সারাজীবন বিজন ভট্টাচার্য এই জাত চাষাদেরই বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নাটক সাফল্য-ব্যর্থতার ধার ধারে না, কিন্তু আজকাল অ্যান্তোনিও গ্রামশির থেকে ধার করে আমরা যে ন্যাশনাল পপুলারের কথা বলি, ওগুলো সেই ন্যাশনাল পপুলারের খোঁজ করেছে পিয়ের পাওলো পাসোলিনি বা ঋত্বিকের সিনেমার মতো।
আমার মনে হয় বিজন ভট্টাচার্য একজন তপস্বী। নৈরঞ্জনা নদী তীরে গৌতম বুদ্ধ যেমন নির্বিকল্প হয়ে বসেছিলেন, বিজন ভট্টাচার্যকে তেমনভাবে বসে থাকতে দেখেছি। আমার তাঁকে দেখার কারণটা অবশ্য ব্যক্তিগত। তাঁর ছেলে নবারুণ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ওরা তখন ভবানীপুরে ১৪ নম্বর রাজেন্দ্র রোডে থাকত। আমি নবারুণের সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়ে বিজনবাবুকে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। শুভ্র ধুতি পরিহিত, খালি গা, হয়তো দাঁত মাজছেন কি টুকটাক সাংসারিক কাজ করছেন। অথচ এই মানুষটি আসলে আধুনিক ভারতীয় নাটকের স্রষ্টা। আমার মনে হত, কোনও শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব।
একথা না বলে কোনও উপায় নেই যে, আমাদের সব ছিল। পারিবারিক নাটক ছিল, ঐতিহাসিক নাটক ছিল, মহাকাব্য ছিল। কিন্তু বিজনবাবু যেভাবে ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) নাটকে আমাদের পথে নামিয়ে আনলেন, নাটকটি সরাসরি সড়কে নিয়ে এলেন– তা আমরা অনুমানও করতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাঙালির হৃদয় লুঠ করে নিয়েছিল। উপন্যাসের মতো একটা বিদেশি ফর্ম যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে পড়ে আমাদের চমৎকৃত করেছিল, তেমনি ‘নবান্ন’ও এক নতুন আলোকসম্পাত। একে শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষ, অনশনের, মন্বন্তরের মঞ্চায়ন বলে পার পাওয়া যাবে না।
এমন একজন মানুষ কী অবহেলায় কাটিয়েছেন! তাঁর মৃত্যুও অবহেলার মধ্যেই। মুক্তাঙ্গন-এ অভিনয় করতে গিয়ে পায়ে পেরেক ঢুকে গেল। সামান্য কয়েকজন দর্শকের সামনে আধুনিক ভারতের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতীক বিজন ভট্টাচার্য চলে গেলেন। কিন্তু এই নিয়ে একটা কথাই বলার আছে। তা হল শিল্পীকে এইরকম গোপন সম্রাটের মতোই দিন কাটাতে হয়। তার যে সুনির্দিষ্ট রাজনীতি ছিল, কিন্তু এটাও লক্ষ করার মতো যে, বিজনবাবু সেই রাজনীতির কাছ থেকেও সেরকম সম্মান পাননি। কারণ দলীয় রাজনীতি সবসময় আনুগত্য দাবি করে, আর বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন স্বাধীন মানুষ। আজকের যুগে এই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি নিম্নরেখ হওয়া উচিত?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গিরিশ ঘোষ থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী পর্যন্ত প্রসারিত যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিনয়, তা প্রথম অস্বীকৃত হল ‘নবান্ন’ নাটকে এবং তারপর গণনাট্য সংঘে। এই যে বিজন ইতিহাসের পট পাল্টানোর মুখে বাইরের দ্বন্দ্ব আত্মসাৎ করে নিলেন উচ্চগ্রামের শরীরী অভিব্যক্তি দিয়ে, এটা ঋত্বিক ঘটকের কাছে চিরকাল অবিস্মরণীয় মনে হয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মনে আছে, কবি মণীন্দ্র রায় একবার বিজনবাবুকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘এদেশে এইসব প্রত্যাশা থেকে কবিতা লেখা বা নাটক করা বন্ধ করে দেওয়া ভালো। তোমার উপায় নেই তাই তুমি কবিতা লেখ, আমার উপায় নেই বলে নাটক করি। ঋত্বিক যে সিনেমা করে, তাও একই কারণে। অন্য কোনও উপায় থাকলে করত না। আমরা তো আর কিছুই করতে জানি না, তাই করে যেতে হবে। কিন্তু করতে গিয়ে তো আর অন্য দলে নাম লেখাতে পারব না, কারণ এই রাজনীতিতে আমার বিশ্বাসের জায়গা।’ এটাই আসল জায়গা।
‘নাট্যদর্শন’ পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, বিজনবাবুই প্রথম দেখালেন যে কী করে জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়, কী করে সম্মিলিত অভিনয় ধারার প্রবর্তন করা যায়, এবং কী করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ডরূপ মঞ্চের ওপর তুলে ধরা যায়। গিরিশ ঘোষ থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী পর্যন্ত প্রসারিত যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিনয়, তা প্রথম অস্বীকৃত হল ‘নবান্ন’ নাটকে এবং তারপর গণনাট্য সংঘে। এই যে বিজন ইতিহাসের পট পাল্টানোর মুখে বাইরের দ্বন্দ্ব আত্মসাৎ করে নিলেন উচ্চগ্রামের শরীরী অভিব্যক্তি দিয়ে, এটা ঋত্বিক ঘটকের কাছে চিরকাল অবিস্মরণীয় মনে হয়েছে। কিন্তু এত যুগ পরে আমার মতে ‘নবান্ন’ সম্পর্কে যে মন্তব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা এমন একজনের, যাকে সাধারণত বিজন ভট্টাচার্যের বিপরীত মেরু ভাবা হয়। অর্থাৎ শম্ভু মিত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘নবান্ন’-র আগে অবধি আমাদের সব ট্র্যাডেজি পারিবারিক ট্র্যাডেজি। ‘নবান্ন’ এল এপিকের ব্যাপ্তি নিয়ে।
ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন শম্ভুবাবু? তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বিজনবাবুর প্রধান নাটক ‘নবান্ন’তে যাকে নাট্য-সংহতি বা নাট্য প্রবহমানতা বলি, তা পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে। এই নাটক আধুনিকতার মূল ভাষ্যের প্রতি নজর রেখে মুহূর্ত-নির্ভর। অনেকগুলো মুহূর্তের কোলাজের মতো। দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে আছে কান্নার একটি অদৃশ্য সুতো দিয়ে। শম্ভু মিত্র একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে কুঞ্জকে কুকুরে কামড়েছে। শুভা কুকুরকে লক্ষ করে ভীষণ চেঁচিয়ে ওঠে। তারপরেই নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘জল খাবে? তেষ্টা পেয়েছে?’ মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এই দৃশ্যকে বলেছিলেন শাশ্বত। এই মুহূর্তের জয়ই নাটককে চিরকালীন করে তুলেছিল। সবচেয়ে বড় কথা ‘নবান্ন’ কোনও নাট্য-আখ্যান নয়, নাট্যসন্দর্ভ। এই নাটককে মঞ্চের ওপরে যতটা খুঁজতে হবে, মঞ্চের বাইরেও ততটাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: শক্তিপদ রাজগুরুর বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে এক পাঠক সই করাবেনই করাবেন!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জীবনের শেষ দিকে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনাচক্রে জীবনের শেষ নাটক ‘দেবীগর্জন’ সম্পর্কে বিজন বলেছিলেন যে, খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালে ভারতের জনসাধারণ বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। ‘The violence of there revolt, I associated with Devi’s Garjan–– The roar of the angry goddess.’ চণ্ডীতে যা পাওয়া যায়। পৌরাণিকতাকে ভারতীয় কৃষকের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া বিজনবাবুর অসাধারণ কীর্তি। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম প্রিপেয়ার্ড টু অ্যাকোমডেড দি বিলিভ অফ মাই পিপিল’। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, উনি একজন মার্কসবাদী হয়ে দেবীগর্জনের কথা কী করে বললেন? ঋত্বিক ঘটক সম্বন্ধেও অনেক সময় এই সমালোচনা করা হয়। এ ব্যাপারে বিজনবাবুর বক্তব্য ছিল, দেশের মানুষ যা বিশ্বাস করে আমি তা একেবারে ফেলে দিতে পারি না। তবে তাকে আমি নতুনভাবে দেখতে পারি। বিজন ভট্টাচার্যের ‘জিয়নকন্যা’ বা ‘দেবীগর্জন’ খেয়াল করলে বোঝা যায়, এই নতুনভাবে দেখা ব্যাপারটা অন্যরকম দেখা, দেখার রকমফের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নবান্ন’ দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আপনি তো জাত চাষা’। বস্তুত, সারাজীবন বিজন এই জাত চাষাদেরই বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নাটক সাফল্য-ব্যর্থতার ধার ধারে না, কিন্তু আজকাল অ্যান্তোনিও গ্রামশির থেকে ধার করে আমরা যে ন্যাশনাল পপুলারের কথা বলি, ওগুলো সেই ন্যাশনাল পপুলারের খোঁজ করেছে পিয়ের পাওলো পাসোলিনি বা ঋত্বিকের সিনেমার মতো।
তাঁর সংলাপ নিয়েও আলাদা করে ভাবা দরকার। তিনি বলতেন দু’মাইল অন্তর অন্তর আমাদের মুখের ভাষা পাল্টে যায়। এই পাল্টে যাওয়া তিনি সংলাপে ধরে রাখতেন। একেবারে মূলধারার জনপ্রিয় ছবিতে তাঁর কাজ লক্ষ করলেও টের পাওয়া যাবে ব্যাপারটা। অনেকেই খেয়াল করেন না বা জানেন না যে, বিজনবাবু নির্মল দে নির্দেশিত দু’টি ছবি– ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২), আর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) এর চিত্রনাট্যকার। এই ছবি দুটো আমাদের আধুনিকতার মাইলফলক। প্রথমটা উত্তমকুমারকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর দ্বিতীয়টা উত্তম-সুচিত্রার প্রথম হিট ছবি। দ্বিতীয় ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে সংলাপ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এখন যা প্রবাদে পরিণত হয়েছে– ‘মাসিমা মালপুয়া খামু’–তা বিজন ভট্টাচার্যর পক্ষেই লেখা সম্ভব ছিল।
বিজনবাবুর নাটক স্টেজ ছাড়িয়ে দরকার পড়লে একটা সামান্য তক্তাপোষ বা ছেড়া চটের ওপর তৈরি হত, সেই নাটক সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, হাবিব তনবীর বা বিজয় তেণ্ডুলকরের মতো সমস্ত বড় বড় নাট্যকার এই নাটকগুলোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসতেন। ‘নবান্ন’ থেকে পরবর্তীকালে ‘ধরতি কে লাল’ ছবি পর্যন্ত হল। আসলে এখন বুঝতে পারি ‘নবান্ন’, ‘জবানবন্দী’র মতো নাটক দলগত নৈপুণ্যকে সম্মুখবর্তী করে। আর বিজনবাবু কখনও নাটকে, কখনও সিনেমায় একা অনেকটা বিবেকের মতো শ্মশানের দিকে এগিয়ে যান। ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে তাঁর সংলাপ ছিল– ‘ঈশ্বর আমারে একবার কলকেতা নিয়া যাবা?’ আজকের কলকাতা তো শূন্যতার পরিসর, এই কলকাতা তো হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এই কলকাতা বিজন ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ অবাক করে, অবগ্রাহিতার নিয়তি। তাঁর সেই হাই পাওয়ারের চশমা পরে রাসবিহারীর মোড়ে হাঁটার কথা মনে পড়ে। কোথাও একবিন্দু অহংকার তো ছিলই না, কখনও একথাও ভাবতেন না, কবে কাগজে আমার ছবি ছাপা হবে। আসলে আমার প্রায়ই মনে হয়, বিজন এবং ঋত্বিক– দু’জনেই এক অর্থে জনতার শিল্পী। সেকথা জনতা বোঝেনি, যে দেবতা তাঁদের মধ্যে এসেছিলেন খালি পায়ে। আজ মৃত্যুর এতদিন পরে তাকে কি মাল্যভূষিত করা হবে?
শহরটা কিন্তু বদলাচ্ছে। প্রতিটি চুম্বনের সঙ্গে শহরটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আর যত দিন যাবে, এই পরিবর্তনের কাহিনি আরও লেখা হবে।তোমাদের ভদ্রলোক-সংস্কৃতির দেওয়ালে ফাটল ধরছে, আর এই ফাটলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা।