সন্দীপন কাউকে লেখা দিলেই, তাঁর প্রথম এবং শেষ কথা হত, ‘প্রুফটা একবার দেখিয়ে নেবে ভাই।’ আবার তাকেই বলতে দেখা যেত, লেখক হওয়ায় জন্য প্রয়োজন শুধু লেখার। আর সব বাজে। দল, প্রকাশক, স্তাবক, প্রুফ-ট্রুফ কিছুরই দরকার পড়ে না। অথচ এই সন্দীপন গর্ব করে বলতেন, “জানো আমার প্রথম গল্প ‘বিজনের রক্তমাংস’র প্রুফ দেখেছিল দিব্যেন্দু পালিত আর অজয় দাশগুপ্ত। দিব্যেন্দু পাণ্ডুলিপি হাতে পড়েছিলেন আর প্রুফ সংশোধন করেছিল অজয়। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রকাশিত গল্প, যেখানে একটাও ছাপার ভুল ছিল না।”
প্রচ্ছদের ছবি: প্রতিক্ষণ পত্রিকা, ১ এপ্রিল, ১৯৯৭ থেকে গৃহীত।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের জীবনে যতরকম ভূতের উল্লেখ থাকুক না কেন, সেরা ভূত অবশ্যই ছাপাখানার ভূত। সেই পুরাণ, উপনিষদ,মঙ্গলকাব্য, প্রাকৃত সাহিত্য, বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে ত্রৈলোক্যনাথ হয়ে যম দত্ত, সুকুমার সেন– এঁদের গ্রন্থে নানা বৈচিত্রময় ভূতের উল্লেখ থাকলেও একবারের জন্যও ছাপাখানার ভূতের কথা বলেননি। অথচ, এই ভূতের দলই আমাদের সবচেয়ে বেশি বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছে।
সেই লেটার প্রেসের যুগ থেকেই সেই ভূতের আগমন। কম্পোজ হওয়ার পর প্রথম স্তর থেকে শুরু করে, অর্থাৎ গ্যালি প্রুফ, মেকাপ প্রুফ এবং অবশেষে ১৬ পৃষ্ঠার একটা পুরো ফর্মা মেশিনে ফেলে শেষে মেশিন প্রুফ দেখে ছাপা শুরু হত। প্রত্যেক পর্যায়ে একটা-দুটো-তিনটে ভুল থাকতই। সেগুলো সংশোধন করে ফাইনাল প্রিন্ট দেওয়া হত। নিশ্চিন্ত হয়ে বই হয়ে প্রকাশের পরে ঠিক দু’-একটা ভুল থেকেই যেত। এত করেও যখন ভুল থাকত, সবারই ধারণা হত এ নিশ্চয়ই ভূতের কাজ!
অন্তত বছর পঁচিশের আগে চন্দননগরের গল্প মেলায় সুধীর চক্রবর্তীর মুখে শুনেছিলাম এই প্রুফ কারেকশনের গল্প। বাংলা মুদ্রণের ছাপার ভুলের অন্যতম কারণ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ আর লেটার প্রেসের যুগে টাইপ রাখার খোপ। ইংরেজিতে ক্যাপিটাল আর স্মল মিলে মোট ২৬ দু’গুণে ৫২টা টাইপ, সঙ্গে যতিচিহ্ন আর সংখ্যার টাইপ থাকলেই হল। তুলনায় বাংলায় সব মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচশোর কাছাকাছি টাইপ থাকতে হবে। ইংরেজিতে অত ণত্ব-ষত্ব নেই। বাংলায় স-ই আছে তিনটে। তার উপরে হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ, যুক্তাক্ষর। ছাপাখানাগুলো ছিল অন্ধকার ঘুপচি, নোংরা, কালিঝুলি মাখানো। ওই আধো অন্ধকার ঘরের টাইপ রাখার খোপগুলোর ফাঁক-ফোঁকরে বাসা বাঁধত ছাপাখানার ভূতেরা।
তিনবার প্রুফ দেখার পরেও কী করে যে ভুল থেকে যেত, সে ঈশ্বরও জানেন না! ইংরেজি বইতে প্রুফের ভুল থাকে না কেন, জানেন? সুধীরবাবু বলেছিলেন, আবার সুধীরবাবুকে সেটা বলেছিলেন চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। বলেছিলেন, ‘‘বড় প্রকাশক, যেমন ধরুন ‘পেঙ্গুইন’ বা ‘পেলিক্যান’। হাজার হাজার পাতার কপি বের করে কী করে জানেন! মেশিনে তোলার আগে পুরো এক ফর্মা মানে ষোলোটা পাতা প্রেসের বাইরে একটা বোর্ডে সেঁটে দিত। সেটা টাঙানো থাকে সারাদিন। রিটায়ার্ড বৃদ্ধরা আর বেকার যুবকরা সব খুঁটিয়ে পড়ে। একটা ভুল বের করলেই এক পাউন্ড। টুলে বসে আছে এক প্রুফ দেখতে জানা কর্মচারী। যদি কেউ সত্যি একটা ছাপার ভুল বের করতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে কর্মচারী তার প্রুফ কারেকশন করে নগদ এক পাউন্ড দিয়ে দেয়। একেই বলে সাহেবদের বেনে বুদ্ধি, কম খরচে নির্ভুল বই। আর আমরা! তিনবার প্রুফ দেখে, গলদঘর্ম হয়ে, তবু একটা বই নির্ভুল ছেপে বের করতে পারি না।’’
ছাপার ভুল নিয়ে কত রকম মজাদার কাহিনি আছে, তা বলে শেষ করে যায় না। কাগজে খবর বের হল ‘বকের আত্মহত্যা’! বোঝাই যাচ্ছে প্রথম বর্ণটি পড়েনি। পরের দিন ভ্রম সংশোধন হল। হেডিংয়ে লেখা, ‘ত্রম’ সংশোধন। অর্থাৎ ভয়ে-র ফলার খোপে ত-এ র-ফলা বসেছিল। লেটার প্রেস থেকে লাইনো হয়ে কাগজের অফিসে কম্পিউটারে কম্পোজ করার ব্যবস্থা হল। সেখানে ভূত না থাকলেও কম্পোজের কি-বোর্ডের উপর নিচের ভুল কি-তে প্রেস করে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ভুল হত। আমি যে কাগজের অফিসে চাকরি করতাম, সেখানে চিঠিপত্র বিভাগ দেখতেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। সন্দীপনদাকে কতবার দেখেছি মেঝেতে উবু হয়ে বসে কিছু খুঁজছেন। ‘কী হল সন্দীপনদা,কী হারালেন?’ উত্তরে করুণ মুখে জানাতেন, “একটা ন’পয়েন্টের তালব্য-শ-এ হ্রস্ব-উ দেখে দাও না ভাই। এখন তো আর কেউ কম্পোজ করে দেবে না, ওটা পেলে আমার কাজ হয়ে যাবে। কারেকশনটা করেই পাতা ছেড়ে দেব।”
এই সন্দীপনদার কথা বলতে মনে পড়ে গেল, সন্দীপনদার বন্ধুবান্ধব মিলে কাগজ বের করেছে। সেখানে পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রকাশিতব্য একটি উপন্যাসের নাম ছিল ‘শালিকের ঠোঁট’। কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।
একবার নামকরা একটি শারদীয় সংখ্যায় সন্দীপনের উপন্যাস বেরল। উপন্যাসের প্রথম পাতায় লেখকেরই নাম নেই। ততক্ষণে সমস্ত কপি বাঁধিয়ে এজেন্টের কাছে চলে গেছে। ভাগ্যিস সূচিপত্রে লেখকের নাম ছিল। অন্তত, তিন-চার জনের হাত ঘুরে প্রিন্ট অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সবাই বলছে তাঁরা দেখেছিলেন, নাম আছে। তাহলে এটা হল কী করে! কেউ জানে না! ভুতুড়ে কাণ্ড ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যায়!
সন্দীপন কাউকে লেখা দিলেই, তাঁর প্রথম এবং শেষ কথা হত, ‘প্রুফটা একবার দেখিয়ে নেবে ভাই।’ আবার তাকেই বলতে দেখা যেত, লেখক হওয়ায় জন্য প্রয়োজন শুধু লেখার। আর সব বাজে। দল, প্রকাশক, স্তাবক, প্রুফ-ট্রুফ কিছুরই দরকার পড়ে না। অথচ এই সন্দীপন গর্ব করে বলতেন, “জানো আমার প্রথম গল্প ‘বিজনের রক্তমাংস’র প্রুফ দেখেছিল দিব্যেন্দু পালিত আর অজয় দাশগুপ্ত। দিব্যেন্দু পাণ্ডুলিপি হাতে পড়েছিলেন আর প্রুফ সংশোধন করেছিল অজয়। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রকাশিত গল্প, যেখানে একটাও ছাপার ভুল ছিল না।”
প্রুফ সংশোধন যে একটি গুরুতর প্রয়োজন, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলায় স্বীকৃত নয়, বোঝালেও বুঝতে চায় না। এমনই ছিল আমাদের শিথিল ও অসংস্কৃত মনোভাব। বেশিরভাগ জায়গায় প্রেসের ওপরেই দায়িত্ব থাকত প্রুফ দেখার, যাদের কোনও নির্দিষ্ট প্রুফ-পাঠকই নেই। অথবা সামান্য দক্ষিণায় প্রুফ দেখিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। ফলে যা হওয়ার তা-ই হত।
বাঙালি প্রুফ রিডারদের দোষ ছিল সেই প্রথম ছাপার যুগ থেকেই। এমনকী, ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশুদ্ধ হিন্দু মতে গঙ্গার জল দিয়ে ছাপার কালি তৈরি করে, গোঁড়া ব্রাহ্মণ কম্পোজিটর দিয়ে কম্পোজ করিয়ে, পুঁথির আকারে বই করলেও তাতে অবশ্যই ছাপার ভুল থাকত। সেই সেকালে উইলিয়াম জোন্স রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য কম্পোজিটরস ইন দিজ কান্ট্রি আর সেমফুলি ইন্যাক্যুইরেট।’
সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। লেটার প্রেস, লাইনোটাইপ, মনোটাইপ, অফসেট হয়ে এখন বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি। হাতে কম্পোজ বা লাইনোটাইপে বই ছাপার কাজে অনেকবার করে প্রুফ দেখতে হত। মেকআপের পর তেমন বেশি ভুল থাকলে মেকআপ ভেঙে ফেলতে হত। ডিটিপিতে অনেক সুবিধা হয়েছে কিন্তু সেখানেও দেখা গেছে, যতবার ‘দোল’ কম্পোজ করতে যায়, লেখা ফোটে ‘দুল’। ‘হোলি’ লিখতে বদলে যায় ‘হুলি’-তে।
বানানের খুঁতখুঁতানি ভয়ংকর রকম ছিল কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর। তাঁর বইয়ের প্রকাশক, সিগনেটের মালিক ডি.কে.-কে প্রায় চিঠি লিখে প্রুফের পুনঃসংশোধনের কথা বলতেন। একবার লিখলেন, ‘‘ষ’ আর ‘য’-এর সাদৃশ্য লাইনোতেও ঘুচলো না দেখছি। আশা করি যে-যগুলো ষ-এর মত দেখাচ্ছে, সেগুলো আসলে ষ-ই।’’ এই বার্তা পেয়ে ডি. কে. কী করেছিলেন, জানি না। কতটা নতুন করে সংশোধন হয়েছিল তাঁর কবিতা, জানি না। কিন্তু আগেরবারের শুদ্ধ পাঠ নতুন করে কম্পোজ করতে গিয়ে আরও মারাত্মক সব ভুলের সৃষ্টি করত। একবার তৃতীয়বার প্রুফ সংশোধনের পর লিখলেন, ৩৩ পৃষ্ঠায় পঞ্চম লাইন ষষ্ঠের স্থান নিয়েছে। কখনও বা ‘মেঘাবচ্ছিন্ন’ হয়ে যেত ‘মেঘাচ্ছন্ন’! এর মূলে আসলে যে ছাপাখানার ভূতের কাণ্ড, এ ব্যাপারে কারও মনে কিঞ্চিৎ মাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়, তা সবাই জানে।
ছাপাখানার ভূতেদের আর একটা খেলা ছিল যতিচিহ্ন নিয়ে। যখন খুশি যেখানে ইচ্ছে বসে পড়ত। পাণ্ডুলিপিতে তাঁদের যথাস্থানে দেখা যেত, কিন্তু কম্পোজ বা ডিটিপির পর তাঁরা অধিষ্ঠান বদলে ফেলতেন। কী করে হল, কেউ জানে না। এই গোলমেলে কাণ্ড কিন্তু আজকের নয়! ১৮২১ সনে ‘সমাচার দর্পণ’ কাগজে একটি চিঠি ছাপা হয়। পত্রলেখক দ্বিধাহীন ভাষায় লিখেছেন যে, আজকাল নাকি বাঙালিরা ইংরেজি ভালো ভাবে না শিখেই ইংরেজিতে চিঠি লিখছে। এবং সে চিঠির ভাষা বাঙালি দূর অস্ত, ইংরেজ সাহেবদেরও বোধগম্য হবে না। সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু দাঁড়িকমাহীন সেই চিঠি পড়ে দেখুন বাঙালিরাও বুঝতে পারবেন বলে মনে হয় না? জানি না, যতিচিহ্নগুলি কারা ভ্যানিশ করেছিল– পত্রিকার না কাগজের কম্পোজিটর? যা হোক, চিঠির কিছুটা একবার পাঠ করে দেখুন।
“বিদ্যা গোটা কতক বিলাতী অক্ষর লিখিতে শেখেন আর ইংরাজী কথা প্রায় দুই তিন শত শিখেন নোটের নাম লোট বডিগার্ডের নাম বেনিগারদ লৌরি সাহেবকে বলেন লৌরি সাহেব এই প্রকার ইংরাজী শিখিয়া সর্বদাই হুট গোটে হেল ডোনকের ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করা আছে আর বাঙ্গলা ভাষা প্রায় ব্যবহার করেন না। এবং বাঙ্গালি পত্রও লিখেন না সকলেই ইংরাজী চিঠি লিখেন তাহার অর্থ তাহারাই বুঝেন কোন বিদ্বান বাঙ্গালি কিংবা সাহেব লোকের সাধ্য নহে যে সে চিঠি বুঝিতে পারেন।”
দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনের মতো ছেদচিহ্নগুলি ছাপাখানার ভূতেরা খেলার সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করত। প্রুফ রিডারদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত। আবার অন্যদিকে ড্যাশ না হাইফেন- প্রুফ রিডারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিত। দুষ্টু, বেয়াদব, ‘বেজাত’ পাংচুয়েশন তাঁদের পাগল করে তুলেছিল। সত্যিই এরা বেজাত। বৈদিক সাহিত্যে বিরাম চিহ্ন বলতে ছিল শুধু দাঁড়ি আর ডবল দাঁড়ি। ইংরেজদের বাণিজ্যতরীতে এই পাংচুয়েশনের দলও এদেশের মাটিতে পা রাখে। তাদের সঙ্গে ছিল নানা জাতের ভূত।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
এই যতি চিহ্ন নিয়ে বিরক্ত হয়ে সন্দীপন ভূতের রাজা নয়, একটি পত্রিকার ‘প্রিয় সম্পাদক, কম্পোজিটার ও প্রুফ রিডারগণ’ সম্বোধনে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে ছাপার ভুলের হাত থেকে রক্ষা করুন। এবং জানবেন দাঁড়ি- কমা-সেমিকোলন এগুলোও বাংলা ভাষা। প্রীতিসহ– সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।’