পরিকাঠামো নির্মাণ একটি জনমোহিনী ব্যাপার। এর প্রচার করা যায়, টেলিভিশনে দেখানো যায়, ছবি তুলে বিজ্ঞাপন করা যায়, সেখানে কোথায় লাগে অপুষ্টি আর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ আর মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ানো? আমাদের নদী পর্বত অরণ্য সবই পরস্পরে অন্বিত এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের জীবনের সঙ্গে মিলে তারাই নির্মাণ করে জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু পরিবেশের জন্য একটি মন্ত্রক থাকলেও তাদের দিক থেকে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কোনও আগ্রহ দেখা যায় না। এ প্রবণতার আরম্ভ গত কুড়ি বাইশ বছর ধরে, বিশ্বায়নের পর্বে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের গতি পরিবর্তনের অনুসরণ করেই, গত এক দশকে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে। তার কারণ মুষ্টিমেয় শিল্পগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাত এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব। চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে সাম্প্রতিক দু’টি ব্যাপার। অরণ্য সুমারি করে সরকার জানাচ্ছেন দেশে অরণ্যের আওতায় এলাকা বেড়েছে। কার্যত এর মধ্যে আছে অনেক সংজ্ঞার জোড়াতালি। শহরাঞ্চলের গাছে ছাওয়া অঞ্চলকে অরণ্য বলে দেখানো হয়েছে।
প্রচ্ছদের ছবি: হরেন দাস
জঙ্গল, বন, অরণ্য– নৈকট্য, বিস্তার, প্রাচীনতা– যে মাপেই ধরা যাক, জীবন, জীবিকা, পরিবেশের ভবিষ্যতের চাবি এই নামগুলির মধ্যেই ধরা আছে।
বছর ছয়েক আগে এক শ্রাবণ মাসে অরণ্য অধিকার কর্মী দেবাজী তোফার কাছে গিয়েছিলাম। দেবাজী গোণ্ড জনজাতির প্রতিনিধি। মহাকান্তার উপন্যাস রচনার শেষপর্বে তখন ইন্দ্রাবতী নদীর চলন অনুসরণ করে ওড়িশার কোরাপুট, তারপর ছত্তিশগড়ের বস্তার পার হয়ে মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে এসে পৌঁছেছি।
মুম্বই থেকে নাগপুর। সেখান থেকে চন্দ্রপুর হয়ে গড়চিরোলি। গড়চিরোলির পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্ত ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশ ছুঁয়ে আছে। মহারাষ্ট্রের পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা জেলাটি কিন্তু মুম্বই থেকে হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে। যখন গড়চিরোলির পথে রওনা হয়েছিলাম, দেভাজী তোফার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে ভাবিনি। তুমুল বর্ষা। ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীগুলির কারণে যেদিকে যেতে চাই, সেদিকেই পথ বিপদসংকুল। প্রথমবার টিকিট কেটেছিলাম জুলাইয়ের শেষে। এসব জেলায় জেলা শাসককে না-জানিয়ে যাওয়ার কিছু অসুবিধে আছে। জানাতেই ওপাশ থেকে অনুরোধ এল টিকিট পিছনোর। ২৮ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট সপ্তাহটি শহিদ সপ্তাহ হিসেবে পালন করেন গড়চিরোলির বামপন্থী (মাও-লেনিন পন্থী) রা। আমার সাধারণ গাড়ি। সুরক্ষাবিহীন যাতায়াত। পথে কাদার মধ্যে মাইন পোঁতা থাকলে বোঝা যাবে না। শহিদ সপ্তাহ কোনওবারই ‘ঘটনা’বিহীন যায় না। তার ওপর বর্ষাকাল। নিজেরই দোষে টিকিট বদলানোর অর্থদণ্ড ইত্যাদি ভোগ করে যখন গেলাম অগাস্টের গোড়ায়, তখন বিলম্বিত ধান রোয়ার পর্ব চলছে, ফুঁসে ওঠা নদীগুলির তেজ বিন্দুমাত্র কম নয়।
………………………………
এই প্রসঙ্গে ভারতীয় অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬-এর কথা বলতে হয়। এই আইন প্রথম বনে বাস করা ও বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভেবেছিল। আমাদের দেশের জনজাতিদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আনার ক্ষমতা নিহিত ছিল এই নতুন আইনের মধ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (১৯৭২) আর অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০) নামক যে দুই আইন আমাদের অরণ্য অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, দু’টিই ঔপনিবেশিক শাসকদের শাসন পদ্ধতির মডেলে তৈরি।
………………………………
যদি গড়চিরোলিতে প্রবেশের মুখে কাঠানি নদীর ওপর নীচু সেতুটি উঁচু ব্রিজে না বদলানো হত, তাহলে গত বছরগুলির মতোই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত পুরো গড়চিরোলি জেলাই। ভাগ্যিস সামনে বিধানসভা নির্বাচন, তাই তড়িঘড়ি সেতুর কাজ শেষ করে উদ্বোধন করে দেওয়াও হয়ে গেছে। উত্তর গড়চিরোলির মেণ্ঢা ও লেখা দু’টি কাছাকাছি গ্রামের নাম সংযুক্ত করে বলা হয় মেণ্ঢালেখা। গোণ্ড জনজাতি বহুল এই এলাকা ভারতের অন্যতম প্রাচীন জনবসতিও বটে। দেভাজী নিজেও গোণ্ড। ওই অঞ্চলে তাঁর বিশেষ সম্মান অরণ্যের সামুদায়িক পরিচালনার অধিকার আন্দোলনের জন্য।
এই প্রসঙ্গে ভারতীয় অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬-এর কথা বলতে হয়। এই আইন প্রথম বনে বাস করা ও বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভেবেছিল। আমাদের দেশের জনজাতিদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আনার ক্ষমতা নিহিত ছিল এই নতুন আইনের মধ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (১৯৭২) আর অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০) নামক যে দুই আইন আমাদের অরণ্য অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, দু’টিই ঔপনিবেশিক শাসকদের শাসন পদ্ধতির মডেলে তৈরি।
অরণ্যকে স্বাধীন ভারতের শাসকরা দেখতে শিখেছেন সম্পদের উৎস হিসেবে, মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে নয়। ২০০৬ সালে প্রথম অরণ্যে বসত করা ও বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের অধিকারকে স্বীকার করার ব্যবস্থা হল, প্রজন্মান্তরে তাদের দ্বারা কর্ষিত জমির পাট্টা দিয়ে। এটাও সত্যি যে, আইন কার্যকর হতেই লেগে গেল দশ বছর। তবু যে পঁচিশ কোটি মানুষ, তাদের মধ্যে দশ কোটি আদিবাসী বহু প্রজন্ম ধরে জঙ্গলের জমি চাষ করে আসছেন, তাঁদের হাতে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা (যথাবিহিত অনুসন্ধান করার পর) তুলে দেওয়ার একটা সুযোগ এল। এই নতুন আইনটি জনজাতি ও বনবাসীদের ১৪টি প্রাক বিদ্যমান অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ১, কৃষি ও বাসভূমির ব্যক্তিগত অধিকার। ২, বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও বনভূমির ওপর সামুদায়িক অধিকার। ৩, অরণ্যের পরিচালনা ও ব্যবহারের অধিকার।
২০১৬ সালে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দায়ের করা অরণ্যের অতিক্রমণ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কিছুটা অধৈর্য হয়েই অন্তর্বর্তী রায় দেয়, তিনমাসের মধ্যে সমস্ত ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পর্কিত কেস যদি নিয়মানুগ না করা যায়, তাহলে যত দাবি নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেগুলি বাতিল হয়ে যাবে। ওই সময় অরণ্য ভূমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার দাবিতে সারা দেশে যে ৪১ লক্ষ দাবি পেশ হয়েছিল, তার ৩ লক্ষ মঞ্জুর হয়েছে, ৩৮ লক্ষ বাতিল। সেগুলির ওপর পুনর্বিচারের দাবি পেশ বাকি ছিল। এইসব কেস সারা দেশে নানা মহকুমা শাসকের কাছে বিচারাধীন। কোথাও কৃষক পুনর্বিচার চেয়েছেন, কোথাও আইন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকায় করণীয় কী বুঝেই উঠতে পারেননি আদিবাসীরা। বহু অরণ্যপর্বত সংকুল অঞ্চলে, আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায় অনেক প্রজন্ম ধরে একটি নির্দিষ্ট জমি চাষ করে আসছেন। সেই জমির চৌহদ্দি তাঁর বা গ্রামের অন্যদের জানা। সরকার থেকে কেউ এসে মাপেনি, কারণ রাজস্ব বা বনবিভাগের দৃষ্টিতে এ সবই অতিক্রমণ। কালাহাণ্ডি কোরাপুট সীমান্তে নিয়মগিরি পর্বতে দেখেছি এক একটি পরিবারের জন্য বংশানুক্রমে চিহ্নিত আছে একটি করে পাহাড়। তাঁরা সেটিই চাষ করেন, জমির মাপ না জেনেই। অরণ্যের ধারণাটাও আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভাবজাত। যেখানে এখন বনের চিহ্ন নেই, নেই বড় গাছপালা, তাও অরণ্য বলে ঘোষিত হওয়াতে, যাঁরা ওইসব জমিতে চাষ করে আসছিলেন, তাঁরা অতিক্রমণকারীতে পরিণত হয়েছেন। কোনও আদিবাসী অঞ্চল নয়। কিন্তু কচ্ছের রণ-এ বন্য গাধাদের সুরক্ষিত রাখার জন্য যেভাবে পাঁচ হাজার হেক্টর কাঁটা ঝোঁপে ভরা বালুকাভূমি, যেখানে কয়েকশো আগারিয়া বা লবণ চাষি বছরের আটমাস কাটান, কোনও পরামর্শ না করেই পুরোটা অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়েছে, তা আমার আবশ্যক মনে হয়নি। আসলে মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে অরণ্যের অস্তিত্বকে মিলিয়ে দেখার শিক্ষা আমাদের বনবিভাগের নেই।
অরণ্য অধিকার আইনে তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এসে রাজস্ব বিভাগের কর্মী যখন জমির মাপজোক করেন, আদিবাসী চাষি বুঝতেই পারেন না, কতখানি কী মাপা হল, রাজস্ব বিভাগের খাতায় কী চড়ল! তাঁদের তো কেউ বুঝিয়ে বলেন না। যেহেতু সরকারি জমিতে অতিক্রমণের দায় তাঁদের ওপর, রাজস্ব বিভাগের প্রবণতা হল সামান্য জমিতে তাঁকে পাট্টা দিয়ে বাকি জমি সরকারের দখলে রাখা। সব রাজ্যে এখন তৈরি হচ্ছে শিল্পের জন্য ল্যান্ড ব্যাঙ্ক। জমি অধিগ্রহণে অনেক সমস্যা। জনপ্রতিরোধ হয়। তাই সরকারি জমি শিল্পের জন্য রাখা সহজ। এর ফলে আদিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম ভূমিহীন হয়ে পড়বে, তা নিয়ে প্রশাসন বিশেষ চিন্তিত নয়।
অরণ্য অধিকার আইনের অনুপালনের দু’টি দিক। ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার ও অরণ্য ব্যবহারে, বনজ সম্পদ সংগ্রহে, অরণ্য পরিচালনায় অরণ্যবাসী ও জনজাতি গোষ্ঠীর সামুদায়িক অধিকার।
অরণ্য অধিকার আইনের বিভিন্ন রাজ্যে অনুপালনের মাত্রা আলাদা রকম। ব্যক্তিগত মালিকানা দেওয়ার কাজে মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে তুলনামূলক ভাবে ভালো কাজ হয়েছে। কিন্তু সামুদায়িক অধিকারের ক্ষেত্রটি সবচেয়ে কঠিন ও জটিল। অরণ্যের পরিচালনার ভার (অংশত হলেও) বনবিভাগের প্রশাসন ছাড়া আর কারও হাতে যেতে পারে, দেড় দশক আগেও তা ভাবা যেত না। দেভাজী তোফা এই লড়াইটাই করেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে। তাঁর কাছে আসার প্রসঙ্গে তাই এই কথাগুলি এত বিশদভাবে বলতে হল।
গড়চিরোলি জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির বিস্তার ১৯০০ হেক্টর। তার ৮০ ভাগই অরণ্য। গড়চিরোলির জেলারও ৮০ ভাগ অরণ্য, মিশ্র পর্ণমোচী গোত্রের। বাঁশ, সেগুন ও অন্যান্য নানা গাছের সমাবেশ। উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্রে এ অঞ্চলের তুলনা নেই। ১২৫ ধরনের উদ্ভিদ, ৮০ ধরনের পাখি, ২৫ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে এই সব বনে। বাঘ, লেপার্ড, নীলগাই, চিত্রল হরিণ, লঙ্গুর কত প্রাণী। মেণ্ঢালেখা গোণ্ড জনজাতিদের গ্রাম। এ অঞ্চলের আদি শাসক এরাই। বনের নানা সম্পদ আহরণ করে, চাষ ও খেতমজুরি করে বনকে রক্ষাও করে চলেছেন এঁরাই। গ্রাম পঞ্চায়েতের বড় হলঘরে বসে কথা হল। অন্য জেলা থেকে আসা আর এক বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমিও একধারে বসে শুনতে লাগলাম। গ্রামসভা মাঝে মাঝেই বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন নানা বিষয়ে মতামত পাওয়ার জন্য।
এদের সঙ্গে কথা শেষ হলে বাইরে এসে নিজের শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলছিলেন, গত চল্লিশ বছরের একটানা লড়াইয়ের কথা। স্বাধীনতার আগে গোণ্ড সমাজের হাতে ছিল অরণ্য পরিচালনার ভার। স্বাধীনতার পর অরণ্য আইনের বলে তা চলে যায় বনবিভাগের হাতে। জনজাতির অরণ্যে প্রবেশের অধিকার খণ্ডিত হয়। তবে দুর্গম নদী-পাহাড় মণ্ডিত এলাকা। বনবিভাগের আধিকারিকরাও সর্বত্র যেতে পারতেন না। ইজারাদার, কাগজকলের হাতে বন বড় হারে ধ্বংস হতে থাকে।অরণ্যের ওপর সামুদায়িক অধিকারের লড়াই একদিনে তৈরি হয়নি। প্রতিবেশী রাজ্য– তখন মধ্যপ্রদেশ এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়, তাতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন মেন্ঢালেখা গ্রামের কয়েকজন। তাঁরা ফিরে এসে নারীর সমানাধিকার, শরাব বন্দি ইত্যাদি নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। ক্রমশ জীবিকার তাগিদে অরণ্য সম্পদ সংগ্রহের অধিকার নিয়ে আন্দোলন আরম্ভ হয়। তৈরি হয় গ্রামসভা, মহিলা মণ্ডল। তাদের ওপর ন্যস্ত হয় অরণ্য পরিচালনার ভার। ১৯৮৮ থেকে এ দু’টি গ্রামের গ্রামসভা গ্রাম বিষয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে, যা বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সত্ত্বেও দেশের বহু গ্রামসভা করতে পারেনি। ২০০৯-এ প্রথম বাঁশের পারমিট দেওয়ার অধিকার পেল গ্রামসভা। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। গড়চিরোলির অরণ্যের মূল সম্পদ ভালো জাতের বাঁশ। ১২৫ কোটি টাকা লাভ থাকে কেবল অরণ্য বিভাগেরই। তার আবণ্টন গ্রামসভার হাতে দিলে আইনি সমস্যা হবে– এই মর্মে ভারত সরকারকে চিঠি লেখেন বনবিভাগের সর্বোচ্চ কর্তারা। গড়চিরোলিতেই একটি শিল্প গোষ্ঠী পারমিট পেয়েছে বছরে ২ লাখ টন বাঁশ কাটার। কাজেই বনবিভাগের শিরঃপীড়ার কারণ অনুমান করা যায়।
বৃক্ষমিত্র সংগঠন থেকে হীরালাল এসে দেভাজীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ২২টি গ্রামে ছড়িয়েছে অরণ্য অধিকারের সমুদায়ী করণের কাজ। আজ গ্রামসভার স্বনির্ভর দল আছে, বাঁশ নিয়ে শিল্প কাজ হয়, ঘরে ঘরে বায়ো গ্যাস প্লান্ট। একটি এগারোজনের দল বাঁশ পারমিটের হিসেব রাখে, পারমিট দেয়। দেভাজী তোফা নিজেকে বলেন ‘কইতুর’, মানে মানুষ। বলেন, ‘গোণ্ড’ নামে আমাদের চিহ্নিত করে বহিরাগতরা। যে মানুষের হাতে জনগোষ্ঠীর অরণ্য অধিকার নিয়ে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটেছে, গন্ডোয়ানা ল্যান্ড বা গোণ্ডদের বাসভূমি ভারতের প্রাচীনতম ভূখণ্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা হল, কথা হল বাঙালি লেখকের। পরের দিন ৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক জনজাতি দিবস। কিন্তু পামুল গৌতম, পারলা কোটা আর ইন্দ্রাবতী নদীর সংযোগস্থলে ভমরাগড় তহশিল, যা প্রাচীনতম জনজাতি মাঢ়িয়া গোণ্ডদের বাসভূমি, নদীগুলির প্রবল জলস্ফীতির জন্য সেখানে পৌঁছনো হল না আমার। সম্প্রতি চলে গেছেন হীরালাল। কেন্দ্রে পালাবদলের পর অরণ্য অধিকার আইন নিয়ে তেমন কথা হয় না। অরণ্য-সহ পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বড় শিল্প ও ঠিকাদার বর্গের হাতে। তার ভয়াবহ ছবি দেখা যাচ্ছে দেশের সর্বত্র।
এই তো দু’বছর আগেও, ডিসেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে বারবার আসছিল আক্রান্ত বিনষ্ট এক প্রাচীন অরণ্যের ছবি। বনের সবুজ উপড়ে তুলে ফেলে যন্ত্রে পাথর-মাটি বের করে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাগ। যেন হিংস্র দানবের নখের আঁচড়। ছত্তিশগড়ের তিনটি জেলায় ছড়ানো অতি প্রাচীন, জীব বৈচিত্রে ভরপুর হাসদেও অরণ্যের ৯১ একর জমিতে ছড়ানো ১৫০০০ হাজার গাছ কাটা হল পুলিশ ও আধিকারিকদের প্রহরায়, শ্রমিকদের দিয়ে, বৈদ্যুতিক করাতে। স্থানীয় জনজাতিদের দ্বারা পূজিত শতাধিক বছর প্রাচীন এইসব গাছ উপড়ে ফেলা কী সহজ কথা!
এই জঙ্গলের মধ্যে আছে পারসা ইস্ট ও কান্তা বাসন কোল ব্লক, যার সংক্ষিপ্ত নাম PEKB. এই ব্লকের কয়লা বরাদ্দ করা হয়েছিল রাজস্থানের রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিকে। এটা তো এক নিছক সমাপতন যে, ভারতের অন্যতম ধনী শিল্পপতির কোম্পানির মাইন অপারেটর ও ডেভেলপার।
প্রথম ফেজ-এ ২০১২ পর্যন্ত ৯০ হাজার গাছ কাটা হয়েছিল, অরণ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেই স্বেচ্ছাসেবীদের মতে এই সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে পাঁচগুণ বেশি। দ্বিতীয় ফেজ চালু করার নামে বনের মধ্যে এত জমির ওপর বৃক্ষছেদন জরুরি ছিল কি? এই অরণ্য সংসারের পর হাতিদের চলার পথ নষ্ট হওয়ায় ক্রুদ্ধ হাতিদের আক্রমণে ঘর ভেঙেছে, প্রাণ গেছে মানুষের। আদিবাসী সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ। তাদের প্রতিবাদের কোনও ফল হয়নি। তাঁরা মনে করেন আগের ও এখনকার দুই সরকারই, যথাক্রমে রাজস্থান সরকার এবং শিল্পগোষ্ঠীকে খুশি করতে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। হাসদেও অরণ্যে কয়লা উত্তোলনের জন্য বর্তমান খনি অঞ্চলগুলি নিয়েই শিল্পের কাজ চলত, অরণ্যের বৃহদংশ রেখে দেওয়া যেত ধ্বংসের নাগালের বাইরে। এই নিরন্তর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে জনজাতি জীবন, উচ্ছিন্ন হয়েছে মানুষ। জীববৈচিত্র ও মানবজীবন ধারার বিপুল ক্ষতির প্রশ্ন মুছে গেছে শিল্পোদ্যোগী, শাসক রাজনীতিক ও ঠিকাদার গোষ্ঠী ও লোভের সামনে।
স্বাধীন দেশে যেন ফিরে এসেছে একদা উপনিবেশ সংস্কৃতি। এ দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক ও ভূসম্পদ ব্যবহার করে বিদেশে রফতানি করে শোষণের যে নীতি গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি, স্বাধীন দেশে স্বাধীন জনসমাজের চোখের সামনে তার প্রাকৃতিক সম্পদকে একইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য অবশ্যই উন্নয়ন। ভারতের উন্নয়ন। কিন্তু এই হ্রস্বমেয়াদী চিন্তার ফলে দেশের যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে, তার বিশ্লেষণ তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বহুদিন ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠে এক অরণ্যভূমি। যা কেবল বহু বৃক্ষেরই সমাহার নয়, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-প্রাণী-পাখি-প্রজাপতির পারস্পরিক সম্বন্ধে নির্মিত এক পরিবেশ ব্যবস্থা। গত তিন দশকে পরিণত সেইরকম অরণ্যের ১৪ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার ধ্বংস হয়েছে নানা শিল্প উদ্যোগের জন্য। খনি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, প্রতিরক্ষার প্রয়োজনের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি। ১৫০০০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য এলাকা চলে গেছে জবর দখলের হাতে। এছাড়া ২৫০ বর্গ কিলোমিটারের মতো জঙ্গল এলাকা প্রতি বছর ব্যবহার হতে দেওয়া হচ্ছে অরণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কাজের জন্য। প্রকৃত অরণ্যভূমি ছাড়াও পরিকাঠামো নির্মাণের দোহাই দিয়ে হয়ে চলেছে বৃক্ষচ্ছেদন। পথের দু’ধারে বহু বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব এইসব গাছ মানুষের সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার। কোন রাস্তা কেন চওড়া করা হবে– সে বিষয়ে কোনও পরামর্শ প্রয়োজনীয় নয়। নির্মাণকারী সংস্থা আর তাদের ঠিকেদারদের সব নেতাই পছন্দ করেন। ডাবল লেন হয়ে যায় ফোর লেন আর ফোর লেন হয়ে ওঠে সিক্স লেন। রাস্তার একটাই বৈশিষ্ট্য। তার মসৃণ গতিময়তা। ট্রাক ওভারটেক করবে, ছোট গাড়িকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে, এসইউভি ছুটবে একশো কিলোমিটার স্পিডে। তা বোলপুর হোক বা তিরুঅনন্তপুরম। রাস্তা বাড়াতে নির্বিচারে কাটা পড়বে গাছ।
পরিকাঠামো নির্মাণ একটি জনমোহিনী ব্যাপার। এর প্রচার করা যায়, টেলিভিশনে দেখানো যায়, ছবি তুলে বিজ্ঞাপন করা যায়, সেখানে কোথায় লাগে অপুষ্টি আর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ আর মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ানো? আমাদের নদী পর্বত অরণ্য সবই পরস্পরে অন্বিত এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের জীবনের সঙ্গে মিলে তারাই নির্মাণ করে জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু পরিবেশের জন্য একটি মন্ত্রক থাকলেও তাদের দিক থেকে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কোনও আগ্রহ দেখা যায় না। বরং শিল্পখনি বাঁধ ইত্যাদি বৃহৎ প্রকল্পকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়ার কাজটি তারা যেন সংগোপনেই সারতে চায়। এ প্রবণতার আরম্ভ গত কুড়ি বাইশ বছর ধরে, বিশ্বায়নের পর্বে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের গতি পরিবর্তনের অনুসরণ করেই, গত এক দশকে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে। তার কারণ মুষ্টিমেয় শিল্পগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাত এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব। চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে সাম্প্রতিক দু’টি ব্যাপার। অরণ্য সুমারি করে সরকার জানাচ্ছেন দেশে অরণ্যের আওতায় এলাকা বেড়েছে। কার্যত এর মধ্যে আছে অনেক সংজ্ঞার জোড়াতালি। শহরাঞ্চলের গাছে ছাওয়া অঞ্চলকে অরণ্য বলে দেখানো হয়েছে।
প্লানটেশনকে অরণ্যের আওতায় ধরলে তা প্রকৃত বিচারে ঠিক হয় না। অথচ একই সঙ্গে দেশের প্রাচীন অরণ্যভূমির আয়তন কমেছে, শিল্প ও খনির জন্য নির্বিচারে অরণ্য এলাকা হস্তান্তরিত করার ফল। অন্যদিকে, যে অরণ্য সংরক্ষণ আইন ১৯৮০ থেকে কিছু দুর্নীতি ও অপপ্রয়োগ সত্ত্বেও মোটামুটি একটি মজবুত আইন হিসেবে কাজ করে এসেছে, তাকে সংশোধিত করে নতুন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া আইনটি এখন সংসদের জয়েন্ট কমিটির কাছে। জনসাধারণের মতামত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বনের সুরক্ষার থেকে বৃক্ষরোপণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিপদ লুকিয়ে আছে এই সংশোধনে। ১৯৮০ ও তারপর যেসব অরণ্য নথিভুক্ত হবে, তারা ছাড়া বহু অনথিভুক্ত অরণ্য শিল্প ও অন্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে। এই সংশোধনের কী প্রয়োজন ছিল স্পষ্ট নয়। ধনতন্ত্র যখন উন্নয়ন সংক্রান্ত ব্যাপারে সরকারের প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠে, জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা বদলে গিয়ে ব্যক্তিগত বা মুষ্টিমেয়র দখলে চলে যায়। দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে তা ভালো নয়।
পরিশেষে, আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ নামের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা উপগ্রহের সাহায্যে অরণ্য অঞ্চলের পরিবর্তন মাপে, জানিয়েছে, গত ২৪ বছরে, ভারত ২০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য আচ্ছাদন হারিয়েছে। এই আচ্ছাদন কেবল মানুষের হাতে বনের বিনাশের কারণে নয়, প্রাকৃতিক কারণ যথা দাবানলের জন্যও হতে পারে। কিন্তু চিন্তার কথা, গত ১০ বছরে, ৯০ শতাংশ আচ্ছাদন নষ্ট হয়েছে, প্রাকৃতিক অরণ্য অঞ্চলের ভিতরেই। জঙ্গল সুরক্ষার কাজে এই ধরনের অবহেলা বা দক্ষতার অভাব আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন গ্রামে ও শহরে জনজাতি সম্প্রদায়, যাঁরা বনের ওপর নির্ভরশীল এবং সাধারণ মানুষ, যাঁরা উষ্ণায়নের জন্য জীবিকা ও জীবন দুই-ই হারাতে পারেন। কিন্তু এঁদের জন্য ভাবার সময় কই রাজনীতিক ও নীতি নির্ধারকদের? অরণ্যের সুরক্ষা, অরণ্যবাসীর অধিকার সম্বলিত আইন দু’টি এখন আইনের রক্ষকদের নিশানায়। জনজাতি ও অরণ্যবাসীদের জন্য এরচেয়ে বড় বিপদ কী হতে পারে?
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’