গুরু এই শহরটাকে গিলে খেয়েছিল, এই শহরটা গুরুকে। এই শহরের আলসে, মুখচোরা মেজাজে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল গুরু। তাই গুরু এই শহরে এসে নিজের মুক্তি খুঁজে পেত। বম্বের চৌকসপনা থেকে গুরু শত যোজন দূরে। গুরু নিদ্রিত একটা দ্বীপ ছিল যেন। ‘কাগজ কে ফুল’– যা আজকে ‘ক্লাসিক’ হিসেবে দেখা ও দেখানো হয় তা ফ্লপ করার পর উনি নিজেকে অলক্ষুনে মনে করতেন এবং নির্দেশক হিসেবে নিজের নাম দেওয়া বন্ধ করে দেন। এটা ভারতীয় ছবির একটা ট্র্যাজেডি! কিন্তু এখনও নায়িকার ক্লোজ নিতে গেলে নির্দেশক তার ডিওপি-কে গুরুর রেফারেন্স দেন– এটা একটা রিয়ালিটি।
গুরু দত্তকে নিয়ে লিখতে বসলে এই শহর আর বাঙালি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে। কী মায়ায়, কী ভালোবাসায় একজন অবাঙালি এই শহরটার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে! বুক দিয়ে তিনি আগলেছেন বাঙালিয়ানাকে। তাঁর শৈশবের সব পেয়েছির শহর এই কলকাতা।
হ্যাঁ, গুরু দত্ত পাদুকোন তাঁর বাবার চাকরির কারণে বেশ ছোটবেলায় কলকাতা চলে আসেন। এবং মাছকে যেমন সাঁতার শেখাতে হয় না, গুরু দত্তকেও শেখাতে হয়নি বাংলা– তা যেন ফল্গুর মতো তাঁর ভেতরে বইছিল। ভবানীপুরে, নিজের পাড়ায়, গুরু দত্তর জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষা করার মতো। এইবার ভারতীয় সিনেমার উৎসাহীদের বলি, ওই একই সময় ভবানীপুরে বড় হচ্ছেন হিন্দি ছবির আরেক কিংবদন্তি– রাজ কাপুর! পৃথ্বীরাজ কাপুর সেই সময় ‘নিউ থিয়েটার্স’-এ কর্মরত। রাজ কাপুরও তাঁর শৈশবের শহর নিয়ে সুখস্মৃতি বহন করতেন। কলকাতা এলেই ঢুঁ মারতেন রাধুবাবুতে। কিন্তু রাজ কাপুরের বুকে কলকাতা কোনও শিকড় বিস্তার করেনি, যা করেছিল গুরুর বুকে। গুরু আজীবন নিজেকে বাঙালি ভাবতে ভালোবাসতেন, তাঁর ছবিতে কলকাতা শহরের একটা শট হলেও থাকতই। কলকাতা শহরের ময়দানে বসেই উনি দেখেছিলেন সেই তেল মালিশওয়ালাকে, জন্ম নিয়েছিল ঐতিহাসিক ‘সর যো তেরা চকরায়’। আর ভালোবেসে বিয়ে? তাও তো এক বাঙালিকেই। থাক, সেকথা পরে হবে।
কিন্তু একটা মানুষ, মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বেঁচেছেন, সাকুল্যে আটটা ছবি বানিয়েছেন, তাঁকে যুগে যুগে ঘুরে দেখা প্রয়োজন কেন? এর উত্তর দিয়েছেন কাইফি আজমি, উনি বলেছিলেন, ‘গুরু দত্ত এমন ছবি বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা কমার্শিয়াল হওয়া সত্ত্বেও মানুষের রুচিকে ছোট করে না।’ লাখ কথার এক কথা! গুরু দত্তের প্রভাব তাই সংখ্যায় মাপতে যাওয়া মুর্খামি! দস্তয়েভস্কি যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকে বেরিয়েছি’– ঠিক তেমনই গুরুর পাঞ্জাবি ঝাড়লে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝরে ঝরে পড়বে। উদয়শংকর-এর অ্যাকাডেমিতে নাচ ও কোরিওগ্রাফি শেখা গুরুকে এখনও হিন্দি ছবির গানের অ্যাস্থেটিক্সের গুরু মানতে দ্বিধা করেন না প্রায় কেউই। শুধু ‘পিয়াসা’ বা শুধু ‘কাগজ কে ফুল’ যে কত ফিল্ম-ছাত্রকে জাগিয়ে রেখেছে রাতভর, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।
…………………………………………………………………
গুরু নিজের ছবিতে বারবার সমাজের তৈরি করা সাফল্যের ধারণাকে প্রশ্ন করেছেন, আর বয়ে বেরিয়েছেন এক আশ্চর্য বিষাদের চাদর। তাঁর কাছের বন্ধু দেব আনন্দ যে কারণে একবার গুরুকে প্রশ্ন করেন, ‘আমরা তো সমবয়সি, তুই এত দুঃখের ছবি বানাস কেন?’ গুরু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, নিজে ডুবে গিয়েছিল বিষণ্ণতর কুয়াশায়। তিনি হয়তো পারতেন সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসতে, অথবা পারতেন প্রেমকে একটা ফেজ ভেবে ভুলে যেতে, উনি পারেননি, কোনওটাই পারেননি পুরোপুরি।
…………………………………………………………………
বাকি সব কিছু বাদ দিলাম, গুরুর ছবির গান ভাবুন তো? ‘ইয়ে হ্যায় বম্বে মেরি জান’, ‘সর যো তেরা চকরায়’, ‘জানে ক্যায়া তুনে কাহি’, ‘হাম আপকি আখো মে ইস দিল কো ছুপা দে তো’, ‘জানে ও ক্যায়সে লোগ থে জিনকে’, ‘ইয়ে মেহলো ইয়ে তাক্তো’, ‘না যাও সঁইয়া ছুড়া কে বাইয়া’– আরও কত, এই ছোট্ট ফিল্মোগ্রাফিতে গানের সংখ্যা চমকে দেওয়ার মতো। তার মধ্যে একটা গানের কথা আলাদা করে বলতে হয়, বলতেই হয় তার সার্বিক ব্রিলিয়ান্সের জন্য– ‘ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যা হাসিন সিতম, তুম রাহে না তুম, হাম রাহে না হাম।’ একদিকে শচীন কর্তার ওর’ম অমোঘ সুর! তার সঙ্গে জোট বেধেছেন কাইফি আজমি। লেখা হচ্ছে হিন্দি ফিল্ম লিরিকে প্রথম অক্সিমোরন (পরস্পরবিরোধী শব্দের সহাবস্থান) ‘হাসিন সিতাম’, গাইছেন গীতা দত্ত (হায় রে ভাগ্য), এদিকে রিক্ত শূন্য সেটে মুখোমুখি নির্দেশক ও নায়িকা ও তাঁদের দুর্লঙ্ঘ্য অতীত। এইখানে গুরু ক্যামেরার ভি. কে. মূর্তির সঙ্গে মিলে কী করলেন? সময় হিসেব করে মোক্ষম সময়ে স্টুডিয়োর চাল সরিয়ে দিলেন দুটো জায়গা থেকে স্পটের মতো সূর্যের আলো পড়ল ওয়াহিদা আর গুরুর ওপর। তৈরি হল কালোত্তীর্ণ সিনেম্যাটিক মুহূর্ত!
আবার যখন ‘পিয়াসা’-র ক্লাইম্যাক্সের দিকে তাকাবেন, সংলাপ লেখার আশ্চর্য পরিমিতিবোধ আপনাকে দেশ-কাল পেরিয়ে আলাপ করাবে এক আশ্চর্য আধুনিক মনের সঙ্গে। নিজের খ্যাতি, অর্থ, যশ– সব ছেড়ে বিজয় হেঁটে আসছে, চারপাশে প্রচণ্ড ঝড়! এদিকে নিজের ঘরে জ্বরের ঘোরে উঠে বসছে গুলাবো। সে কারও ডাক শুনতে পেয়েছে, আর কেউ না পাক সে শুনতে পেয়েছে বিজয়ের ডাক। সিঁড়ি দিয়ে গুলাবো (ওয়াহিদা) নেমে দেখে বিজয় (গুরু) দরজায় দাঁড়িয়ে। গুলাবো বিজয়ের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিজয়ের পোশাক ছেঁড়া, অবিন্যস্ত, গলা ক্লান্ত। সেই অবস্থাতেই সে বলে ‘ম্যায় দূর যা রাহা হু গুলাবো’। গুলাবো চমকে তাকিয়ে বলে ‘কাহা’ উত্তরে বিজয় বলে ‘যাহা সে ফির দূর না জানা পরে’। গুলাবোর অভিমানি গলা বলে ওঠে, ‘বস ইয়হি কেহনে কে লিয়ে আয়ে থে?’ বিজয় প্রথমবার এই দৃশ্যে গুলাবোর দিকে তাকায়, তাকিয়ে বলে, ‘সাথ চালোগি মেরে?’… দৃশ্য শেষ। নায়ক-নায়িকা অনন্ত জীবনের পথে হেঁটে যায় হাত ধরে। কী আধুনিক! কী রোমান্টিক, অথচ কী মিনিমালিস্টিক। এবং নায়ক-নায়িকার এই দৃশ্যে অবশ্যম্ভাবী ভাবে বেজে উঠছে খোল-করতালের আনন্দময় ধ্বনি, যা রাধাকৃষ্ণের মিলনের অনুষঙ্গ বহন করছে। কত কিছু করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু না করার যে আশ্চর্য সংযম, তা দেখে আমার পাগল পাগল লাগে। অথচ যতবার শুনি ‘সাথ চালোগি মেরে?’ গলার কাছটায় কষ্ট হয়।
কী হত যদি সেদিন মোষ এসে ঢুঁসিয়ে গুরুর গাড়ি মাদ্রাজে খারাপ না করে দিত? গুরু সেদিন বাধ্য হয়ে মাদ্রাজে থেকে গেলেন বলেই ওয়াহিদার মা সুযোগ পেলেন নিজের মেয়েকে একবার গুরুকে দেখানোর। ভালোবাসা গুরুকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে বরাবর। ১৯৪৪-এ উদয়শঙ্করের আলমোরার স্কুল থেকে বিতাড়িত হন প্রেমের জন্য। তারপর ‘প্রভাত ফিল্মস’-এর বাবুরাও পাইয়ের ওখানে চাকরির সময় দলের ড্যান্সারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বরখাস্ত হন। প্রেমের জন্য গুরু চিরকাল নিজের জীবন বাজি রেখেছেন, সেই প্রেম যে সত্যিই তাঁর জীবন নিয়ে নেবে, তা যদি কেউ জানত! কেউ দায়ী নয়, কাউকে দায়ী করারও নেই, কিন্তু একটা ঊনচল্লিশ বছরের এরকম সম্ভাবনাময় জীবন যখন চলে যায়– তখন একটা নিষ্ফল রাগ ছাড়া আমরা দর্শকরা কী করতে পারি? গুরু নিজের ছবিতে বারবার সমাজের তৈরি করা সাফল্যের ধারণাকে প্রশ্ন করেছেন, আর বয়ে বেরিয়েছেন এক আশ্চর্য বিষাদের চাদর। তাঁর কাছের বন্ধু দেব আনন্দ যে কারণে একবার গুরুকে প্রশ্ন করেন, ‘আমরা তো সমবয়সি, তুই এত দুঃখের ছবি বানাস কেন?’ গুরু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, নিজে ডুবে গিয়েছিল বিষণ্ণতর কুয়াশায়। তিনি হয়তো পারতেন সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসতে, অথবা পারতেন প্রেমকে একটা ফেজ ভেবে ভুলে যেতে, উনি পারেননি, কোনওটাই পারেননি পুরোপুরি। মাঝখান থেকে নিজের ভেতর নিজে ধ্বংস হয়েছেন। একটা মোম দুই দিক থেকে পুড়ছিল, তাই তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।
কলকাতা। গুরুর কলকাতা। পুবদিকের এই শহরটায় বিকেল অনেক তড়িঘড়ি সন্ধের চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে। পাশের বেঞ্চে বসে সকালের বাসী পেপার পড়া বিষণ্ণতা। এরা প্রত্যেকে সবার পূর্ব-পরিচিত। শহরটার তখন অভিযোগের শেষ নেই। কারও বল হারিয়েছে, কারও ডায়েরি থেকে গান। কারও ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, কারও কোথাও যাওয়ারই নেই আর। কারও কারও কোনও অঙ্ক মিলছে না বলে আতঙ্কে, কাল কী হবে? কার সব অঙ্ক মিলে গিয়েছে, তাই কাল নিয়ে উৎসাহ নেই। এইসব অভিযোগ মুচকি হাসতে হাসতে বিষণ্ণতা শোনে। এই সময় তর্ক বাধে বৃষ্টির ও মৃত্যুর। কে আগে আসবে? বৃষ্টিই জেতে বেশিরভাগ। গুরু এই শহরটাকে গিলে খেয়েছিল, এই শহরটা গুরুকে। এই শহরের আলসে, মুখচোরা মেজাজে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল গুরু। তাই গুরু এই শহরে এসে নিজের মুক্তি খুঁজে পেত। বম্বের চৌকসপনা থেকে গুরু শত যোজন দূরে নিভৃত একটা দ্বীপ ছিল যেন। ‘কাগজ কে ফুল’– যা আজকে ‘ক্লাসিক’ হিসেবে দেখা ও দেখানো হয় তা ফ্লপ করার পর উনি নিজেকে অলক্ষুনে মনে করতেন এবং নির্দেশক হিসেবে নিজের নাম দেওয়া বন্ধ করে দেন। এটা ভারতীয় ছবির একটা ট্র্যাজেডি! কিন্তু এখনও নায়িকার ক্লোজ নিতে গেলে নির্দেশক তার ডিওপি-কে গুরুর রেফারেন্স দেন– এটা একটা রিয়ালিটি। যে মানুষটা নিজের ছবির প্রত্যেকটা ফ্রেম যত্ন নিয়ে সাজাতেন তিনি নিজের জীবন সাজিয়ে উঠতে পারলেন না। আসলে কিছু মানুষ মানুষ সব পারেন, হৃদয়ের দরবারে তছরুপ করতে পারেন না। আর যারা হৃদয় থেকে বাঁচে, তাদের এক্সপায়ারি ডেট ঠিক করবে এমন সর্বশক্তিমান কে আছে? তাই গুরু থাকবেন। প্রত্যেকটা স্বপ্ন দেখা চোখে, লিপস্টিকের দাগ তুলতে ভুলে যাওয়া নায়কের ভ্রান্তিতে, ব্যর্থ বোরিং ক্লাসরুমে ছাত্রের কল্পনায় শিক্ষকের পিছনে হওয়া কোরিওগ্রাফিতে।
সব জায়গায় গুরু আছেন, শুধু দুঃখটুকু একা গিলে নিয়েছেন। ওটার ভাগ কারও নয়।
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।