Robbar

হাতে কলম তুলে নেওয়ার ‘ম্যাডনেস’ই অদ্রীশ বর্ধনকে লেখায় ফিরিয়ে এনেছিল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 19, 2024 8:53 pm
  • Updated:May 20, 2024 6:46 pm  

অদ্রীশ বর্ধন কি নিছক একজন কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সম্পাদক-প্রকাশক? কখনওই এটুকুতে বাঁধা যাবে না তাঁকে। রণেন ঘোষ, দিলীপ রায়চৌধুরীর মতো অসংখ্য তরুণকে তিনি লেখার উৎসাহ দিয়েছেন। কী লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে সেই পথের দিশা দিয়েছেন। বাংলায় যাতে লোকে কল্পবিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী হয়, তার জন্যও কী না করেছেন! নিজেই স্কুটার চালিয়ে এলাহাবাদে চলে গিয়েছিলেন পত্রিকার ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য। চেয়েছেন যত বেশি মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দিতে। আবার এই কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লাগাতার লিখেও গিয়েছেন।

বিশ্বদীপ দে

৪, রামনারায়ণ মতিলাল লেন। একটা আলো-আঁধারি ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সামান্য ক’টা ধাপের ওপারেই দরজা ও কলিংবেল। তার আগে এই সামান্য বিরতি।

Adrish Bardhan (1932-2019): The writer who built the culture of Bengali science-fiction
অদ্রীশ বর্ধন

দল বেঁধে এসেছি বাড়িটায়। অবশ্যই ফোন করে। ফোনের ওপারের একটা গম্ভীর স্বর সময় বেঁধে দিয়েছে। সেইমতো এসে পড়া। তবু কলিংবেল বাজানোর আগের মুহূর্তে অবাক লাগছিল। আসলে অদ্রীশ বর্ধন মানেই আলো-আঁধারি ‘আশ্চর্য-ফ্যান্টাসটিক’ সব অনুভব। বইমেলায় তাঁকে দেখেছি। আমার বাড়িয়ে দেওয়া বইয়ে গম্ভীর মুখে অন্যমনস্ক সই দিয়েছেন ব্লেজার পরিহিত গম্ভীরদর্শন মানুষটি। কিন্তু সেখানে একটা আড়াল ছিল। মেলার ভিড়ের আড়াল। আজ প্রথমবার ওঁর সত্যিকারের মুখোমুখি হব। মধ্যরাত হোক বা ছুটির দুপুর, যাঁর লেখার রোমাঞ্চ আমাকে সিলেবাস শেষ করতে বাধা দিয়েছে ছাত্রজীবনে, তাঁর প্রতি সম্ভ্রমের এমন কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে! ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে সেটাই সামলে নিচ্ছিলাম। আবার একটা ভয়ও কাজ করছিল। লোকটা যা গম্ভীর!

কিন্তু সব কিছু যেন বদলে গেছিল মুহূর্তে। দেখলাম গম্ভীর লোকটা তদ্দিনে ভ্যানিশ! আমাদের সামনে একজন সদালাপী, রসস্নিগ্ধ মানুষ! লম্বা সাদা দাড়িতে খানিক উদাসীনও। কেবল শোনার সামান্য সমস্যা ছাড়া শরীর তখনও চনমনে। সেটা ২০০৯ সাল। বন্ধুরা মিলে একটা গদ্য পত্রিকা করব ভাবলাম। ‘ক’ নামের সেই পত্রিকার জন্যই অদ্রীশ বর্ধনের সাক্ষাৎকার নেওয়া। কিন্তু কতটুকু আর ধরাতে পেরেছিলাম লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়! প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টা ধরে নিজের জীবনের এমন সব কথা তিনি বলেছিলেন… সাক্ষাৎকার শেষে কথা দিতে হয়েছিল সবটা লিখব না। ‘মনে রেখে দেব’। নিজের ছোটবে‌লার এক নায়ককে সেদিন নতুন করে চিনেছিলাম। সমমনস্ক ‘বন্ধুদের’ পেয়ে আশি ছুঁই ছুঁই মানুষটা অনেক কথা বলে ফেলেছিলেন। আরও কিছু যাতে বলতে না হয় তাই হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলেছিলেন, ‘অ্যাই, তোমরা আর বকিও না এই বুড়োটাকে। আমার খিদে পেয়েছে।’

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

নিজেই মজা করে বলেছিলেন, ‘‘বোম্বেতে থাকার সময় ‘প্রসাদ’ পত্রিকার গল্প প্রতিযোগিতায় একটা গল্প পাঠিয়ে দিলাম। ‘আমার বান্ধবী সুনন্দা’। ও মা! রেজাল্ট বেরলে দেখি সেই গাঁজা গল্পটাই ফার্স্ট হয়েছে। পরে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ড্রয়ার খুলে একমুঠো টাকা তুলে আমাকে দিলেন। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ কিন্তু স্রেফ লিখে তিনি সন্তুষ্ট থাকলে তো! সাতবার চাকরি ছেড়েছেন। তারপর বাড়িতেই প্রেস বসিয়ে পত্রিকা বের করতে শুরু করলে‌ন।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

 

Edgar Allen Poe Rachana Sangraha, (Vol--1 & 2) Set Of To Books. By Adrish Bardhan: Buy Edgar Allen Poe Rachana Sangraha, (Vol--1 & 2) Set Of To Books. By Adrish Bardhan by

সেই শুরু। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বারবার। পরে আর এক পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আরও নানা ছুতোয় গিয়ে পড়েছি সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে। যদিও পরের দিকে স্মৃতির ফিতে ক্রমশ জড়িয়ে গিয়েছিল। শ্রবণশক্তি যন্ত্র দিয়েও আর জোরালো করা যাচ্ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস কখনও ফিকে হতে দেখিনি। সেটা হল অদম্য জীবনীশক্তি। বেঁচে নেওয়ার এই জেদ, কাজ করে যাওয়ার তাগিদ অবিশ্বাস্য। দেখেছি অথর্ব হতে চলা অবস্থাতেও নিজের খাটের পাশে রাখা চেয়ার-টেবিলে বসে মগ্ন হয়ে লিখছেন!

Biswasera Science Fiction By Adrish Bardhan: Buy Biswasera Science Fiction By Adrish Bardhan by ADRISH BARDHAN at Low Price in India | Flipkart.com

আসলে এই বিপুল প্রাণশক্তি ও পজিটিভিটি ছাড়া গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় ‘আশ্চর্য’ বের করার পরিকল্পনা করা সম্ভবই ছিল না। ততদিনে কলম তরতরিয়ে চলতে শুরু করেছে। নিজেই মজা করে বলেছিলেন, ‘‘বোম্বেতে থাকার সময় ‘প্রসাদ’ পত্রিকার গল্প প্রতিযোগিতায় একটা গল্প পাঠিয়ে দিলাম। ‘আমার বান্ধবী সুনন্দা’। ও মা! রেজাল্ট বেরলে দেখি সেই গাঁজা গল্পটাই ফার্স্ট হয়েছে। পরে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ড্রয়ার খুলে একমুঠো টাকা তুলে আমাকে দিলেন। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ কিন্তু স্রেফ লিখে তিনি সন্তুষ্ট থাকলে তো! সাতবার চাকরি ছেড়েছেন। তারপর বাড়িতেই প্রেস বসিয়ে পত্রিকা বের করতে শুরু করলে‌ন। সেই সময় বাংলায় কেন ভূভারতে ওই ধরনের লেখালেখির তেমন কোনও পাঠকই ছিল না। তবু তাঁকে কল্পবিজ্ঞান (তখনও ওই শব্দবন্ধ চালুই হয়নি। অদ্রীশ নিজেই পরে সায়েন্স ফিকশনের এমন বাংলা করেন) পত্রিকাই করতে হবে! কিন্তু লেখকই বা কই? সম্পাদক হিসেবে নিজের নাম রাখেননি প্রথমে। আকাশ সেন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। নিজের নামে লিখলেন। পাশাপাশি আরও বানানো নামে লিখতেন। এজন্য নাকি এক পুলিশকর্তা তাঁকে মৃদু ধমক দিয়েছিলেন বাড়িতে এসে। উৎসাহী যুবককে বুঝিয়েছিলেন, সম্পাদকের নাম ছদ্মনাম হিসেবে রাখা যায় না।

ASAJHYA SUSPENSE SAMAGRA [Hardcover] ADRISH BARDHAN

যাই হোক, দেশের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকার সঙ্গে ক্রমেই জড়িয়ে পড়েন লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতো মানুষেরা। তারপর একদিন তিনি ফোন করে বসলেন সত্যজিৎ রায়কে! দেখা করতে চাইলেন। সটান জানিয়ে দিলেন, ‘আপনাকে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করতে চাই। তাহলে পত্রিকা আরও ভালো বিক্রি হবে।’ কোনও ভণিতা না করে সরাসরি এমন কথা বলাটাই মুগ্ধ করেছিল সত্যজিৎকে। দ্রুত জন্ম নিয়েছিল এক অসমবয়সি বন্ধুত্ব। এক নবীন সম্পাদক-লেখকের চোখের দীপ্তি ও সততাকে চিনতে ভুল হয়নি বিশ্ববরেণ্য মানুষটির। পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক তো তিনি ছিলেনই। পরে অদ্রীশের উদ্যোগে ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনিই হন প্রেসিডেন্ট। এমনকী তাঁর না হওয়া ছবি ‘অবতার’-এর পরিকল্পনা নিয়েও ‘আশ্চর্য’র জন্য দু’টি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। নিজের প্রবল ব্যস্ততা সামলে লেখা দিয়েছেন। দিতেন নানা আইডিয়াও। আসলে কল্পবিজ্ঞান নামের একটা সেতু সেদিন মিলিয়ে দিয়েছিল দু’জনকে।

গোটা ছয়ের দশকটা দাপিয়ে পত্রিকা করার পর আচমকাই তীব্র এক ব্যক্তিগত শোক আছড়ে পড়ে অদ্রীশের জীবনে। লেখা বা পত্রিকা থেকে বহু দূরের কক্ষপথে তখন তিনি। বিয়ের মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই আকস্মিক ক্যানসার ধরা পড়ে স্ত্রীর। একেবারে ফোর্থ স্টেজ। কয়েকদিনের মধ্যেই সব শেষ। পুত্র জয় তখন এক বছরের! বন্ধ হয়ে গেল ‘আশ্চর্য’। জানা যায়, ওঁর দাদা অসীম বর্ধন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। অদ্রীশ সেই সময় শোকের তীব্রতায় চলচ্ছক্তিহীন। শয্যাশায়ী অদ্রীশ আর ফিরতে পারবেন না বলেই ব্যথিত চিত্তে ধরে নিয়েছিলেন তাঁর অনুগামীরা। রণেন ঘোষ, অমিতানন্দ দাশ, অনীশ দেবরা মিলে বের করলেন আরেক কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘বিস্ময়’। কিন্তু সেই পত্রিকা ছিল একেবারেই স্বল্পায়ু।

শেষপর্যন্ত কীভাবে বিছানায় উঠে বসার শক্তি পেয়েছিলেন অদ্রীশ বর্ধন? দুগ্ধপোষ্য শিশুর সহায় হয়ে ওঠার চেয়েও বুঝি হাতে কলম তুলে নেওয়ার ‘ম্যাডনেস’ই ফের সুস্থ করে তোলে তাঁকে। নিজেই বলেছিলেন সেই কথা। জানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় এক সংলাপের কথা। ‘স্যর ইউ হ্যাভ এভরিথিং, এক্সেপ্ট ম্যাডনেস।’ এই ‘দৈব’ পাগলামিই অদ্রীশ বর্ধনকে ফের জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়েছিল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে লিখতে বসতেন। পাশেই ঘুমন্ত ছোট্ট ছেলে। অদ্রীশ ডুব দিতেন জুল ভের্ন অনুবাদে। লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘তখন নিশীথ রাত্রি’। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করলেন নতুন পত্রিকা ‘ফ্যান্টাসটিক’। শুরু হয় প্রকাশনাও। ধীরে ধীরে আরও বেশি কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।

জগদানন্দ রায়, জগদীশচন্দ্র, বেগম রোকেয়ার হাতে শুরু হয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘পিঁপড়ে পুরাণ’ বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে (আগেই বলেছি ওই শব্দবন্ধ তখন যদিও ছিল না) শুরুতেই উঁচু তারে বেঁধে ফেলে। পরে সত্যজিৎ শঙ্কু কাহিনি লিখলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র তো পরবর্তী সময়ে অসংখ্য লেখাই লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের সকলের কথা মাথায় রেখে বলতেই হবে ‘আশ্চর্য’ শুরু করে অদ্রীশ এই ধারার সাহিত্যকে এপার বাংলায় এমন একটা ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছিলেন, যেটা বাদ দিয়ে বঙ্গ-কল্পবিজ্ঞানকে কল্পনাই করা যায় না।

অদ্রীশ বর্ধন কি নিছক একজন কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সম্পাদক-প্রকাশক? কখনওই এটুকুতে বাঁধা যাবে না তাঁকে। রণেন ঘোষ, দিলীপ রায়চৌধুরীর মতো অসংখ্য তরুণকে তিনি লেখার উৎসাহ দিয়েছেন। কী লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে সেই পথের দিশা দিয়েছেন। বাংলায় যাতে লোকে কল্পবিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী হয়, তার জন্যও কী না করেছেন! নিজেই স্কুটার চালিয়ে এলাহাবাদে চলে গিয়েছিলেন পত্রিকার ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য। চেয়েছেন যত বেশি মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দিতে। আবার এই কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লাগাতার লিখেও গিয়েছেন। মৌলিকের পাশাপাশি অসংখ্য অনুবাদ। বাংলা লাভক্র্যাফট চর্চার পথিকৃত তিনি। শার্লক হোমস থেকে জুল ভের্ন, ‘ব্ল্যাক হোল’ নামের সিনেমাটির কাহিনি নিয়ে উপন্যাস… কত বলা যায়! অসংখ্য, অজস্র… তবে তাঁর সব লেখাই কি ভালো লাগে? সব অনুবাদই সমান মসৃণ? তা হয়তো নয়। অবশ্য সেটা ক’জন লেখকের ক্ষেত্রেই বা বলা যায়? কিন্তু সব মিলিয়ে তাঁর এই বিপুল কর্মকাণ্ডের সিংহভাগই সোনালি আলোয় মোড়া। না হলে শেষ অবস্থায় চিকিৎসক পর্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেলেন, ‘আরে এই মানুষটা অদ্রীশ বর্ধন! উনি যে আমার ছোটবেলার হিরো। পাগল হয়ে যেতাম ওঁর লেখা পড়ে।’ দেখতে দেখতে তিন বছর হল তাঁর প্রয়াণের। তবু বাংলা ভাষার পাঠকের হাতে আজও ঝলমল করে তাঁর বই। বালিশের পাশে বা বইয়ের তাকে উঁকি দেয় নতুন করে মুদ্রিত হওয়া হারিয়ে যাওয়া রচনা। যার পাতায় পাতায় আজও থরথরিয়ে কাঁপছে ‘ম্যাডনেস’!