আজকের ভারতের দলিত পরিসরের ট্র্যাজেডি যে, দলিতের বড় অংশ নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার সময় ব্রাহ্মণ্যবাদের হাজার বছরের নিপীড়নের কথা বলছে, অথচ দলিত রাজনীতির আদর্শ মেনে বর্তমান ভারতে মুসলমানের পাশে না দাঁড়িয়ে, হিন্দুত্ববাদের হাত শক্ত করে চলেছে।
আম্বেদকর যে ভবিষ্যতের ভারতের কথা ১৯৫০ সালে বসে ভেবেছিলেন, আজকের ভারত যে তাঁর ভাবনার থেকে অনেক দূরের ভারত, তা স্বীকার করে নিতে হবে। আজকের ভারতের এই অবস্থার পিছনের কার্যকারণ খুঁজতে গেলে শুধুমাত্র যদি পুঁথি পড়ার মতো ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদ বলে চলি আমরা, তাহলে বোধহয় ইচ্ছে করে খানিক চোখ বন্ধ করে থাকা হয়।
১৯৯০ পরবর্তী হিন্দুত্ববাদ, যা বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে রামমন্দির গড়াকে ভারতীয় সাফল্য বলে প্রচার করে চলেছে, তা শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদ দিয়ে নির্মাণ করা অসম্ভব ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নিজেদের ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ এজেন্ডাগুলি ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তী সময় থেকেই লুকোতে শুরু করে। নিজেদের হিন্দুত্ববাদী পরিসর বাড়ানোর জন্য সাবর্ণ পরিচিতি ছেড়ে সংগঠনের তৃণমূল স্তরে দলিতায়ন শুরু হয়। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩২ সাল অবধি সময় আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে খুব আশ্চর্যজনক মনে হয়। ১৯২৪ সালে আম্বেদকরের নেতৃত্বে মাহার আন্দোলন শুরু হয়, যা ভারতের বেশিরভাগ অত্যাচারিত জাতিকে একটি পরিসরভুক্ত করে। এই পরিসর পরবর্তীতে ‘দলিত পরিসর’ হিসাবে চিহ্নিত হয় এবং এই পরিসর ১৯৩২ সালের আগে অবধি নিজেদের হিন্দু পরিসরের অন্তর্ভুক্ত করেনি। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই দলিত ও আরএসএস অবস্থান বিপ্রতীপ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক এবং তা সুদীর্ঘকাল বিপ্রতীপই ছিল। নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলিত পরিসর হিন্দু পরিসরের বাইরেই থাকার কথা ছিল ১৯৩০ সালের গোলটেবিল বৈঠকের সিধান্ত অনুযায়ী। কিন্তু দলিত পরিসরের নির্বাচন হিন্দু পরিসরের বাইরে থাকলে সাবর্ণ হিন্দুর কংগ্রেসি ঘরানার রাজনৈতিক প্রাধান্য সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে– এই আশঙ্কায় মহাত্মা গান্ধী ১৯৩২ সালে পুণাতে জেলে অন্ত্যরীণ থাকাকালীনই দলিত পরিসরকে হিন্দু পরিসরভুক্ত করতেই হবে এই দাবিতে আমৃত্যু অনশন শুরু করেন। গান্ধীজির শারীরিক অবস্থা ক্রমাবনতি হতে থাকায় আম্বেদকরের ওপর কংগ্রেস থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয় রফা সূত্র খুঁজতে। নিজের দাবিতে তবুও অনড় থাকতে চাওয়া আম্বেদকর সেপ্টেম্বর মাসে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মদন মোহন মালব্যের চাপে নতি স্বীকার করে ২৪ সেপ্টেম্বর ‘পুণা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে নির্দিষ্ট কিছু আসন দলিতদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, এর বিনিময়ে দলিত পরিসর নিজেকে হিন্দু পরিসর থেকে ভিন্ন দেখাবে না, যেমন ভিন্ন মুসলমান, শিখ ও খিস্টান পরিসর। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হয় মহাত্মা গান্ধীর অনশনের সামনে এই নতি স্বীকারই ছিল ভারতীয় দলিতের হিন্দুত্ববাদী হয়ে ওঠার বীজভূমি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের দাবিতে তবুও অনড় থাকতে চাওয়া আম্বেদকর সেপ্টেম্বর মাসে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মদন মোহন মালব্যের চাপে নতি স্বীকার করে ২৪ সেপ্টেম্বর ‘পুণা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে নির্দিষ্ট কিছু আসন দলিতদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, এর বিনিময়ে দলিত পরিসর নিজেকে হিন্দু পরিসর থেকে ভিন্ন দেখাবে না, যেমন ভিন্ন মুসলমান, শিখ ও খিস্টান পরিসর।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
আম্বেদকর জানতেন যে, হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী করা ছাড়া কংগ্রেসের আর কোনও দায় নেই দলিত পরিসরের প্রতি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাৎকারের সময় তিনি তাই কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন: নিয়মিত কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্রাহ্মণ, দলিত একসঙ্গে বসে পঙক্তিভোজন, জাতীয়তাবাদী, উচ্চশিক্ষিত কংগ্রেসি ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোয় একজন করে দলিত সন্তানের বড় হয়ে ওঠা ও শিক্ষাচর্চা ইত্যাদি। গান্ধীজি তখন সমস্ত প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও, শুধুমাত্র নিজে একজন দলিতকে দত্তক নেওয়া ভিন্ন আর একটি প্রস্তাবকেও রূপায়িত করতে সাহায্য করেননি। ফলে অভিজাত উদারপন্থী শিক্ষিত সাবর্ণ কংগ্রেসি শ্রেণির সঙ্গে ভারতীয় দলিত পরিসর ‘পুণা চুক্তি’ মেনে হিন্দু হলেও, হিন্দুত্বের রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী তিনটি দশক নিজেদের দূরে সরিয়েই রেখেছিল। বাংলার ক্ষেত্রে যোগেন মণ্ডলের রাজনীতিও সেই দূরত্বেরই পরিচয় দেয়। আম্বেদকর সাবর্ণদের এই ঘৃণা আন্দাজ করেই ভারতীয় সংবিধানে দলিতকে কিছু রক্ষাকবচ দেন, যা না থাকলে দলিতের যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তাও হত না। সংবিধানে বলা রয়েছে যে, ভারতীয় নাগরিক একজন দলিতকে হোটেলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে,পথেঘাটে, অলিতে গলিতে, জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষের কোনও পরিবহণে কোনও না কোনওভাবে অচ্ছুৎ প্রতিপন্ন করবেন বা কোনও না কোনওভাবে অপরায়িত করবেন সেই ভারতীয় নাগরিককে জরিমানা সহ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ দলিতকে দেওয়া হল রক্ষাকবচ, যাতে সে মানুষের জীবন বাঁচতে পারে। আম্বেদকরের এই রক্ষাকবচ দলিতকে খানিক বাতাস ধার দিল শ্বাস নেওয়ার জন্য। ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ মানতে বাধ্য হল লেখাপড়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দলিতের প্রবেশাধিকার। ইন্দিরা গান্ধীর ‘এমার্জেন্সি’র প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে যখন জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রভাবে উত্তর ভারতে লালুপ্রসাদ যাদব-সহ শক্তিশালী দলিত স্বর গড়তে শুরু করেছে এবং মণ্ডল কমিশনের আবহে যখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে দলিত পরিসর আগামীর ভারতে শুধু সংখ্যায় নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবেও একটি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে চলেছে, তখনই আরএসএস নিজেদের জন্মজাত মতাদর্শকে লুকিয়ে ১৯৩০-এর সময়কালের কংগ্রেসি জুতোয় পা গলায়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: নকশিকাঁথার সুতোয় বিনুনি কেটে আবার বাঙালি কি আঁকবে এক সম্প্রীতির নকশিকাঁথা?
……………………………………………………………………………………………………………………………………
কংগ্রেসি এলিটদের চেয়ে আরএসএসের মেশিনারি অনেক বেশি আগ্রাসী ও তৃণমূল স্তরে কাজকর্মে পারদর্শী হওয়ায় দলিত পরিসরের একটি বড় অংশের চরিত্রের অভিমুখ পাল্টাতে থাকে। আরএসএস-এর জাতে ব্রাহ্মণ সেবকরা দলিত গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে অখণ্ড হিন্দু পরিসর গঠনের কথা বলতে থাকে, জাতপাতের বেড়া ডিঙিয়ে। এই ছদ্ম-আম্বেদকরবাদী স্বরকে অনেক ক্ষেত্রে আম্বেদকরবাদীও মনে হতে শুরু করে দলিতের। আরএসএস পরিচালিত ইশকুলগুলি গত শতাব্দীর আটের দশক থেকেই আরেকটি কাজ তনিষ্ঠভাবে করতে থাকে। দলিত এলাকার ইশকুলগুলিতে সংস্কৃত ভাষা শেখানো এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রগুলির অলংকারময় ভাষার সুবিধা নিয়ে সুবিধাজনক পাঠাভ্যাস গড়ে তোলানো, যাতে একজন দলিত হিন্দু পরিসরে অস্বস্তি না পায়। এই অস্বস্তির জায়গাটি তৈরি করা হয় মুসলমান পরিসরকে ঘিরে। দেশভাগজনিত ট্রমাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এবং ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানকে প্রায় ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্রাহ্মণ’-এর সারোগেট করে তোলা হয়। ভারতীয় দলিতের মধ্যবিত্ত অংশটি ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যবাদী আচারগুলি নিজের রোজকার জীবনে ও নিজেদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচরণে ঢুকিয়ে ফেলে। ফলে দলিত পরিসর ও হিন্দু পরিসর যা একসময় প্রায় বিপরীতমুখী ছিল, তা ভারতের নয়া হিন্দু পরিসরের হনুমান পূজা, রামনবমী এবং রামমন্দিরের স্বপ্ন দিয়ে কাছাকাছি আসতে শুরু করে। দলিত পরিসর, হিন্দু পরিসরের যত কাছাকাছি আসতে শুরু করে, ততই আম্বেদকরের মূল সুর বিরোধী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান নিয়ে আম্বেদকরের রাজনৈতিক অবস্থান পরবর্তীতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হবে আশঙ্কা করেই ১৯৭২ সালে দলিত প্যান্থার আন্দোলনের ম্যানিফেস্টোতে দলিতের সংজ্ঞা নয়াভাবে দেওয়া হয়েছিল। ‘দলিত প্যান্থার’-এর ম্যানিফেস্টোতে লেখা হয়: ‘দলিত’ শব্দটি দিয়ে তফসিলি জাতি, উপজাতি, আদিবাসী, নয়া-বৌদ্ধ, খেটে খাওয়া মানুষ, জমিহীন মানুষ, দরিদ্র চাষি, নারী এবং যারা কোনও না কোনওভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ভাবে নিপীড়িত হচ্ছে, তাদের প্রত্যেককে বোঝানো হবে।’ (সূত্র: Literary Vista, Volume IV , Ed. Chitra Pannikar. Bangalore: Prasarnga Press, 2013)।
এখানেই আজকের ভারতের দলিত পরিসরের ট্র্যাজেডি যে, দলিতের বড় অংশ নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার সময় ব্রাহ্মণ্যবাদের হাজার বছরের নিপীড়নের কথা বলছে, অথচ দলিত রাজনীতির আদর্শ মেনে বর্তমান ভারতে মুসলমানের পাশে না দাঁড়িয়ে, হিন্দুত্ববাদের হাত শক্ত করে চলেছে। ‘পুণা চুক্তি’র প্রেত যেন আম্বেদকরের রাস্তা থেকেই দলিতকে সরিয়ে দিয়েছে।