লালন ফকির, হাসন রাজা কিংবা নানা মহাজনের পদে আমরা তাঁদের ভনিতা শুনি। তাঁদের দর্শন লাভ তো আর সম্ভব নয়! অথচ ‘বাউল আবদুল করিম বলে দয়া করো আমারে/ নতশিরে করজুড়ে বলি তুমার দরবারে’ বলে যিনি মুর্শিদের দর্শনলাভের আর্জি জানাচ্ছেন, তিনি আমাদেরই সময়ে এই পৃথিবীর বাসিন্দা।
‘বাউল’ বললেই আমাদের চেতনায় কিছু বিশেষ শব্দ, বিশেষ ছবি তৈরি হয়। মনের মানুষ, দেহতত্ত্ব কিংবা একতারা আর গেরুয়া পোশাক। একথা সত্য যে, লালন ফকির কিংবা হাসন রাজার নাম শিক্ষিত বাঙালির অগোচরেই রয়ে যেত যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের কথা আমাদের না শোনাতেন। বাংলার বাউল সম্পর্কে তিনিই প্রথম আমাদের আগ্রহ তৈরি করেছেন। জীবনের একটা বড় সময় জুড়ে নানা রচনায়, গানে যে বাউল দর্শন তুলে ধরেছেন কবি, তার সঙ্গে তাঁর পরিচয় শিলাইদহ, কুষ্টিয়ায় থাকার সময়। বাংলাজুড়ে এই যে বাউল সাধনার ধারা, তার সৃষ্টিই হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপ্রতীপে। সুতরাং প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ বাউলের যাপনের আবশ্যিক শর্ত। ঠিক এই অবস্থানে দাঁড়িয়েই বাউল শাহ্ আবদুল করিমকে বুঝতে চেষ্টা করব।
কালনী নদী নানা পথে পাড়ি দিয়ে যেখানে বরাম হাওরে মিশেছে, সেইখানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো দূরে দেখা যায় কতগুলি গ্রাম। সেই খানেই দিরাই উপজেলার উজানধল। বাউল আবদুল করিমের বাসভূমি। সিলেটের এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য আজও কোথাও কোথাও নানা রঙের পালতোলা নৌকোই প্রধান সহায়। জীবনসংগ্রাম বড় কঠিন এখানে। একদা এই গ্রামেরই এক রাখাল বালক পেয়েছিল সেই অমোঘ ‘মন্ত্রণা’।
‘ভাবিয়া দেখ তোর মন
মাটির সারিন্দারে তোর বাজায় কোন জন।’
প্রৌঢ় বয়সে এক সাক্ষাৎকারে ‘ভাটির পুরুষ’ জানিয়েছিলেন সেকথা। বলেছিলেন, এই এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি বাউল হয়েছেন। সে সন্ধানের পথ সংগীতের পথ। গানই তাঁর জপমালা। গানেই তিনি প্রাণবন্ধুকে প্রত্যক্ষ করেন। অথচ সে পথে চলতে গিয়ে বাধা তো কিছু কম পাননি! গানবাজনা আপত্তিকর চর্চা বলে মানেন গাঁয়ের মাতব্বররা। নিদান দেওয়া হয় বন্ধ করতে হবে গান। সমস্যা এতদূর গড়ায় যে, প্রাণ বাঁচাতে প্রকাশ্যে সেকথা কবুল করে নিতে পরামর্শ দেন কেউ কেউ। করিম কিন্তু তাঁর উত্তর গানেই বলেন।
‘ইমাম বললেন, কিতা জি বাঁচতে এখনো পার।
তওবা করে বেশরা বেদাতি কাম ছাড়ো।।
সবার কাছে প্রথম বলো আমি এসব করব না।
আমি বললাম, সত্য বলি গান আমি ছাড়বো না।।’
ছোট্ট বয়সে দাদার কোলে বসে গান শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই বুঝি বাঁধা পড়েছিলেন সুরের মায়াজালে। রাগরাগিণীর তালিম যেমন পেয়েছিলেন, তেমনই পরবর্তীতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন কীর্তন কিংবা মালজোড়া গানের আসরে। আবদুল করিম তাঁর স্মৃতিতে যে শৈশবের ছবি এঁকে রেখেছেন, সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথাই উঠে এসেছে। গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের নওজওয়ানেরা মিলে বাউলা গান, ঘাটু গান গাইছে। পরস্পরের ঘরে নিমন্ত্রণে যাচ্ছে খেতে। এসব সুখের মনকেমন করা ছবি তাঁর গানে। আবার শৈশবে নাইট স্কুলে মাত্র ক’দিন যাওয়ার স্মৃতি থেকে মাস্টারমশাই সম্পর্কে ভীতির কথাও বলতে ভোলেননি।
বাউল শাহ্ আবদুল করিম– বাউল সংগীতের অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর শিষ্য, ভক্ত নেহাত কম নয়। গাঁয়ের মানুষের পাশাপাশি শহরের মানুষও তাঁর কথায়-সুরে মাতোয়ারা। হারমোনিয়াম, বেহালা আর তবলা সহযোগে যে গান এক বিশেষ দর্শনের পথ দেখায় সেই গানই আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে ক্যাসেট বন্দি হয়ে চলে যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। জনপ্রিয়তা তাঁকে নিয়ে গেছে সুদূর লন্ডনে অনুষ্ঠান করতে। পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’। এত সম্মান, এত ভালবাসা, অথচ করিমের দুর্দশা ঘোচে না। তাঁর ভাঙা ঘরের চাল বেয়ে জল পড়ে। স্ত্রী যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তাঁর চিন্তা ছিল না। ঘর ছেড়ে মাসের পর মাস উরসে, পরবে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। সরলার সস্নেহ প্রশ্রয়ে তাঁর বাউলজীবন পূর্ণতা পেয়েছে। চরম দারিদ্র স্বীকার করে বাউলের ঘর বেঁধেছেন এই সরল অথচ বুদ্ধিমতী নারী। প্রিয়তমা স্ত্রী সরলাকে নিয়ে গান লিখেছেন করিম সাহেব,
‘সরল তুমি শান্ত তুমি নুরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম দিছি সরলা’
কিন্তু তারপর?
‘কেন পিরীতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি?’
সরলার মৃত্যু বড় আঘাত দিয়েছিল করিমকে। স্ত্রীকে দাফন করেছিলেন নিজের ঘরে, সযতনে। মাতব্বররা সেদিনও তাঁকে আঘাত করতে ছাড়েনি। তিনিও ছাড়েননি তাঁর সরলাকে। আঁকড়ে রেখেছেন সারা জীবন।
এহেন যে সাধক তাঁর দর্শনটা ঠিক কী? তিনি কী বাউল গানের স্রষ্টা, নাকি আধুনিক চেতনার এক প্রতিবাদী সমাজ সংস্কারক? এ প্রসঙ্গে আলোচনায় প্রবেশ করতে হলে বলতে হবে আর একজনের কথা। তিনি বাংলার লোকসংগীতের শিল্পী-গবেষক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ছোট্টবেলা থেকে সাংগীতিক পরিবেশে মানুষ হওয়ার ফলে কালিকাপ্রসাদের বাড়িতে নানা রকম গান-বাজনার চর্চা ছিল। বিশেষ করে ছোটকাকা অনন্ত ভট্টাচার্যের ছিল লোকশিল্পীদের সঙ্গ করার নেশা। গান সংগ্রহ আর তাদের দর্শনে জারিত হতে হতে নিজেও অন্তরে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন। ছোটকাকার সঙ্গে রাতদিন সেইসব গানের সঙ্গ করতে করতে কালিকা কখন যে তা নিজের মধ্যে ধারণ করতে শুরু করেছিল, তা হয়তো সে নিজেও জানত না। হঠাৎ কোন নিঝুম রাতে শোনা, ‘তুমার কী মায়া লাগে না আমার দুঃখ দেখিয়া/ সোনাবন্ধুয়া রে, যত দুষি তুমার লাগিয়া’ তাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। ‘দোহার’ নামের গানের দলটির প্রতিষ্ঠা থেকে প্রতিটি অনুষ্ঠান এবং প্রকাশিত অ্যালবামে শাহ আবদুল করিমের গান হয়ে ওঠে আবশ্যিক। করিম সাহেবের তিরোধানের পর শহর কলকাতায় তাঁর স্মরণে যে অনুষ্ঠান হয়, তার উদ্যোগ ‘দোহার’-এর। অনুষ্ঠানের শুরুতে কালিকাপ্রসাদের গুরুবন্দনা, ‘ভাটির চিঠি লেখো বন্ধু উজানধলে বসে/ ভাটি উজান এক হয়ে যায় তোমার পরশে মুর্শিদধন হে’।
কলকাতা সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশে তাঁকে পরিচিত করানোর কৃতিত্ব কালিকাপ্রসাদের। গানের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে স্রষ্টার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ক্রমে আমরা তাঁকে বাউল শাহ্ আবদুল করিমের ভাবশিষ্য রূপে আবিষ্কার করি। ২০০১ সালে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে সিলেট যায় কালিকাপ্রসাদ। উদ্দেশ্য বাউল শাহ্ আবদুল করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ। মনে অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল। লালন ফকির, হাসন রাজা কিংবা নানা মহাজনের পদে আমরা তাঁদের ভনিতা শুনি। তাঁদের দর্শন লাভ তো আর সম্ভব নয়! অথচ ‘বাউল আবদুল করিম বলে দয়া করো আমারে/ নতশিরে করজুড়ে বলি তুমার দরবারে’ বলে যিনি মুর্শিদের দর্শনলাভের আর্জি জানাচ্ছেন, তিনি আমাদেরই সময়ে এই পৃথিবীর বাসিন্দা, এ-কথাটাই কালিকাকে আকর্ষণ করেছিল সবচেয়ে বেশি। ছোটবেলা থেকে সে শাহ্ আবদুল করিমের এত গান শুনেছে তাই তিনি জীবিত আছেন, এ খবর জানার পর থেকে মনের মধ্যে এক অস্থিরতা অনুভব করে সে। সেই সাক্ষাৎকারের কাহিনি বারবার শুনতে শুনতে আজ মনে হয় বুঝি সেসব কথা নিজের কানেই শোনা। মনেপ্রাণে ঈশ্বরভক্ত অথচ প্রচলিত ধর্মীয় আচার মানেন না। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাই তার বিবাদ। অথচ প্রশ্ন করলে বলেন, আল্লা কী এত ছোট, যে ওই উপর থেকে দূরবিন দিয়ে দেখবেন কে নামাজ রোজা রাখল আর কে রাখল না? তাঁর কি এত সময় আছে? নিজের গানের সুর পরিবর্তন কিংবা বিদেশি যন্ত্রের ব্যবহারেও তাঁর আপত্তি নেই তেমন। গানের বক্তব্য যাতে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে এটাই তাঁর লক্ষ্য। করিম শিষ্য রুহী ঠাকুর নিজে বেহালা বাজিয়ে গান করেন। করিম বলেন, এ বেহালা নয়, ভায়োলিনও নয়। এ হল ‘বেলা’। বাউল যেদিন বিদেশি যন্ত্রকে তার সাধনার সঙ্গে একাত্ম করে নেবে সেদিন তাকে নিয়ে আর কোন গোল থাকবে না। মঞ্চসফল গানের দল ‘দোহার’-এর যে কোনও অনুষ্ঠানে একটা সময় শ্রোতা দর্শক কালিকাপ্রসাদের কণ্ঠে ‘গাড়ি চলে না’ গানটি না শুনে ছাড়েনি। এই গানে করিম সাহেব দেহকে গাড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেহ গাড়ির এক একটা কলকবজা যখন বিকল হয়ে আসে, লাইটগুলো আর ঠিক করে জ্বলে না, তখন কনডেম গাড়ি নিয়ে কী করা যায় সেই দুশ্চিন্তায় পড়েন করিম। দীর্ঘ অসুস্থতাই হয়তো তাঁকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়।
ঈশ্বর বা আল্লার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা কেমন?
তিনি বলেন, তার সঙ্গে নাকি শত্রুতা। সেই যে সেদিন সে চলে গেল, আজও এল না।
‘আসি বলে গেলো বন্ধু আইলো না।
বাটাতে পান সাজায়া থুইলাম
বন্ধু আসিয়া খাইল না।’
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় এই বন্ধু নারী না পুরুষ? বলেন, স্রষ্টা তো নারীর মধ্যেই বেশি করে প্রকাশ পান। চমক লাগে, লোকটা বলে কী? আসলে কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতাতেই তাঁকে বাঁধা যায় না। তিনি বলেন, বাউলের গুরু মন্ত্র দেন না, মন্ত্রণা দেন। কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন তাঁর বিশ্বাস এই পৃথিবীটা একদিন বাউলের পৃথিবী হবে। কেমন সে পৃথিবী? কেমনই বা সে বাউল। যে কিনা মুর্শিদের কাছে অবলীলায় জবাবদিহি চাইতে পারে,
‘এই কি তোমার বিবেচনা, কেউরে দিলায় মাখনছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না
ভাঙ্গা ঘরে ছানি নাই
জান শুধু ভোগ বিলাস, জান গরীবের সর্বনাশ
কেড়ে নেও শিশুর মুখের গ্রাস, তোর মনে কি দয়া নাই?
জিগাস করি তুমার কাছে বলো ওগো সাঁই।’
মনে পড়ে যায় আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাউলের দর্শন তিনি প্রকাশ করেছিলেন আমাদের কাছে। লালন ফকিরের প্রতিবাদী ভূমিকাও তাঁর অজানা ছিল না। তাই বুঝি নিজের সৃষ্টিতে যখন বাউলের চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন, তখন তাকে করে তুলেছিলেন ধনঞ্জয় বৈরাগী। মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকতার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাউলের সাধনা এক প্রতিস্পর্ধী উচ্চারণ। সেখানেই তার শক্তি। সেখানেই তার বিশেষত্ব। আজকের সময়ে সমাজ সংসারের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রশ্ন করার মতো একজন শাহ্ আবদুল করিমের বড্ড প্রয়োজন।
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।