‘রাতের কলকাতা’ প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল শতবর্ষ আগে, ১৯২৩ সালে। ‘মেঘনাদ গুপ্ত’ ছদ্মনামে তা লিখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। ১০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে সেই রাতের সাক্ষ্য-প্রমাণের, লিখে রাখার। কলকাতার রাত্রিচরিত্রও বদলে গিয়েছে প্রবল। রাত কি আজও তেমনতর রাত? তাতে কি মিশে নেই আলোর ভেজাল? হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্মদিনে সেই কলকাতার রাত নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক আলাপ-বিলাপ।
রাতের গায়ে লেগে অন্ধকারের পরত। আর, অন্ধকার নিজেই এক আশ্চর্য প্রকল্প। যে কোনও কিছুকে বেমালুম হাপিস করে দেওয়ার চালে সে তাবড় জাদুকরদেরও হার মানিয়ে এসেছে বরাবর। সেজন্যই, অন্ধকারের সঙ্গে রহস্যের নাছোড় দোস্তি। তাদের সেই গোপন গোপন খেলার সাক্ষী পুরনো শহরেরা। যে শহরের গলিঘুঁজি, কোনা-খামচিকে আলো পুরোটা গিলে খেতে পারেনি। আসলে আলোর ঝাঁ-চকচকে উঠোন জুড়ে তো কোনও রহস্যের দানাপানি নেই। সে একেবারে নিকোনো পরিষ্কার। অথচ অন্ধকারের আড়ালে দৈত্যের হাঁ-মুখ গুহাও থাকতে পারে, আবার থাকতে পারে সাত রাজার ধন এক মানিকও, অন্তত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যাশার বাইরে থেকে যাওয়া এইসব সম্ভাবনাকে ছুঁয়ে-ছেনে দেখা আলোর নাগালে নেই। তবে অন্ধকারের দাবি কিন্তু তাতে একচেটিয়া। আর সে দাবিদাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েই তার থেকে রহস্য চেয়েচিন্তে গায়ে মেখে নেয় পুরনো শহর। যে অভ্যাস জারি রেখেছিল কলকাতাও।
কলকাতার সে রাত্রি রহস্যকে এককালে খুঁজেপেতে দেখতে চেয়েছিলেন একজন সাহসী মানুষ। আসলে অন্ধকারের রহস্য হাতড়ে দেখার দিকে সাহসের একটা নিষিদ্ধ টান আছে বরাবরই, তা সে চিলেকোঠার ঝুপসি আঁধার হোক কি মাঝরাতের শ্মশান। এই মানুষটির সাহস তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পুরনো কলকাতার অলি-গলিতে, যার কোথাও বসেছে চণ্ডুর আসর তো কোথাও বেলফুলের মালা আর মদ-আতরের গন্ধে বাতাস ভারী। শোনা যায়, মোটা লাঠি হাতে সে আলো-আঁধারি শহর ঘুরে ফিরতেন তিনি, যাতে অন্ধকার আর বিপদ দুই-ই পরখ করা চলে। অন্ধকারের সেসব ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে তিনি জড়ো করেছিলেন দু’মলাটের ভিতর, যার নাম ‘রাতের কলকাতা’। সেই রাতের রহস্যে ডুব দেওয়ার অধিকার নাকি বরাদ্দ কেবল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্যই, বইয়ের প্রস্তাবনাতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মেঘনাদ গুপ্ত। আমরা অবশ্য তাঁকে চিনি হেমেন্দ্রকুমার রায় নামেই।
কেন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পড়ার অধিকারেই এ বইয়ের গণ্ডি টানা? কারণ সেই রহস্যের কলকাতার সঙ্গে যেটুকু যা যোগাযোগ, তা তাঁদের পক্ষেই থাকা সম্ভব। কলকাতা শহরে যেসব অঞ্চল সেকালে রাত জাগত, তার মধ্যে পড়ে শ্মশান, বেশ্যাপাড়া, হাসপাতাল, পানশালা, বড়জোর গোটাকয় রেস্তরাঁ ও পাইকারি বাজার। মেঘনাদ গুপ্তের চোখে দেখা বিশ শতকের গোড়ার শহরে সেসব জায়গায় নারীর প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য ব্যতিক্রম কলকাতার রাতপরিরা। সোনাগাছি থেকে হাড়কাটা গলি, চিৎপুর থেকে খিদিরপুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রাতের রানিদের সঙ্গে রসালাপ জমাতে কলকাতার বাধেনি কোনও কালেই। সেই রসালাপের দামও অবশ্য সে মাঝে মাঝেই উসুল করে নিয়েছে কড়ায়গন্ডায়। মেঘনাদ গুপ্ত লিখছেন, সাহিত্যজগতের পরিচিত এক ‘ভদ্রলোক’ তাঁর দুই বন্ধুকে নিয়ে ঢুকেছেন এক পরমাসুন্দরীর ঘরে। তাঁদের বসিয়ে রেখে বাইরে চলে গেল সে নারী। তার আর ফেরার নাম নেই দেখে চাতক পুরুষেরা অস্থির। এদিকে-ওদিকে নজর ঘোরাতেই দেখা গেল, বিছানায় কী যেন ঢাকা দেওয়া। ঢাকা সরাতেই… গলা কাটা মৃতদেহ! ঘরের দরজাও ততক্ষণে বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু বেশ্যাপল্লি কেন, শ্মশানের পথেও কি রহস্য কম? এক বৃদ্ধকে মৃতদেহ সৎকারে সাহায্য করতে গিয়ে যুবকেরা দেখে, জরাজীর্ণ বাড়ির একটি ঘরে চাদরে ঢেকে রাখা দেহ। ঘরে একটি প্রদীপ পর্যন্ত জ্বলছে না। মৃতদেহ তুলে শ্মশানের পথে যদি বা হাঁটা দেওয়া গেল, কিন্তু কাঁধে জলের ফোঁটা পড়ছে কোথা থেকে? আকাশ তো পরিষ্কার! সন্দেহ হতেই থমকে দাঁড়াল শ্মশানযাত্রীরা। দেখা গেল, জল নয়, চুঁইয়ে পড়ছে টাটকা রক্ত। সেই বৃদ্ধ বেপাত্তা, আর মড়ার চালিতে শুয়ে সদ্য খুন হওয়া এক নারীর লাশ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সোনাগাছি থেকে হাড়কাটা গলি, চিৎপুর থেকে খিদিরপুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রাতের রানিদের সঙ্গে রসালাপ জমাতে কলকাতার বাধেনি কোনও কালেই। সেই রসালাপের দামও অবশ্য সে মাঝে মাঝেই উসুল করে নিয়েছে কড়ায়গন্ডায়। মেঘনাদ গুপ্ত লিখছেন, সাহিত্যজগতের পরিচিত এক ‘ভদ্রলোক’ তাঁর দুই বন্ধুকে নিয়ে ঢুকেছেন এক পরমাসুন্দরীর ঘরে। তাঁদের বসিয়ে রেখে বাইরে চলে গেল সে নারী। তার আর ফেরার নাম নেই দেখে চাতক পুরুষেরা অস্থির। এদিকে-ওদিকে নজর ঘোরাতেই দেখা গেল, বিছানায় কী যেন ঢাকা দেওয়া। ঢাকা সরাতেই… গলা কাটা মৃতদেহ!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে অন্ধকারকে আশ্রয় করেই তো গড়ে ওঠে অন্ধকার জগৎ নামে ব্যাপারখানা। আর সেকেলে কলকাতার গায়ের গোপন ভাঁজে ভাঁজে তখন দুই আঁধারেরই ঘরবসত। পলাশির যুদ্ধের পরে বণিকের মানদণ্ড বদলে গিয়েছিল রাজদণ্ডে। আর তারও ঠিক একশো বছর পরে, ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে ব্রিটিশরাজের শাসন শুরু হয় ভারতে। সেই অখণ্ড সাম্রাজ্যের রাজধানীর মুকুট তখন কলকাতারই মাথায়। ‘রাতের কলকাতা’ প্রথম প্রকাশ পাচ্ছে ১৯২৩ সালে, কিন্তু সেখানে যে কলকাতার ঠিকানা তা সেই রাজধানী শহর। অর্থাৎ ১৯১১ সালের রাজধানী বদলের আগেই এ শহরের রাতের রহস্য চিনছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। নতুন গড়ে ওঠা উপনিবেশের একদিকে তখন আলো এসে পড়ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের, চিন্তা-চেতনার নতুন আলো। আরেকদিকে তার কোণে কোণে তখনও জমে আছে বহুযুগের অন্ধকার। শুধু তাই নয়, এ আলো থেকে মুখ বাঁচিয়ে জেগে আছে তার অন্ধকার জগৎও। আসলে কোনও জনপদ যখন ভেতরে বাইরে বেড়ে ওঠে, তখন তার অন্ধকার জগতের বয়ানটাও পালটে যেতে থাকে। কেবল অভাব নয়, অতিরেকও সে অন্ধকারকে ঘনিয়ে তোলে। রাজধানী নগরীর বাড়তি আলোর চাকচিক্য তেমনই আঁধারের উপাখ্যান লিখে চলেছিল সেসময়ে। আর এই আলো-আঁধারির মিশেলে বোনা রহস্যের চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিল কলকাতা। সে ধুলো-কাদার শহর গৃহস্থ মধ্যবিত্তের অদেখা। ‘ভদ্রলোক’-এর দেখতে না চাওয়া। রাতের আড়াল নিয়ে শহরের গর্ভ থেকে সে অন্য শহর ভূমিষ্ঠ হয় রোজ। কলকাতার সেই সমান্তরাল নৈশ জীবনের ‘নকশা’ চেনাচ্ছিলেন মেঘনাদ গুপ্ত, আত্মপরিচয়কে সর্বার্থে গুপ্ত রেখেই।
কিন্তু চিনেপাড়া, সোনাগাছি, ফুলবাগান, চৌরঙ্গীর রাতের যাপন দেখতে দেখতে যে নিশাচর এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ‘বাঙালির হোটেলে খাওয়ার সঙ্গে গণিকালয়ে গমনের সম্পর্ক কিছু ঘনিষ্ঠ, তাই সোনাগাছি অঞ্চলেই হোটেলের সংখ্যা বেশি’, সে কলকাতা শহরটাই কি আজ আর অবিকল আছে? তাহলে শহরের সে রাত আর জেগে থাকে কেমন করে! নাকি সে রাতের রহস্য আদৌ আর জারি থাকা সম্ভব! এমএনসি আর কল সেন্টারের দাপাদাপিতে সমস্ত মেগা শহরেই এখন খুলে গিয়েছে সমান্তরাল এক-একটা রাতের শহর। কলকাতাও নাম লিখিয়েছে বইকি সে নিশিযাপনের দলে। সেখানে রাত আছে, কিন্তু সে রাত আর রহস্যের মধ্যে পড়ে না। উন্নয়নের জোয়ারে দিনের অর্ধেকটা সময় শহর থাকে সূর্যালোকের নিচে, আর বাকি অর্ধেক সময় ত্রিফলার আন্ডারে। অন্ধকারই যে রহস্যের আঁতুড়, তাকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে রহস্যই বা বেঁচেবর্তে থাকবে কেন! তা বলে কি উন্নতির বিপক্ষে হেঁটে শহরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়ার সওয়াল চলছে, নাকি চোর-ডাকাতি-পকেটমারি-খুনোখুনির অন্ধকার জগতের প্রতিই সহৃদয় হতে চাইছে এ লেখা? না, তার কোনওটিই নয়। শহর আর রাত, কোনও কিছুই আগের মতো একরকম থাকবে না, কিন্তু তাই বলে রহস্য নামক বস্তুটিই থাকবে না, এ-ও বা হয় কী করে? তাই এ আদতে একধরনের দুশ্চিন্তাই, অন্ধকারকে ভালোবেসে। কিংবা কলকাতাকে ভালোবেসে। আলোকের এই ঝরনাধারার মধ্যেও কলকাতায় যেটুকু ঘুপচি বেঁচে আছে, তা নিয়ে এখনও এই কলকাতাকে খানিক হলেও রহস্যময় লাগে। কলকাতা যতই আলোকিত হয়ে উঠুক কেন, সেই আলো যেন কখনওই সেই অন্ধকারের গায়ে এসে না পড়ে। তা না টিকে থাকলে এ শহরকে কীভাবেই বা আলাদা করা যাবে অন্য শহরের সঙ্গে? সমস্ত কিছু এক ছাঁচে ফেলে দেওয়ার স্বভাবে বিশ্বায়নের যে প্রবল বাঁদরামো, তার মোক্ষম দাওয়াই হয়তো কলকাতার রাত, আর কলকাতার রাত্রি রহস্যই।