Robbar

ইরফানের মতো খুব কম মানুষ দেখেছি যাঁকে বলা যায়– ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 6, 2024 9:10 pm
  • Updated:January 7, 2024 7:54 am  

‘ইয়ে শালি জিন্দেগি’ যখন লেখা আরম্ভ করেছি, ইরফান গল্পটা শুনে বলেছিলেন, “যদি আমাকে ‘অরুণ’-এর চরিত্রটা করতে দাও, তাহলেই করব।” সত্যি বলতে কী, ‘অরুণ’ ওঁর কথা ভেবেই লিখেছিলাম। তারপর ছবিটা নিয়ে ওঁর সঙ্গে ডিসকাস করতে-করতে যেভাবে শেপ নিল, তাতে ইরফানের অনেক ইনপুট ছিল। প্রেম আর বুলেটের কোনও তফাত নেই, দুটোই এফোড়-ওফোড় করে– ছবির জন‌্য এটা আমার লেখা হলেও, এটুকু বলতে পারি আমার আর ইরফানের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খানিক একরকম ছিল।

সুধীর মিশ্র

গোটা পৃথিবী ইরফানকে ‘লেজেন্ড’ হিসেবে দেখে, কিন্তু ইরফান আমার বন্ধু। ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’য় যখন পড়তেন, তখন এতটাও হৃদ‌্যতা ছিল না। বরং পরে যখন মুম্বই এলেন, তখন ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সাধারণভাবে কোনও মানুষের সঙ্গে আলাপ হলে, সেটা আলাদা করে মনে থাকে না। আপনাদের কাছে তিনি লেজেন্ড হতে পারেন, কিন্তু তিনি আমার কাছে সমমনস্ক একজন শিল্পী। তাই যখন কেউ জানতে চায়, পুরনো দিনের কথা, আমি তাদের বলি– আমার তো সেদিন ইলেকট্রিক শক লাগেনি যে, সেটা আলাদা করে মনে রেখে দেব। যত সময় এগিয়েছে, ওঁকে যত বুঝেছি, ওঁর কাজ দেখেছি– তত মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে। ‘হাসিল’-এ ইরফানের অভিনয় দেখার পর থেকে মনে হয়েছিল ওঁর সঙ্গে কাজ করতে হবে। ইরফানকে নিয়ে এত লেখালিখি, এত কথা, একটা উঁচু আসনে বসিয়ে দিয়ে মিডিয়া তাঁকে একজন বোরিং পার্সন করে তুলেছে। বাট ইরফান ওয়াজ নট এ বোরিং পার্সন। হি ওয়াজ ভেরি ক্যাজুয়াল, নর্মাল, মিসচিভিয়াস গাই।

Check Out Irrfan Khan's House Photos with Architectural Digest

ইরফান এক্সপ্লোর করতে ভালোবাসতেন। অজানাকে জানার এক তীব্র খিদে ছিল ইরফানের মধ্যে। আমি জীবনে খুব কম মানুষ দেখেছি, যাঁকে বলা যায়– ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙছেন, গড়ছেন। নিজের সম্পর্কে ক্রিটিকাল ছিলেন এবং সেটাকে নিয়ে মজা করতে পারতেন। আমার দেখা অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেতা তিনি। খুব সহজে ‘না’ বলতে পারতেন, আবার ‘হ্যাঁ’ বলার সুযোগ খুঁজতেন। কারণ, ইরফানের জনপ্রিয় হওয়ারও একটি খিদে ছিল। ‘গ্রেট অ্যাক্টর’-এর তালিকায় নিজেকে নিয়ে যেতে চাইতেন। অদ্ভুত মানুষ ছিলেন ইরফান। শুধুমাত্র বন্ধু বলে, আমার সব ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ বলার পাত্র ছিলেন না। বন্ধু বলে, সব বিষয়ে একমত হবেন, এমনটা ওঁর স্বভাবে ছিল না। আর বন্ধু বলেই, আমার ছবিতে কাজ করবেন, এমনও নয়। অনেক পরিচালক বন্ধুর ছবিতে কাজ করেননি ইরফান। আমি তাঁদের নাম করতে চাই না। আমারও একটা ছবি করেননি। সেই গল্পটা থেকেই যায়। আমার সঙ্গে ইরফানের ভাবনাগত দিক থেকে মিল ছিল, কিন্তু সেই নির্দিষ্ট চরিত্রটা ওঁর পছন্দ হয়নি।

যখন কেউ ভালো বন্ধু এবং সহকর্মী হয়ে ওঠেন, তখন তাঁর সঙ্গে পরিহাস করা, আড্ডা দেওয়া, ভাবনার আদান-প্রদান করা যায়, ভিন্ন মত পোষণ করা যায় এবং সবকিছুর পরও একসঙ্গে জোট বেঁধে থাকা যায়। আমাদের সম্পর্কটাও তেমনই ছিল। ইরফান যাঁদের সঙ্গে মিশতেন, এইভাবেই মিশতেন। ইরফান সেই দুর্লভ অভিনেতাদের দলে পড়ে, যিনি মনে করেন– গোটা দৃশ্যটা উতরে গেলে, সে উতরে যাবে, ছবিটা উতরে গেলে, সেও উতরে যাবে। তাই কেবল নিজের অংশটুকু নয়, গোটা ছবি নিয়ে ভাবতেন।

Throwback: This picture of Irrfan Khan from the Cannes Film Festival 2013 wins hearts

আমরা পরস্পরের কাজের গুণমুগ্ধ ছিলাম। আমার পরিচালনায় ‘ধারাভি’, ‘হাজারো খোয়াইশে অ‌্যায়সি’ ওঁর প্রিয় ছিল। আমার বেশিরভাগ ছবিই ওঁর ভালো লেগেছিল। সেসব নানা কথায় নানা সময়ে উঠে এসেছে। ইরফানের ‘হাসিল’, ‘পান সিং তোমর’, ‘লাঞ্চবক্স’, ‘নেমসেক’, ‘মকবুল’, ‘হায়দর’ আমার খুব প্রিয়। ‘হায়দর’-এ ইরফান দুর্দান্ত। ‘রুহদার’ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন। ওঁর শেষ কাজ ‘আমাজন প্রাইম’-এর সিরিজ ‘গরমিন্ট’, যেটা মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হল অসুস্থতার জন্য। আমি সেই প্রোজেক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

‘আংরেজি মিডিয়াম’ যখন করেছেন, সেই সময়েও ইরফানকে কাছ থেকে দেখেছি। অসুস্থতার শুরুর দিনগুলোতে, হি ওয়াজ অ‌্যাট দ‌্য টপ অফ হিজ গেম। হি ওয়াজ ব্রিলিয়ান্ট। বহুদিন ধরে কমেডি করতে চেয়েছিলেন, তাই জান-প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন বলা যায়। মাঝে মাঝে মনে হত, যদি এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত, তাহলে বোধহয় অন‌্যরকম হত।

‘ইয়ে শালি জিন্দেগি’ সিনেমার একটি দৃশ্যে ইরফান খানের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা সিং

‘ইয়ে শালি জিন্দেগি’ যখন লেখা আরম্ভ করেছি, ইরফান গল্পটা শুনে বলেছিলেন, “যদি আমাকে ‘অরুণ’-এর চরিত্রটা করতে দাও, তাহলেই করব।” সত্যি বলতে কী, ‘অরুণ’ ওঁর কথা ভেবেই লিখেছিলাম। তারপর ছবিটা নিয়ে ওঁর সঙ্গে ডিসকাস করতে-করতে যেভাবে শেপ নিল, তাতে ইরফানের অনেক ইনপুট ছিল। প্রেম আর বুলেটের কোনও তফাত নেই, দুটোই এফোঁড়-ওফোঁড় করে– ছবির জন‌্য এটা আমার লেখা হলেও, এটুকু বলতে পারি আমার আর ইরফানের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খানিক একরকম ছিল। যদিও আমরা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। ইরফান রাজস্থানের গ্রাম ‘টংক’ থেকে, এনএসডি হয়ে বোম্বে এসেছেন, আমি প্রফেসর ছিলাম– কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল ছিল।

আমি অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, শাবানা আজমি, দীপ্তি নাভাল, পঙ্কজ কাপুর, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। এখনকার মধ্যে করিনা কাপুর, চিত্রাঙ্গদা সিং, ভূমি পেডনেকর। ইরফান ওয়াজ ভেরি স্পেশাল। ‘ইয়ে শালি জিন্দেগি’-র শুটিং খুব মজা করে করেছিলাম। মাঝে মাঝে অবশ‌্য ইরফান রেগে যেতেন, কারণ ও আমার বন্ধুও। আমি যেহেতু সিনিয়র, খুবই রেসপেক্ট করতেন, ‘স‌্যর’ বলে সম্বোধন করতেন। বহত হি তমিজদার থা, লেকিন তমিজকে দায়রে মে রহকে কুছ ভি বোল সকতা থা। ডিসএগরি করতা থা, অপনে দায়রে মে রহকে। তবে যতই ঝগড়া হোক না কেন, পরদিন সকালে ঠিক হয়ে যেত। ইরফান কারও সঙ্গেই ঝগড়া পুষে রাখার মানুষ ছিলেন না। হি ওয়াজ এক্সাইটিং, ইন্টারেসটিং, হি ওয়াজ নেভার এ বোর। যদি একটা শব্দে ইরফান খানকে বর্ণনা করতে হয়, তাহলে এই ইংরেজি শব্দ ব‌্যবহার করব– Soaker. হি ওয়াজ আ সোকার, সোকার অফ লাইফ। জীবন ওকে যাই দিয়েছে, ইরফান সব কিছু শুষে নিতে পেরেছেন। রিহার্সালে বিশ্বাস করতেন না। স্ক্রিপ্ট বারবার পড়তেন। নানা ধরনের প্রশ্ন করতেন। অনেক কথা বলতেন। আর ফাইনালি কী করবেন, সেটা শুটিংয়ের সময়টার জন‌্য ছেড়ে রাখতেন। আর ছবিটা কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানত চাইতেন। ওঁর পেটেন্ট ডায়লগ ছিল: ‘কাহানি ক‌্যায়া হ‌্যাঁয়?’

ইরফানের রুহদার

অসুস্থতার সময় কয়েকবার দেখা করেছিলাম। কিন্তু পরের দিকে আর দেখা করতে চাইতেন না। ইরফানের একটা কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে, ‘সুধীরভাই কমাল কা বাত হ‌্যায়, অগর ক‌্যানসার নহি হুয়া হোতা তো মুঝে ইয়ে জিন্দেগি সমঝ মে নহি আতি, ইয়ে এক তজুরবা হ‌্যায়’। ইরফান এমন মানুষ ছিলেন, যিনি এই কঠিন অসুখের সময়টাও একটা অভিজ্ঞতা হিসেবে নিয়েছিলেন।

জল, জঙ্গল, প্রকৃতি ইরফানের প্রিয় ছিল। হি অলওয়েজ সার্চড ফর বিউটি। ‘ইয়ে শালি জিন্দেগি’-র সময় মানালিতে একটি শুটিং শিডিউল ক‌্যানসেল হয়ে যায়। ইরফান সময় নষ্ট করেননি। সোজা জিম করবেট ন‌্যাশনাল পার্কে ঘুরতে চলে গেলেন মিউজিক কম্পোজার অভিষেক রায়ের সঙ্গে। অভিষেক ইজ অলসো এ ওয়াইল্ডলাইফ গাই। ওঁরা দু’জন একসঙ্গে খুব ঘুরতেন। চাষবাস, জমি– এইসবও খুব কাছের ছিল ইরফানের। নিজের সংস্কৃতি, শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও চোখ-কান খোলা রেখে প্রয়োজনমতো সমালোচনা করতে পারতেন।

বহুদিন পর্যন্ত আমি এবং ইরফান ও তাঁর পরিবার ‘মাড আইল‌্যান্ড’-এর একই বিল্ডিং-এ থাকতাম। আমরা প্রতিবেশি ছিলাম বলা যায়। সকাল, বিকেল, রাত প্রায়ই দেখা হত। ২০০৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পড়শি ছিলাম। আসা যাওয়ার পথে আমাদের দেখা হলেই হঠাৎ আড্ডা শুরু হয়ে যেত। কখনও লিফটে, কখনও জিমে। ইরফানরা ওই বাড়ি ছেড়ে দেন। যদিও শুনেছি, ফ্ল‌্যাটটা ওঁদেরই আছে। আমিও ওই ঠিকানায় এখন আর থাকি না। খালি মনে হয়, যখন কেরিয়ারে সেরা কাজগুলো করতে শুরু করেছিলেন ইরফান, তখনই ক‌্যানসার ওঁকে কেড়ে নিল। ২০২০ থেকে পরের পাঁচ বছরে ইরফানের জন‌্য দারুণ সব কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। অসময়ে চলে গেলেন। দ‌্যাটস দ‌্য রিগ্রেট।

 

 অনুলিখন: বিদিশা চট্টোপাধ্যায়