নিয়মে ২২৬ বছর পেরিয়ে এলেন। তবু তাঁকে নিয়ে চর্চা অব্যাহত। আসলে এই একলা হয়ে যাওয়া বিপন্ন সময়ে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ও তাঁর সৃষ্ট দানব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে যেন। তাই ফিরে ফিরে আসছে প্রশ্নটা। কেন এক কিশোরী লিখলেন ওইরকম এক আতঙ্কঘন অথচ বিষাদে ভরা আখ্যান?
আসলে ১৮১৬ সালের সেই গ্রীষ্মবিহীন গ্রীষ্মে মেরি শেলি ছিলেন এক আশ্চর্য দোলাচলের মধ্যে। বলতে গেলে তাঁর সারা জীবনটাই তো এক বিষাদগাথা। জন্মের দশ দিনের মধ্যেই মারা যান মা মেরি উলস্টনক্র্যাফট। বাবা উইলিয়াম গডউইন ফের বিয়ে করলেন। সৎ মা মেরি জেন ক্লেয়ারমন্টের সঙ্গে মেরির সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। ‘এমন এক মহিলা যাঁর কথা ভাবলেই আমি কাঁপতে থাকি’, এমনই ছিল সেই মহিলা সম্পর্কে মেরির বিশ্লেষণ। সৎ মা’কে ঘৃণা করলেও বাবা তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর কাছেই মেরির লাতিন ও গ্রিক ভাষা শিক্ষা। কিন্তু সেখানেও রয়েছে সংশয়। উইলিয়াম গডউইনের সঙ্গে কি তাঁর কন্যার সম্পর্ক সত্যিই স্বাভাবিক ছিল? মেরি শেলির দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মাথিলডা’র বিষয়বস্তু ছিল মেয়ের প্রতি বাবার যৌন কামনা! ১৮১৯-’২০ সালে লেখা সেই অজাচারের আখ্যান প্রকাশিত হয় অনেক পরে, ১৯৫৯ সালে। আচমকা এমন উপন্যাস কেন লিখলেন মেরি? শোনা যায়, বাবাকে উপন্যাসটি পড়তে দিয়েছিল মেয়ে। কিন্তু উইলিয়াম গডউইন সেটিকে আর ফেরত দেননি। চাননি মেয়ের লেখা এই উপন্যাস ছাপা হোক। সেই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট মেয়েটির মধ্যে অনেকেই লেখিকার ছায়া দেখেছেন। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে গোপনে আরও এক ভয়াবহ যন্ত্রণাকে লালন করে যেতে হয়েছে মেরিকে।
এবং পার্সি বিশি শেলি। ঋতুমতী হতে না হতেই ১৮১৪ সালের জুলাই মাসে যাঁর সঙ্গে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন মেরি। বাবা ও সৎ মা মুখ ফেরালেন। সর্বত্র শুরু হল ছিছিক্কার! সেপ্টেম্বরে ফের কপর্দকশূন্য হয়ে ফিরে আসা। ততদিনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন মেরি। পরের বছরের গোড়ায় জন্ম দিলেন প্রথম সন্তানের। কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেল সেই সদ্যোজাত। ফের অন্তঃসত্ত্বা হলেন। জন্ম দিলেন দ্বিতীয় সন্তান উইলিয়ামের। তখনও কিন্তু তাঁর বিয়ে হয়নি শেলির সঙ্গে। আসলে ‘ফ্রি লাভ’-এ বিশ্বাসী সেলেব্রিটি কবি শেলির মন সর্বদাই প্রায় উড়ু উড়ু। অগাধ যৌনতায় তাঁর যত আগ্রহ, সম্পর্কে থিতু হওয়ায় ততটা নেই। প্রথম স্ত্রী হ্যারিয়েটকে নিয়েও তিনি যখন পালান, তখন সেই কিশোরীরও বয়স ১৬। কাজেই মেরির মধ্যে এই সংশয় ছিলই। শেষ পর্যন্ত তাঁকেও কি ত্যাগ করবেন শেলি? মাত্র ১৮ বছরের এক মেয়েকে যেতে হচ্ছিল এমনই বিষাদঘন দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে এল ১৮১৬ সালের সেই গ্রীষ্ম। জেনেভা লেকের ধারে লর্ড বায়রন ও জন পলিডরির সঙ্গে ছুটি কাটাতে গেলেন মেরি ও পার্সি। সঙ্গে ছোট্ট উইলিয়াম ও মেরির সৎ বোন ক্লেয়ার ক্লেয়ারমন্ট। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে জানলা-দরজা বন্ধ করে কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জার্মান ভূতের সংকলন ‘ফ্যান্টাসমাগোরিয়ানা’ পড়তে লাগলেন তাঁরা। পড়তে পড়তে ঠিক হল সকলেই লিখবেন একটি করে ভৌতিক কাহিনি।
পরিবেশটাও ছিল তেমনই থমথমে। পলিডরির ডায়রি থেকে জানা যায়, ১৮ জুনের কনকনে রাতে বায়রন বারবার আবৃত্তি করছিলেন কোলরিজের ‘ক্রিস্টাবেল’। যেখানে রয়েছে ডাইনির স্তনের প্রসঙ্গ। যা শুনতে শুনতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পার্সি মেরির দিকে তাকিয়ে কল্পনা করলেন বহুশ্রুত এক নারীর কথা, যাঁর স্তনবৃন্তের পরিবর্তে রয়েছে দু’টি চোখ! এসবই প্রভাবিত করেছিল মেরিকে। সেই সঙ্গে ছিল বায়রন ও পার্সির জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। প্রেমিকের অসামান্য বাগ্মিতায় বরাবরই মুগ্ধ ছিলেন তিনি। তাঁর ও বায়রনের মুখে গ্যালভানিজম ও জীবতত্ত্ব অর্থাৎ কেমন করে ‘মৃতজনে দেহো প্রাণ’কে সম্ভব করা যায়, সেটাই সেদিন নীরব শ্রোতা হয়ে শুনছিলেন অষ্টাদশী মেরি।
এরপরই আসে সেই স্বপ্ন। নিজের না দেখা মা নাকি জন্মের কয়েক দিন পরই মারা যাওয়া সন্তান, ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে কাকে খুঁজেছিলেন মেরি, তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে। ক্রমে লেখা এগোয়। গল্প হয়ে ওঠে উপন্যাস। এর মধ্যেই আত্মহত্যা করেন মেরির সৎ দিদি ফ্যানি (যার শবদেহ চিনতে অস্বীকার করেছিলেন বাবা উইলিয়াম)। ডিসেম্বরে লন্ডনের সার্পেন্টাইনের জলাশয়ে ভেসে ওঠে পার্সির প্রথম স্ত্রী হ্যারিয়েটের মৃতদেহ। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় (সেই সন্তান অবশ্য পার্সির ঔরসজাত নয়) আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। এই সব মৃত্যুর অকরুণ আবহ মেরিকে আচ্ছন্ন করেছিল। এই সব ঘটনাও প্রভাবিত করেছিল উপন্যাসের চলনকে। তাই তাঁর লেখা আখ্যান যতই ভয়ংকর হোক, অসহায় দানবটি শেষ পর্যন্ত যেন করুণাই প্রত্যাশা করতে থাকে পাঠকদের থেকে।
মেরির সমস্ত জীবনই ছিল এক বিষণ্ণতায় মোড়া। দ্বিতীয় সন্তান উইলিয়াম ও তৃতীয় সন্তান কন্যা ক্লারার মৃত্যু হয় একেবারে শিশু অবস্থাতেই। চতুর্থ সন্তানটি আয়ু পেলেও ২৫ বছর বয়সে হারাতে হয় স্বামীকে। পাশাপাশি যে উপন্যাস একই সঙ্গে নিন্দা ও প্রশংসায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল, তার স্বীকৃতিও সেভাবে দিতে চাওয়া হয়নি তাঁকে। বলা হয়েছে, ওই বই আসলে পার্সি বিসি শেলির মতো জিনিয়াসের লেখা! ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ম্যান হু রোট ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর মতো বইয়ে যে দাবি নতুন করে ফিরে আসতে দেখা গিয়েছে। এই সমস্ত নিন্দা-অস্বীকৃতি-মৃত্যু-শোকের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা মেরি শেলি তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট ম্যান’-এর প্রধান চরিত্র লিওনেলের মতোই বিশ্ব সংসারে একাকী এক মানুষেরই প্রতিভূ যেন। তিনি লিখে গিয়েছেন এমন এক বই, যাকে নিছক ভূতুড়ে গপ্পগাছা হিসেবে ভাবাটা চরম অজ্ঞতা। আধুনিক মানুষ ও তার অমরত্বের প্রত্যাশার কথা যেভাবে বলে গিয়েছেন মেরি শেলি, তার কাছে আমাদের বারবার ফিরে না এসে উপায় নেই।