ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে লক্ষ করব যে, যে জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ রাষ্ট্রগুরুর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, অর্থাৎ তদানীন্তন সরকারের সঙ্গে স্যর সুরেন্দ্রনাথের সহযোগিতা, পরবর্তী পর্যায়ে দেশবন্ধু নিজেই তাঁর ভুল স্বীকার করে ১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি?
২৪ নভেম্বর, ১৯২৩। ‘বেঙ্গল কাউন্সিল’-এর নির্বাচনের দিন। রাষ্ট্রগুরু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন-সংস্কার অনুযায়ী, তখন বাংলার প্রাদেশিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। এই নির্বাচনেই তিনি ছিলেন একজন প্রার্থী এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বরাজ্য দলের তরুণ নেতা প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধানচন্দ্র রায়।
আসল লড়াই কিন্তু অন্য জায়গায়। লড়াই প্রবীণ নরমপন্থী নেতা সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বরাজ্যদলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। যে সুরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে স্যর হেনরি কটন এক সময়ে লিখেছিলেন যে, মুলতান থেকে ঢাকা– ভারতের সর্বত্র যাঁর নামমাত্রেই জাগ্রত জনগণের মধ্যে আলোড়ন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। কিন্তু তাঁর ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণকে দেশবন্ধু-সহ অন্য অনেক নেতাই কেবল পছন্দ করেননি, তাই নয়, তাঁরা ভেবেছিলেন যে, এর দ্বারা সুরেন্দ্রনাথ জাতীয় আন্দোলনের প্রতি অবিচারই করেছেন। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে ইতিহাস বলছে যে, সুরেন্দ্রনাথের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু সেই সময়ে দেশবন্ধু-সহ চরমপন্থী নেতারা এর প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারেননি এবং সেই জন্য এই নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথকে পরাজিত করতে তাঁরা একজোট হয়েছিলেন।
নির্বাচন কেন্দ্র ছিল অ-মুসলিম নির্বাচন ক্ষেত্র– অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার উত্তর অংশের পুর এলাকাগুলি অর্থাৎ, কাশীপুর থেকে কাঁচড়াপাড়া। প্রায় দৈর্ঘ্যে ৩০ মাইল থেকে প্রস্থ ৬ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। ভোট গ্রহণ হয় দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা ৩২টি বুথে। এই নির্বাচন জনমানসে কী রকম সাড়া জাগিয়েছিল, তা বোঝা যায় সেই সময়ে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট পড়া নিয়ে।
নির্বাচনে জয়লাভের জন্য দু’-পক্ষই যত প্রকার পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়, তা করেছিল এবং উভয় পক্ষই নির্বাচন ক্ষেত্রটিকে নানাভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কখনও পদযাত্রা করে, ভোটারদের কাছে নানা প্রতিশ্রুতি ও আশা দিয়ে, কখনও নানা রকমের পোস্টারে এলাকা ভরিয়ে দিয়ে, আবার কখনও ছোট পুস্তিকা, লিফলেট ভোটারদের মধ্যে বিলি করে। কোনও পক্ষের অর্থ কিংবা কাজের লোকের অভাব ছিল না এবং ভোটের দিন মোটরগাড়ির যাতায়াত ও আওয়াজ গ্রামগঞ্জের মানুষজন ও ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
স্যর সুরেন্দ্রনাথের গাড়িগুলোয় হলুদ পতাকা লাগানো ছিল এবং পতাকাগুলির দু’পাশে ‘বন্দে মাতরম্’ মন্ত্রটি মুদ্রিত ছিল। ডা. বিধানচন্দ্র রায় বা স্বরাজ্য দলের পতাকা ছিল তেরঙা এবং সেগুলোতে লেখা ছিল ‘দেশবন্ধুর অনুরোধে ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে আপনারা ভোট দিন।’ স্যর সুরেন্দ্রনাথের দলের অনুগামীরা গলায় গোলাপি পুঁথির মালা পরেছিল, আর স্বরাজীদের গলায় ঝুলছিল পিচবোর্ডের ওপর আঁকা রেডক্রসের চিহ্ন ও তাকে ঘিরে লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম্’ ও ‘লোকশক্তি’।
স্বরাজী স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রচার করেছিলেন যে, ‘স্যর সুরেন্দ্রনাথ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই তাঁকে একটি ভোটও নয়। বাংলা আশা করে ব্যারাকপুর তার কর্তব্য করবে, অর্থাৎ স্যর সুরেন্দ্রনাথকে পরাজিত করে ডা. বিধানচন্দ্রকে জয়যুক্ত করবে।’ যাঁরা কাউন্সিল প্রবেশের বিরোধী ছিলেন তাঁরা ভোট বয়কটের জন্য প্রচার করেছিলেন। কারণ স্বরাজীরা কংগ্রেসের পরামর্শ না মেনে এবং অসহযোগের নীতি অমান্য করে নির্বাচনে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁদের আরও আবেদন ছিল যে, মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে যখন জেলে আটক রাখা হয়েছে তখন নির্বাচন বয়কট করাই উচিত। অর্থাৎ, নানাভাবে নির্বাচন বেশ জমে উঠেছিল এবং নির্বাচনের দিন সকাল ৭.৩০ মি. থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বহু ভোটার তাঁদের ভোট প্রদান করেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য উৎসাহে একটু ভাটা পড়ে। বেশি ভোট পড়ে কাশীপুর, চিৎপুর, বরানগর, টিটাগড় ও ব্যারাকপুরে। নৈহাটি ও দমদমে আশানুরূপ সাড়া কিন্তু লক্ষ করা যায়নি। এই দুই স্থানে দু’-পক্ষেরই নির্বাচনী লোকজন কম ছিল। তবে অনেক ছাত্র স্যর সুরেন্দ্রনাথকে ভোট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভোটারদের কাছে আবেদন জানাচ্ছিল। সম্ভবত সুরেন্দ্রনাথের ছাত্র-প্রীতি ও তাদের কল্যাণের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা হয়তো এর মুখ্য কারণ। অবশ্য কাশীপুরে প্রায় দু’শো মেডিক্যাল ছাত্র ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্য প্রচারে অংশগ্রহণ করে।
কাশীপুর পুরসভা কার্যালয়ে সভায় সুরেন্দ্রনাথের লোকজন ভোটারদের কাছে আবেদন করেছিল ‘বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে ভোট দিন’। এখানে ভোট হচ্ছিল দোতলায় এবং সিঁড়িতে দু’-পক্ষই ভোটারদের টানাটানি করছিল। টিটাগড় ভোটকেন্দ্রে বেশিরভাগ ভোটার দিয়েছিল আশপাশের মিল থেকে আসা অশিক্ষিত মজুররা। তারা বলাবলি করছিল যে, তারা ডাক্তারবাবুকে ভোট দিতে এসেছে কারণ তিনি ‘জনগণের লোক’ এবং ‘দেশের সেবা করেন’। বরানগর ও নৈহাটিতে ভোট চলাকালীন কিছু গন্ডগোলের আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে দেশবন্ধুর উপস্থিতির জন্য গন্ডগোল বেশি বাড়তে পারেনি। অবশ্য কোনও কোনও স্থানে উৎসাহী জনগণের মধ্যে হাতাহাতি বাঁধে। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় তা বেশিদূর গড়াতে পারেনি। এরকমও ঘটনা ঘটেছিল, কাশীপুরে একটি বাড়িতে পুত্র পিতার বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দান করে এবং এক নেতা স্যর সুরেন্দ্রনাথকে ভোট দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতিবেশীকে মাঝ পথে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন।
ভোটের দিন যেসব রাজ্য ও জাতীয় স্তরের নেতাগণ বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন, ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের পক্ষে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, সুভাষচন্দ্র বসু, তুলসীচরণ গোস্বামী, সন্তোষকুমারী গুপ্তা প্রমুখ এবং স্যর সুরেন্দ্রনাথের পক্ষে মাননীয় প্রভাষচন্দ্র মিত্র, মেজর হাসান সুরাবর্দি, প্রিয়নাথ সেন, রায়বাহাদুর ফণীন্দ্রনাথ দে, রায়বাহাদুর কৃপানাথ দত্ত প্রমুখ। স্যর সুরেন্দ্রনাথ ও ডা. বিধানচন্দ্র দু’জনেই বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন এবং দু’জনকেই খুশি দেখাচ্ছিল ও উভয়েই নিজ নিজ জয় সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পূর্বে স্যর সুরেন্দ্রনাথের লোকজনরা বরানগর, কাশীপুর, ভাটপাড়া প্রভৃতি ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে আসে, কারণ তাদের ধারণা হয়েছিল যে, ডা. বিধানচন্দ্র এই সব কেন্দ্রে অনেক ভোট পাবেন।
৩০ নভেম্বর, ১৯২৩ আলিপুর থেকে যখন ব্যারাকপুর নির্বাচন ক্ষেত্রের ফল ঘোষণা করা হল তখন দেখা গেল ডা. বিধানচন্দ্র ৩৪০৫ ভোটে স্যর সুরেন্দ্রনাথকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এক সময়ের ‘মুকুটহীন রাজা’ তাঁরই প্রতিবেশীদের দ্বারা পরাজিত হলেন। এই পরাজয়ের কারণ সম্বন্ধে রাষ্ট্রগুরু স্বয়ং লিখেছিলেন যে, চরমপন্থী কাগজগুলিতে তাঁর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ সম্বন্ধে সমালোচনা করে তাঁর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চলছিল ও দেশবন্ধু তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনে এটিকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন।
তবে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে লক্ষ করব যে, যে জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ রাষ্ট্রগুরুর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, অর্থাৎ তদানীন্তন সরকারের সঙ্গে স্যর সুরেন্দ্রনাথের সহযোগিতা, পরবর্তী পর্যায়ে দেশবন্ধু নিজেই তাঁর ভুল স্বীকার করে ১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি? মর্মাহত রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশ জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে সেকথাই ফিরে ফিরে আসে।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..