কারারুদ্ধ ও অত্যাচারিত ইলা মিত্র কীভাবে রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলা করেছিলেন, সে কথা নিয়ে বেশ কিছু বৌদ্ধিক চর্চা হয়েছে, গান-কবিতাও আছে। কিন্তু তার আগে, ১৮ থেকে ২৩-২৪ বছরের মধ্যে পরিবার ও সমাজ আরোপিত অদৃশ্য বেড়িগুলো কীভাবে ইলা অসীম সাহস ও অনন্য কৌশলে খুলতে খুলতে গেছেন, কীভাবে তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে প্রখর রাজনৈতিক সচেতনতা, তা নিয়ে খুব কমই কথা হয়।
’৫০-এর মন্বন্তরের ৮০ বছর চলছে। নানাদিক থেকে ফিরে পড়া হচ্ছে ইংরেজ-প্রসূত দুর্ভিক্ষের সেই ভয়াবহ সময়কে। আমি ভাবছি, ১৯৪৩ সালে বেথুন কলেজে পাঠরত একটি ১৮ বছরের মেয়ের কথা। যাতায়াতের পথে যার চোখে পড়ত কলেজের কাছেই মহিলা পরিচালিত একটি লঙ্গরখানা। মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠা মেয়েটি সেখানে গিয়ে কথা বলে, কিছু করতে চায় দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য। সেই থেকে যুক্ত হয়ে যায় প্রথমে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ-বিরোধী কাজে ও পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে। নিয়মিত ক্লাস করে, রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে পার্টির সদস্য পদ পায় বেশ কিছুদিন পর।
এদিকে মেয়েটির বাবা সরকারি চাকুরে। মেয়ের এসব রাজনীতি-টিতি করা একেবারেই ভালো চোখে দেখেন না তিনি। যদিও মেয়েকে খেলাধুলার জন্য এদিক-সেদিক যেতে কখনও বাধা দেননি। দৌড়বাজ মেয়েটি অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৪০-এর অলিম্পিকে যাওয়াও প্রায় নিশ্চিত ছিল তার। নেহাত যুদ্ধের জন্য অলিম্পিক বাতিল হল সেবার।
কলেজ-পড়ুয়া মেয়েকে এসব রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনার জন্য তার বাবা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৫ সালে বি.এ. পড়া শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে ঠিক করেন মেয়ের। বিয়ের পর মেয়েটিকে চলে যেতে হয় অবিভক্ত বাংলার মালদা জেলার রামচন্দ্রপুরে– সেখানকার জমিদার বংশের বউ হয়ে। গিয়ে দেখে তার স্বামী রমেন মিত্র কৃষকসভার সদস্য– গোপনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মিটিং করেন। কিন্তু জমিদার বাড়ির মেয়ে-বউদের স্বাধীনতা নেই বাড়ির বাইরে পা রাখার। একটা জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সে বাড়ি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এসব নিয়ে কথা কম হওয়াটা যে শুধু ইলার বেলাতেই ঘটেছে, তা নয়। বেশিরভাগ নারী রাজনৈতিক কর্মী-নেত্রীদের বেলাতেই এটা আমরা দেখতে পাই– গুরুত্ব পায় কোনও রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রকাশ্য লড়াইয়ের ময়দানে মেয়েদের ভূমিকা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছোট থেকে খেলাধুলা ও কলেজে দু’-বছর এক অন্যরকম রাজনীতির স্বাদ পাওয়া মেয়েটি ঠিক করে যেভাবেই হোক বন্দিজীবন থেকে বেরতে হবে। জমিদারবাড়ির ছোট বউ, ২০ বছরের মেয়েটির মনে হয়, তার স্বামীর বন্ধু আলতাফ মিয়া একজন প্রগতিশীল মানুষ। তাঁর উদ্যোগেই গ্রামের মেয়েদের পড়ানোর একটা স্কুল চালু হয়। আলতাফ মিয়া নিজের বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দেন এবং পড়ানোর জন্য বন্ধুপত্নীকে গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে রোজ সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বিয়ের তিন-চার মাস পরে নিজের অদম্য জেদে এভাবে বাড়ি থেকে বেরতে শুরু করে যে মেয়েটি, বছর দুয়েকের মধ্যেই সে আত্মগোপন করে চলে যায় নাচোলে, যেখানে তাঁর স্বামী ও অন্যান্য সহযোদ্ধা জোতদার ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন আধিয়ার ও বর্গাচাষিদের মধ্যে। একটি সাঁওতাল কৃষিজীবী পরিবারের সঙ্গে থেকে কাজ করতে থাকে মেয়েটি, যে পরিবারের মাথায় ছিলেন মাতলা মাঝি নামে এক কৃষক নেতা।
এর মধ্যে দেশভাগ ঘটে যায়, মেয়েটিও মা হয়। আত্মগোপনে ১৯৪৮ সালে একবার কলকাতায় এসে মেডিকেল কলেজে ছেলের জন্ম দিয়ে ১৬ দিন বাদে ফিরে যায় পূর্ব-পাকিস্তানে তেভাগার কাজে। ছেলে বড় হয় তার ঠাকুরমার কাছে।
তারপর ৫ জানুয়ারি ১৯৫০। নাচোলে কৃষক-পুলিশবাহিনী সংঘর্ষে চার-পাঁচজন পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়। তার বদলা নিতে ৭ জানুয়ারি বিরাট মিলিটারি বাহিনী পুড়িয়ে দেয় ১২টি গ্রাম। ৫ জানুয়ারির ঘটনায় পুলিশকে আক্রমণের আদেশ দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় ২৫ বছরের মেয়েটির নামে। গ্রেপ্তার করে নাচোল থানায় ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলে তার ওপর, করা হয় অকথ্য যৌন অত্যাচার। পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলিম লিগ সরকার মেয়েটির ‘হিন্দু’ পরিচয় ভাঙিয়ে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করে– প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে যে একজন হিন্দু নারীর নির্দেশে মুসলিম পুলিশকর্মীদের প্রাণ গেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: গানে রবীন্দ্রনাথের ঋণ, তাই সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব পথ তৈরি করতে চেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পূর্ব-পাকিস্তানের জেলে ও হাসপাতালে বছর পাঁচেক বন্দি থাকার পর ১৯৫৫ সালে অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় আনা হয় মেয়েটিকে। সাত-আট বছরের ছেলের সঙ্গে এতদিনে দেখা হয় তার মায়ের। ৩০ বছরের মেয়েটির নাম তখন বহু মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
ইলা মিত্র– যাঁর নামে ততদিনে এপার বাংলায় লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি কবিতা।
আমরা সাধারণত ইলা মিত্র-র কথা জানি নাচোলে কৃষক অভ্যুত্থান ও পূর্ব-পাকিস্থান রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন ছিলেন তিনি, সেই সময়ের কথা প্রসঙ্গে। কারারুদ্ধ ও অত্যাচারিত ইলা কীভাবে রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলা করেছিলেন, সে কথা নিয়ে বেশ কিছু বৌদ্ধিক চর্চা হয়েছে, গান-কবিতাও আছে। কিন্তু তার আগে, ১৮ থেকে ২৩-২৪ বছরের মধ্যে পরিবার ও সমাজ আরোপিত অদৃশ্য বেড়িগুলো কীভাবে ইলা অসীম সাহস ও অনন্য কৌশলে খুলতে খুলতে গেছেন, কীভাবে তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে প্রখর রাজনৈতিক সচেতনতা, তা নিয়ে খুব কমই কথা হয়।
এসব নিয়ে কথা কম হওয়াটা যে শুধু ইলার বেলাতেই ঘটেছে, তা নয়। বেশিরভাগ নারী রাজনৈতিক কর্মী-নেত্রীদের বেলাতেই এটা আমরা দেখতে পাই– গুরুত্ব পায় কোনও রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রকাশ্য লড়াইয়ের ময়দানে মেয়েদের ভূমিকা। লড়াইয়ের অন্যান্য মাত্রাগুলো হারিয়ে যায়। তাই আমি সেই আগের পর্বের ইঙ্গিত এখানে একটু দিলাম।
আর একটি কথা বলতে চাই এই ছোট লেখায়। ইলা মিত্র যতদিন বেঁচেছিলেন (১৯২৫-২০০২), ততদিন নিজের লিখিত বক্তব্যে, বিভিন্ন গবেষককে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে (যেমন– মালেকা বেগম, কবিতা পাঞ্জাবী, শাহরিয়ার কবির), তিনি বারবার তুলে ধরেছেন কীভাবে তাঁর সঙ্গে একই সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ৬০-৭০ জন সাঁওতাল কৃষককে বীভৎস পুলিশি অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, মারতে মারতে মেরে ফেলা হয়েছে অনেককে। মালেকা বেগমকে লেখা একটি চিঠিতে (১৯.১১.৮৬) ইলা লিখছেন:
“নবাবগঞ্জ থানায় গিয়ে দেখলাম সমস্ত কৃষক সাঁওতালদের উপরে প্রচণ্ড নির্যাতন চলছে। আমাকে একটি সেলে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে তাদের টর্চার ও মৃত্যু নিজের চোখে দেখলাম। পুলিশ বুটের লাথি মারতে মারতে মেরেই ফেলল হরেক প্রভৃতি কয়েকজনকে, কিন্তু তবু তারা আমার নাম করল না। পুলিশদের জিজ্ঞাসা ছিল, ‘বল রাণীমাই (ইলাকে এই নামে ডাকা হত) তোদের পুলিশ খুন করার হুকুম দিয়েছিল।’ কিন্তু তারা একবারও আমার নাম উচ্চারণ করেনি। এ যে আমার কাছে কত বড় শিক্ষা– লিখে ভাষায় বোঝাতে পারব না… আমাদের কেসে একজনকেও পুলিশ রাজসাক্ষী করতে পারেনি।”
এভাবেই ব্যর্থ হয়ে গেছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লিগ সরকারের সাম্প্রদায়িক ফায়দা তোলার চেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গের কিছু রাজনৈতিক নেতা ও সংবাদমাধ্যমের একটা অংশের ঘটনাটাকে মুসলিম রাষ্ট্র দ্বারা হিন্দু নারীর ইজ্জত হরণ হিসেবে প্রচার করার চেষ্টাও হয়েছিল ওই একই সময়ে।
কিন্তু নাচোলে যেমন, অন্যত্রও তেমনই। তেভাগা আন্দোলনে গ্রামের সাধারণ কিষাণ-কিষাণীদের ওপর বর্বর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপা পড়ে গেছে। ইলা মিত্র শিক্ষিত সাবর্ণ হিন্দু পরিবারের মেয়ে বলে তাঁর ওপর ঘটা নিপীড়ন নিয়ে তখন শোরগোল হয়েছিল। এখনও আমরা সে-কথা স্মরণ করি, আলোচিত হয় তাঁর অনন্য ভূমিকা।
এর পাশাপাশি জনমানসে হারিয়ে যায় বহু নাম, যে নামগুলো শুধুমাত্র কিছু পরিবারের স্মৃতিতে, কিছু গ্রামের জীর্ণ স্মারকস্তম্ভে এবং কিছু বামপন্থী দলিল-দস্তাবেজে বেঁচে আছে। পুলিশের গুলিতে গর্ভবতী অবস্থায় মৃত্যু হওয়া দিনাজপুরের কৌশল্যা কামরানী, চন্দনপিড়ির অহল্যা দাস, হাওড়ার সুধাময়ী সাঁতরার নাম মুছে গেছে। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে তেভাগায় নিহত যশোদারানী সরকার, সুনিমা সিং, ফকো বর্মণী, সরোজিনী দাস, উত্তমী দাস, বাতাসী সিংহ, করমী ওরাওঁনি, বুধনী ওরাওঁনি, সুরধনী বাজ, বৃন্দা বাউরি, পাঁচুবালা ভৌমিক, মুক্তকেশী মাঝির মতো আরও কত নাম।
ইলা কিন্তু মনে রেখেছিলেন। তাই তিনি বারবার এঁদের কথা বলার ওপরেই জোর দিতেন।
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।