১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০ সালে জন্মেছিলেন মওলানা ভাসানী। বাংলার কৃষকের বহু শতক ধরে নির্যাতিত বুকের উপর অভিভাবকের চাদরের মতো বিছিয়ে থাকবে ভাসানীর ছবি। যতদিন সাম্রাজ্যবাদ থাকবে, যতদিন আধিপত্যবাদ থাকবে, যতদিন লুণ্ঠিত হবে বাংলার নদী, যতদিন কাঁটাতারে লাশ ঝুলবে বাঙালির, যতদিন দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণ-প্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম চলবে, ততদিন মওলানা ভাসানী প্রাসঙ্গিক থাকবেন। সরকারি বা দরবারি ইতিহাসের তোয়াক্কা না করেই তিনি রয়ে যাবেন বাংলার কৃষকের চৈতন্যে।
তাঁর অনেক নাম। কেউ তাঁকে বলেন ‘লাল মওলানা’, কারও কাছে তিনি ‘মজলুম জননেতা’। ১৯৬৯ সালের অগ্নিময় গণ-অভ্যুত্থানের পরে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্ববাসীর কাছে মওলানা হামিদ খান ভাসানীকে পরিচিত করেছিল ‘প্রফেট অফ ভায়োলেন্স’ হিসাবে। ১৯৭৬ সালে ৯৬ বছর বয়সে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের। সেই জনস্রোতে হেঁটেছিলেন আহমেদ ছফাও। পরবর্তীকালে তিনি মওলানা ভাসানীর নাম দিয়েছিলেন ‘জলদেবতা’। শামসুর রাহমানের কাছে ভাসানী এক ‘অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার’, যাঁর হাত ঝলসে ওঠে বল্লমের মতো, সব ‘বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ’ যিনি ঢেকে দিতে চান সফেদ পাঞ্জাবি দিয়ে।
এই আশ্চর্য মানুষটিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তেমন চর্চা নেই। যাঁর ‘খামোশ’ হুংকারে ঢাকার রাজপথে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সেনা, নামিয়ে নিয়েছিল বন্দুক, তিনিই লাল মওলানা ভাসানী। ভাসানী বলেছিলেন, ‘মাতৃদুগ্ধে যেমন শিশুর অধিকার, নদীর ওপরে তেমন মানুষের অধিকার।’ কাঁটাতারের দু’পারেই যখন ধর্মব্যবসায়ীদের দাপাদাপি তুঙ্গে, তখন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন ভাসানী। মনে পড়ে তাঁর আশ্চর্য উক্তি, ‘শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না। পরে ফুলের নাম কী দিবা, ফাতেমা-চূড়া?’
…………………………
১৯৫৭ সাল। ভাসানী ডাক দিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের। ভারত থেকে সেই সম্মেলনে হাজির হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, প্রবোধ সান্যালরা। এই কাগমারী সম্মেলনেই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে পূর্ব বাংলার আলাদা হওয়ার ডাক দেন মওলানা। সম্মেলনের পরে কাগমারীতেই বৈঠকে বসলেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। ভাসানী বুঝলেন তেল আর জলের মেশা অসম্ভব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে তীব্র হল বিরোধ। সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠল। নতুন দল ন্যাপ হয়ে উঠল দুই পাকিস্তানের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নিরাপদ আশ্রয়।
…………………………
সিরাজগঞ্জের হয়াধনগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে জন্ম আব্দুল হামিদ খানের। ডাকনাম ছিল চেকা। সিরাজগঞ্জের ছিল কৃষক বিদ্রোহের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ছোট থেকে তাই ফেলে আসা সময়ের কৃষক বিদ্রোহের আখ্যান শুনতে শুনতে বড় হয়েছিলেন তিনি। খুব কম বয়সেই বাবা, মা, ভাই, বোন সকলকে হারিয়ে একদম অনাথ হয়ে পড়েন হামিদ। পীর নাসিরুদ্দিন বোগদাদী তাকে নিয়ে এলেন আসামের জলেশ্বরে। তারপর পড়তে পাঠালেন দেওবন্দে। কিন্তু পীর না হয়েই ফিরে এলেন তিনি। চলে গেলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। শুরু হল তাঁর নতুন জীবন। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এলাকার গরিব কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে হাত দিলেন তিনি। শুরু হল এক মহাকাব্যিক পথচলা। প্রথমে চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলা। সেই সূত্রে কংগ্রেসে যোগদান। তারপর জমিদার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ। অবশেষে, ১৯৩৭ সালে তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটল। পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমিদাররা তাঁদের এলাকায় ভাসানীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এই কালপর্বে তিনি যোগ দিলেন মুসলিম লীগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী মিলে তৈরি করলেন নতুন রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। শাসক মুসলিম লীগের বিকল্প, ‘আওয়াম’ বা জনতার মুসলিম লীগ। সভাপতি হলেন ভাসানী নিজে, সাধারণ সম্পাদক হলেন শামসুল হক। দুই যুগ্ম সম্পাদক খোন্দকার মুস্তাক ও শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৫ সালে এই দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ভাসানী। এর মাঝে তিনি গিয়েছেন আর্ন্তজাতিক শান্তি সম্মেলনে। তাঁর সঙ্গে মিত্রতা হয়েছে পাবলো নেরুদার মতো মানুষের। ১৯৫০ সালে যখন রাজশাহি জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দিদের ওপর গুলি চলছে, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন ভাসানী, অনশন করেছেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগেও বেশিদিন থাকতে পারলেন না তিনি। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার পক্ষাবলম্বন করল, তখন নিজের হাতে গড়া দল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ভাসানী। তৈরি করলেন নতুন দল– ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। ১৯৫৭ সাল। ভাসানী ডাক দিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের। ভারত থেকে সেই সম্মেলনে হাজির হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, প্রবোধ সান্যালরা। এই কাগমারী সম্মেলনেই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে পূর্ব বাংলার আলাদা হওয়ার ডাক দেন মওলানা। সম্মেলনের পরে কাগমারীতেই বৈঠকে বসলেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। ভাসানী বুঝলেন তেল আর জলের মেশা অসম্ভব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে তীব্র হল বিরোধ। সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠল। নতুন দল ন্যাপ হয়ে উঠল দুই পাকিস্তানের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নিরাপদ আশ্রয়। পূর্ব বাংলায় নেতৃত্বভার রইল ভাসানীর হাতে, পশ্চিম পাকিস্তানে নেতৃত্বে রইলেন সীমান্ত গান্ধী বাদশা খান।
……………………………………
পড়তে পারেন আনখ সমুদ্দুরের লেখাও: আজ যদি চিত্তপ্রসাদ সাক্ষাৎকার দিতেন…
……………………………………
কিন্তু আব্দুল হামিদ খান কী করে ‘মওলানা ভাসানী’ হলেন? এ-ও ভারী বিচিত্র ইতিহাস। ধুবরীর ভাসানচরে ১৯২৪ সালে তিনি কৃষক সম্মেলনের ডাক দিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘আসাম-বাংলা-প্রজা সম্মেলন। ওই সম্মেলনের পরেই অখণ্ড আসাম ও বাংলা জুড়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে ভাসানীর মওলানা হিসাবে। ভাসানচরের এই কৃষক সম্মেলনের প্রধান দাবি ছিল ‘লাইনপ্রথা’র অবসান। তৎকালীন আসাম সরকারের আইনের কারণে কৃষকরা নির্দিষ্ট কিছু লাইন বা সীমারেখার বাইরে বাকি আসামে চলাফেরা করতে পারতেন না। জমিতে তাঁদের আইনি অধিকারও ছিল না। এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুললেন মওলানা। ১৯৩৭ সালে প্রথমবার আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েই গণপরিষদে লাইনপ্রথা বিরোধী বিল উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন দু’-টুকরো হয়ে স্বাধীন হচ্ছে দেশ, ভাসানী তখন জেলে। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে মুক্তি দিয়ে ধুবরীতে এনে পাকিস্তানে যাওয়ার নৌকায় তুলে দেওয়া হয়।
এই বাংলায় ভাসানীকে নিয়ে তেমন চর্চা নেই। সৌমিত্র দস্তিদারের মতো হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ ভাসানীকে নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তাঁদের স্বর আর কতজনের কাছেই বা পৌঁছয়! পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বাংলাদেশ পাঠের ভরকেন্দ্রে মূলত একজন ব্যক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের ঠিকাদারি নেওয়া একটি দলের ইতিহাস। এই অদ্ভুত মানুষটিকে যে আমরা ঠিক করে চিনতেই পারলাম না, তা বোধহয় আমাদেরই দুর্ভাগ্য। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলায় ত্রাণকার্যে এগিয়ে এসেছিলেন মওলানা। সেবার ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পূর্ব বাংলা ছারখার হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন, অনেকে মৃত। এদিকে সামনেই নির্বাচন। মওলানা ভাসানী সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর দল ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেবে না। ৯০ বছরের বৃদ্ধ মওলানা ত্রাণ নিয়ে ছুটে বেড়ালেন পূর্ববঙ্গের দুর্গত এলাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। ‘পিপলস মওলানা’র বাজপাখির ডানার মতো প্রসারিত দুই হাতের ছায়ায় আশ্রয় নিল বাংলার জনতা। দুর্গত এলাকা থেকে ফিরে এসে পল্টনের জনসভায় ভাসানী শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতা। কবি শামসুর রাহমানের মনে হয়েছিল এই ভাসানি কোনও রাজনৈতিক নেতা নন, এক অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। তিনি লিখলেন:
শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানি,
সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,
যেন মহাপ্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ
সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি
উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তাঁর দক্ষিণ বাংলার
শবাকীর্ণ হু হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের
দৃশ্যাবলীময়; শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। জনসমাবেশে
সখেদে দিলেন ছুঁড়ে সারা খাঁ-খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে।
সবাই দেখল চেনা পল্টন নিমেষে অতিশয়
কর্দমাক্ত হ’য়ে যায়, ঝুলছে সবার কাঁধে লাশ।
আমরা সবাই লাশ, বুঝি-বা অত্যন্ত রাগী কোনো
ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত
চকিতে করেছে ধ্বংস, প’ড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা।
ঝাঁকা-মুটে, ভিখিরী, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,
শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানি,
সমস্ত দোকান-পাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ,
ধাবমান রিকশা, ট্যাকসি, অতিকায় ডবল ডেকার,
কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান,
প্যান্ডেল, টেলিভিশন, ল্যাম্পোস্ট, রেস্তোরাঁ, ফুটপাথ
যাচ্ছে ভেসে, যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে।
হায়, আজ একী মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!
বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তাঁর হাত বারবার
অতি দ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয় সফেদ পাঞ্জাবি,
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান!
…………………………………………………
ক্ষুব্ধ পাকসেনারা যখন পুড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর সন্তোষের আাড়ি, মওলানা তখন এক দরিদ্র কৃষকের বাসায়, দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। সামান্য ভাত আর সালুন খেতে খেতে সঙ্গী ইরফানুল বারিকে বলছেন, ‘সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।’ বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিন্তক ও লেখক ফিরোজ আহমেদের মতে, অতিবৃদ্ধ ভাসানী দু’পাশে দগ্ধ, রক্তাক্ত, ধর্ষিত বাংলাদেশকে নিয়ে হাঁটছেন– এই চিত্রটিই মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প, অথচ ‘জনপ্রিয়’ ইতিহাসে এই গল্পগুলি নেই। যেমন নেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নরসিংদী-সহ গোটা দেশে ভাসানী অনুগামীদের আশ্চর্য সংগ্রামের গল্পগুলি, নেই তাঁর অন্তরীণ হয়ে থাকা, নেই জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ কাদের বিরূপতার মুখে কেন পড়েছিল, সেই বৃত্তান্তও ৷
…………………………………………………
ভাসানীর বক্তৃতা ছিল অসামান্য। পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বয়স্ক কমরেডদের কাছে সেই আশ্চর্য বক্তৃতার কথা কিছু শুনেছি। ইউটিউবে তেমন পাইনি। ভাসা ভাসা কিছু আছে। শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্র কয়েক বছর আগে একটি সংবাদপত্রে তাঁর অসামান্য গদ্যে এই প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখেছিলেন:
‘…পূর্ববঙ্গের কৃষক নেতা মৌলানা ভাসানী জনমোহিনী বক্তৃতার জন্য বহুবিদিত। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশক, শীতের মরসুমে পূর্ববঙ্গের বড় গঞ্জে সপ্তাহব্যাপী হাট বসেছে, মৌলানাসাহেব এসেছেন, পড়ন্ত বিকেলে তিনি বলা শুরু করলেন ধর্মকথা দিয়ে। নীতির কথা বললেন, নীতির ব্যাখ্যার জন্য কোনও মজার কাহিনি জুড়লেন, তার সূত্র ধরে ইতিহাসে চলে যাওয়া, ইতিহাস-বিবরণ শেষ হতে না হতেই সান্ধ্যকালীন নামাজের সময়, এক প্রহরের বিরতি, ফের সভা শুরু, মৌলানাসাহেব ইতিহাসে ক্ষান্ত দিয়ে সমকালীন রাজনীতিতে চলে এলেন। রাজনীতি থেকে দেশের আর্থিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, কৃষকরা কেন ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, কোন নেমকহারামরা তাঁদের বঞ্চিত করছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত, সেসব কাহনের পর কাহন। কখনও আবেগে কাঁপছেন, কখনও রাগে ফুঁসছেন, কখনও শ্লেষাত্মক রসিকতা করে নিজে হাসছেন, কয়েক হাজার শ্রোতাকেও হাসাচ্ছেন। ফের নামাজের মুহূর্ত সমাগত, নৈশাহারের তাগিদও, পুনরায় সভার বিরতি। রাত একটু গভীর হয়ে এলে নির্মল আকাশে তারাগুলি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে, শব্দরাজি স্তব্ধ, মৌলানা ভাসানীর ভাষণের নৈশ কিস্তি, আরব্য উপন্যাসের একটি-দু’টি উপাখ্যানের প্রসঙ্গ, সেখান থেকে অবলীলাক্রমে রামায়ণ-মহাভারতে অথবা কোনও চৈতন্যলীলায়, পরক্ষণে ইসলামি ধর্মকথায়, ফের কৃষক-জীবনের রূঢ় বাস্তবে। ধ্বনিতরঙ্গ উঠছে, নামছে, খাঁটি প্রাকৃত বাঙাল ভাষা, তদৈব উচ্চারণ ভঙ্গিমা। যাঁরা শুনছেন, তাঁরা সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। সবচেয়ে যা তাজ্জব, সপ্তাহব্যাপী হাট বসেছে, হাটের প্রতিটি দিন মৌলানাসাহেবের ভাষণ পড়ন্ত বিকেল থেকে, হাটুরেরা রুদ্ধশ্বাস আগ্রহে শুনেছেন। বিষয়বৈচিত্রের গুণে তথা বাগ্মিতার কলাকুশলতায় অতিকথন অতিসহজিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে।’
ভাসানী ছিলেন এমনই। তিনি কৃষকের সন্তান, মজলুম জনতার চিরকালীন প্রতিনিধি। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল। ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু হয়েছে। ভাসানী আছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে, নিজের বাড়িতে। গণহত্যার খবর পেয়েই তিনি পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন আসামের উদ্দেশে। ৯০ বছর বয়সি মানুষটি হাঁটছেন। দু’পাশে দগ্ধ জনপদ, পলায়নপর লাখো দেশবাসী। তাঁদেরকে নিয়ে হাঁটছেন ভাসানী। পথে কয়েকবার তাঁর দেখাও পেল পাকসেনা। কিন্তু অতিসাধারণ লুঙ্গি, তালপাতার টুপি আর ঢোলা পাঞ্জাবিতে হাঁটতে থাকা বৃদ্ধকে ‘প্রফেট অফ ভায়োলেন্স’ বলে চিনতে পারল না তারা। ক্ষুব্ধ পাকসেনারা যখন পুড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর সন্তোষের আাড়ি, মওলানা তখন এক দরিদ্র কৃষকের বাসায়, দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। সামান্য ভাত আর সালুন খেতে খেতে সঙ্গী ইরফানুল বারিকে বলছেন, ‘সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।’ বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিন্তক ও লেখক ফিরোজ আহমেদের মতে, অতিবৃদ্ধ ভাসানী দু’পাশে দগ্ধ, রক্তাক্ত, ধর্ষিত বাংলাদেশকে নিয়ে হাঁটছেন– এই চিত্রটিই মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প, অথচ ‘জনপ্রিয়’ ইতিহাসে এই গল্পগুলি নেই। যেমন নেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নরসিংদী-সহ গোটা দেশে ভাসানী অনুগামীদের আশ্চর্য সংগ্রামের গল্পগুলি, নেই তাঁর অন্তরীণ হয়ে থাকা, নেই জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ কাদের বিরূপতার মুখে কেন পড়েছিল, সেই বৃত্তান্তও ৷
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এক আশ্চর্য ছবি এঁকেছিলেন মওলানার। বাংলার কৃষকের বহু শতক ধরে নির্যাতিত বুকের ওপর অভিভাবকের চাদরের মতো বিছিয়ে থাকবে ভাসানীর সেই ছবি। যতদিন সাম্রাজ্যবাদ থাকবে, যতদিন আধিপত্যবাদ থাকবে, যতদিন লুণ্ঠিত হবে বাংলার নদী, যতদিন কাঁটাতারে লাশ ঝুলবে বাঙালির, যতদিন দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণ-প্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম চলবে, ততদিন মওলানা ভাসানী প্রাসঙ্গিক থাকবেন। সরকারি বা দরবারি ইতিহাসের তোয়াক্কা না করেই তিনি রয়ে যাবেন বাংলার কৃষকের চৈতন্যে।