রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে যাঁরা কবিতা লিখতে আসছেন, এক অর্থে রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিপক্ষ’ না-মানলে নিজের পথ খুঁজে পাওয়াই সেকালে হত মুশকিল। বুদ্ধদেব বসু একেই বলেছিলেন, ‘আমাদের পরম ভাগ্যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, কিন্তু এই মহাকবিকে পাবার জন্য কিছু মূল্যও দিয়ে হয়েছে আমাদের’। ‘কল্লোল’-এর কবি-সাহিত্যিক-সহ সেকালের অনেক লেখকই এই অনিবার্য মূল্য চুকিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিপক্ষ’ মানার মূল্য।
‘তিনজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলী লুটোয় পাপোষে’ লিখে একসময় অনেকখানি ধিক্কার কুড়িয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু একথা কিছুতেই ভুললে চলে না যে রবীন্দ্ররচনাবলি আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত নানা বই ছিল পাঠক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রায়-এক চিরকালীন সঙ্গী। ‘রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলন-সম্পাদনা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের জীবনকে কেন্দ্র করে লিখেছেন এক অতি-বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে রবীন্দ্র-সৃষ্টির অগণিত অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে লিখতে বসে কখনও জানিয়েছেন, ‘তাঁর বিশালত্ব ও মহত্ত্বের কাছে আজও নতজানু’, কখনও-বা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা, নাটক, গদ্য পড়ে আজও ‘আনন্দ পাই, কাঁদি’।
কিন্তু ওই যে রচনাবলীর ওপর লাথির-ঘা, ওই কটুবাক্যের কী হবে? ও-কথা লিখতে গেলেন কেন আদৌ? সে কৌতূহলের জবাবও সুনীল দিয়ে গেছেন স্পষ্ট ভাষাতেই। তিনি জানিয়েছিলেন ও-লাইনের আসল লক্ষ্য ছিল সেকালের রবীন্দ্র-‘ভক্ত’রা। আক্ষরিক অর্থেই যাঁরা ভক্ত, ‘তাঁকে [রবীন্দ্রনাথকে] গুরুঠাকুর বানিয়ে পূজা করার চেষ্টা’-র বিরুদ্ধেই ছিল ওই এক-লাইনের জেহাদ।
অবশ্য এই ব্যাখ্যাও যে খানিক অসম্পূর্ণ, সে কথাও এখানে মনে রাখা দরকার। বাংলা সাহিত্যে এবং বাঙালির মনে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল উপস্থিতি, সেখানে তাঁকে পাশে সরিয়ে রেখে নিজস্ব একটা পথ খুঁজে নেওয়াটাই ছিল বাঙালি লেখকদের কাছে রবীন্দ্র-পরবর্তী কয়েক দশক-জোড়া এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ভঙ্গিতেই কখনও কখনও বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়ে অমন লাইনের জন্ম হয়েছে। আসলে এই সবকিছুর সার কথাটা জয় গোস্বামী তাঁর একটা কবিতায় চমৎকার করে বলেছিলেন, ‘কিন্তু কলম হাতে নিলে ও চিরকাল তোমায়/ এ পাশ থেকে ও পাশ ফিরে শোয়াই’। এই কবিতায় ‘চিরকাল’ হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বাঙালির সর্বকালীন কণ্ঠস্বর। কিন্তু অন্য কোনও বাঙালি কবি যখন কলম হাতে তুলে নেন, তখন ওই চিরকালীন-রবীন্দ্রনাথকে তাঁকে ‘অস্বীকার’ করতেই হয়। নইলে তাঁর নিজের কবিতা লেখার কোনও মানে থাকে না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য আত্মজীবনী ‘তরী হতে তীর’-এর ওই আশ্চর্য উৎসর্গপত্রটি নিয়ে প্রায় কখনও কথা বলতে শোনা যায় না? কী ছিল সেই উৎসর্গপত্রে? ছিল একট ছোট্ট শ্লোক: ‘ত্বদীয়ং বস্তু গোবিন্দ/তুভ্যমেব সমর্পয়ে’। তোমার জিনিস, তোমাকেই দিলাম। অর্থাৎ, এই-যে আত্মজীবনী, এ ‘তোমার’ই। কিন্তু কে এই ‘তুমি’? কে আবার! ওই শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করার আগে বড় হরফে লিখে দেন হীরেন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ নিত্যস্মরণীয়েষু’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা জয় গোস্বামী রবীন্দ্র-সমসাময়িক কবি নন। তবু তাঁদের এতখানি জোর দিয়ে ওই ‘অস্বীকার’-এর কথাখানি বলে যেতে হচ্ছে। ফলে এইটে সহজেই বোধগম্য যে, রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে যাঁরা কবিতা লিখতে আসছেন, এক অর্থে রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিপক্ষ’ না-মানলে নিজের পথ খুঁজে পাওয়াই সেকালে হত মুশকিল। বুদ্ধদেব বসু একেই বলেছিলেন, ‘আমাদের পরম ভাগ্যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, কিন্তু এই মহাকবিকে পাবার জন্য কিছু মূল্যও দিয়ে হয়েছে আমাদের’। ‘কল্লোল’-এর কবি-সাহিত্যিক-সহ সেকালের অনেক লেখকই এই অনিবার্য মূল্য চুকিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিপক্ষ’ মানার মূল্য। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বিখ্যাত এবং বহু-ব্যবহৃত কবিতাটির দুটো লাইন এখানে আর একবার উদ্ধৃত করা যাতে পেরে। ‘আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো/ যুগসূর্য ম্লান তার কাছে’। প্রথমত এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি কোনও অশ্রদ্ধা নেই, বরং তিনিই যে ‘যুগসূর্য’ সেই আন্তরিক স্বীকৃতিই আছে। দ্বিতীয়ত, ক্রিয়ার ভবিষ্যৎ কাল লক্ষণীয়। ‘জ্বালিব’। অর্থাৎ, এখনও ম্লান করে দেওয়ার মতো আলো জ্বেলে উঠতে পারেননি। এবং, তৃতীয়ত, সেই ‘যুগসূর্য’কে ম্লান করে দেওয়ার যে উপায় এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, সেইটে কী? না, আপন চক্ষের আলো জ্বালতে পারলেই যুগসূর্য ম্লান হয়ে যাবেন! ‘চক্ষের আলো’-র তাৎপর্য যাই হোক না কেন, সূর্যের আলো যে তাতে ম্লান হওয়ার নয়, এই স্বীকারোক্তিও কি আসলে এই কবিতায় জেগে থাকে না?
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। কবিতার নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার স্বার্থে নয়, খানিক ব্যক্তিগত নানা টানাপোড়েনে কি কেউ রবীন্দ্র-বিরোধিতায় নামেননি সেকালে? নিশ্চয়ই নেমেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আনন্দ বিদায়’ নাটকের কোনও কোনও অংশ যে পৌঁছে যায় একেবারে ব্যক্তিগত কুৎসায়, এটা অস্বীকার করার জো নেই। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির নিন্দেমন্দও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তর্কপ্রিয়তার থেকে দূরে বিদ্বেষপ্রিয়তাকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠত। কিংবা ধরা যাক, ‘সাহিত্য’ পত্রিকার পাতার ১৩২৩ বঙ্গাব্দে সুহাসচন্দ্র রায় নামে এক সমালোচক লিখেছিলেন, ‘রবি পরম গুরু। তিনি হেলিলে হেলিবে, দুলিলে দুলিবে, বেঁকিলে বেঁকিবে, কাৎ হইলে চিৎ হইয়া পড়িবে।’ একেও কোনও পাশ থেকে ‘সমালোচনা’ বলে চিনে নেওয়া মুশকিল, এ নিতান্তই কুৎসা।
কিন্তু মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্র-সমালোচনা মাত্রই কুৎসা নয়, বিদ্বেষ নয়। ‘রবীন্দ্র বিদূষণ ইতিবৃত্ত’ নাম দিয়ে যতই বই লিখুন না কেন একালের খ্যাতনামা গবেষক, সব কিছুকে ‘বিদূষণ’ আখ্যা দেওয়া যায় না কিছুতেই। যৌনতাকে দেখার প্রশ্নে, চারপাশের দারিদ্র, দৈন্যকে দেখার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের নানা দ্বিধা বা অসামর্থ্যের কথা বলা-মাত্রই কি তাকে ‘বিদূষণ’ বলা উচিত? রবীন্দ্রনাথ নিজেই যখন ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থের ১০ নং কবিতায় স্বীকার করেন মানুষের বিপুল জীবনের-প্রবাহের সর্বত্র প্রবেশ তিনি করতে পারেননি, জেলে-তাঁতি-চাষির জীবনকে দেখা হয়নি সত্য করে, ‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে/ ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে’, একেও তো তাহলে বলতে হয় এক রকমের আত্ম-বিদূষণ? তা কি বলতে রাজি হবেন কেউ? তা যদি না হন, তাহলে রাধাকমল মুখোপাধ্যায় যখন একসময় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘বাঙালী জাতিকে চিনিতে হইলে পর্ণ-কুটির বাসী অশিক্ষিত কৃষক, তাঁতী, জোলা, মজুর, কামার, কুমোর, তেলী ও নাপিতের অভাব ও অভিযোগ, আশা ও আকাঙ্ক্ষা জানিতে হইবে।’, একেই-বা অন্ধ-বিদূষণ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? সেকালের মার্কসবাদীদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের শ্রেণি-পরিচয় নিয়ে যখন দু’-একটা মন্তব্য করেন, তাকে উদ্ধৃত-পুনরুদ্ধৃত করে ব্যবহার করা হতে থাকে রবীন্দ্র-নিন্দার উদাহরণ হিসেবে। কিন্তু হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য আত্মজীবনী ‘তরী হতে তীর’-এর ওই আশ্চর্য উৎসর্গপত্রটি নিয়ে প্রায় কখনও কথা বলতে শোনা যায় না? কী ছিল সেই উৎসর্গপত্রে? ছিল একট ছোট্ট শ্লোক: ‘ত্বদীয়ং বস্তু গোবিন্দ/তুভ্যমেব সমর্পয়ে’। তোমার জিনিস, তোমাকেই দিলাম। অর্থাৎ, এই-যে আত্মজীবনী, এ ‘তোমার’ই। কিন্তু কে এই ‘তুমি’? কে আবার! ওই শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করার আগে বড় হরফে লিখে দেন হীরেন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ নিত্যস্মরণীয়েষু’।
কথাটা হল রবীন্দ্রনাথই-বা কেমন করে দেখছিলেন এইসব বিরোধিতার পর্বকে? এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এইসব ঝড়ঝাপটার মধ্যে দাঁড়িয়ে আধুনিক সাহিত্যকে খুব স্থৈর্য নিয়ে দেখতে পারছিলেন না তিনি। সাহিত্যে যৌন অনুষঙ্গের আমদানিকে তাঁর মনে হচ্ছিল মানুষের কৌতূহলপ্রবণ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির ষড়যন্ত্র! কঠোর ধিক্কারে লিখেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের অপ্রতিহত প্রভাবে অলজ্জ কৌতূহলবৃত্তি দুঃশাসনমূর্তি ধরে সাহিত্যলক্ষ্মীর বস্ত্রহরণের অধিকার দাবি করছে…’। অন্যদিকে সাহিত্যে বাস্তবধর্মিতা নিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ছড়িয়ে থাকে ‘সাহিত্যের স্বরূপ’-এর মতো প্রবন্ধে, ‘‘দিনক্ষণ এমন হয়েছে যে, ভাঙা ছন্দে মদের দোকানে মাতালের আড্ডার অবতারণা করলেই আধুনিকের মার্কা মিলিয়ে যাচনদার বলবে, ‘হাঁ, কবি বটে’, বলবে ‘একেই তো বলে রিয়ালিজ্ম্’।” ফলে একদিকে রবীন্দনাথকে ‘অস্বীকৃতি’র একটা অনিবার্য বন্দোবস্ত, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের নিজের অ-স্থৈর্য– দুইয়ে মিলে সেকালে সাহিত্য-আবহাওয়া হয়ে উঠেছিল খানিক সরগরম। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, এ যেন কেবলই মলিনতা আর বিদ্বেষের বাষ্পেই পরিপূর্ণ। আজ শুধু এইটা মনে রাখা চাই, দূর থেকে দেখা ওই বাষ্পটুকুই পূর্ণসত্য ছিল না কোনও দিনই। বুদ্ধদেব বসুর সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি সকলেরই মনে পড়বে যে, সারারাত রবীন্দ্রনাথ পড়ে সকালে উঠে তিনি রবীন্দ্র-বিরোধী প্রবন্ধ লিখতে বসতেন। ফলে এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন বুদ্ধদেবের শান্তিনিকেতন-ভ্রমণকথার শিরোনাম হয়ে ওঠে ‘সব পেয়েছির দেশে’, কেন সেখানে তিনি লিখতে থাকেন এমন বিহ্বল করা বাক্য, ‘তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে যখন বেরিয়ে আসতুম, রোজই নতুন করে মনে হতো যে সমস্ত জীবন ধন্য হয়ে গেলো।’
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরবর্তী ‘আধুনিক’দের সম্পর্ক এইরকমই। তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু তিনিই শ্রেষ্ঠ, এই স্বীকৃতিতেও কখনও কোনও আন্তরিক কার্পণ্য ছিল বলে তো মনে হয় না।
… রবিচ্ছায়া-য় আরও পড়ুন …
পবিত্র সরকার-এর লেখা: ছায়াসুনিবিড়
রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনায় মানুষ ব্রাত্য ছিল না
শ্রুতি গোস্বামী-র লেখা: ছায়ার নারীস্বরূপ কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ?
সম্বিত বসু-র লেখা: রবীন্দ্রনাথ এখানে হস্তাক্ষর শেখাতে আসেননি