বহু, বহু বছর পরে শেষে দু’-পাত্তর ওল্ড মঙ্ক সুমন ধরাল। পরিচয় করাল। আলাপ হল চকিত নয়, প্রকৃত প্রেমের সঙ্গে। যে প্রেম বেদনার। যে প্রেম বিদ্রোহের। যে প্রেম চুম্বনের। যে প্রেম যন্ত্রণার। যে প্রেম যৌনতার। নেকুপুষু নীলাঞ্জনারা সে দৃশ্যে ছিল না আর। সুযোগই পেত না। বেলা বোসের লাইনেও আর ফোন যেত না। ধীরে-ধীরে আপনার ডাকে ‘সাড়া দিলাম’, এই নশ্বর জীবনের মানে বুঝতে শিখলাম। বাংলা কথায়, নব্য বাংলা গান কাকে বলে চিনতে শিখলাম। কিন্তু মুশকিল হল, তদ্দিনে আপনি আর নিছক গানওয়ালা নন।
প্রচ্ছদের ছবি: শান্তনু দে
কবীর সাহেব, গুস্তাখি মাফ করবেন এ অধমের। গুস্তাখি মাফ করবেন এ হাতের। এ আঙুলের। এ অক্ষম চিন্তার। এ অভুক্ত ভাবনার। এ মৃত কলমের। যারা একসঙ্গে জোট বেঁধে এখন, এই মুহূর্তে, আপনাকে নিয়ে দু’ছত্তর লিখতে নেমেছে। যারা অপার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে!
কবীর সাহেব, গুস্তাখি মাফ করবেন বাঙালি জাতটারও। গত কয়েক দিন ধরে শুনছি, আপনার পঁচাত্তর আসছে। ঘণ্টা-কাঁসর বাজছে। আমাদের মতো কিছু কতিপয় গঙ্গাফড়িং তা নিয়ে উৎপটাং উল্লম্ফন করছি। ধিতাং-ধিতাং নাচছি। বলছি। লিখছি। একে জীবনের পঁচাত্তর আপনার। তায়, মঞ্চ থেকে আধুনিক গান গাইবেন নাকি আপনি শেষ বার। রকমারি টিকিট। তিনশো। পাঁচশো। হাজার। কিছু লোক কাটছে, অধিকাংশ জাবর কাটছে। খাচ্ছে। ঘুমোচ্ছে। সকালে প্রাতঃকৃত্য করছে। রাতে অক্ষম কামের বাসর সাজাচ্ছে। বিগত পঁচাত্তর বছরে পঁচাত্তর সেকেন্ডও যারা মনে করেনি আপনাকে। আসছে রবিবারও করবে না। সেই দুপুরে মাংস-ভাত। রাত্তিরে ঈষৎ বীর্যপাত।
না জিজ্ঞেস করেও জানি কবীর সাহেব, খারাপ আপনারও লাগে। কখনও বলেন। কখনও বলেন না। কখনও ফোঁস করে ওঠেন। কখনও ওঠেন না। দিন কয়েক আগে কোথায় একটা পড়লাম যে, আপনি নাকি পদ্মাপার চলে যেতে চান। অপমানে। জীবনের শেষ কয়েকটা বৈঠা পদ্মায় বাইতে চান। গঙ্গায় নয়। পড়ে মনে হয়েছিল, যাওয়াই উচিত। আমরা, গঙ্গাপারের বাঙালিরা কিছু দিতে পারিনি আপনাকে। শান্তি । মান। সম্মান। সোয়াস্তি। কিছুই না। অথচ কবীর সাহেব, যা দিয়ে গিয়েছেন আপনি এ জাতিকে, এ বাংলার যত ঋণ জমা রয়েছে আপনার কাছে, জন্ম-জন্মান্তরেও তাহা শোধ হইবে না।
নয়ের দশকে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি-রাজনীতি যখন মুমূর্ষ প্রায়, আপনার বহ্নিশিখা আবির্ভাব। অনিন্দ্যদার (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) লেখায় পড়েছি তা নাকি কাঁধে কাঠের গিটার নিয়ে। ডেনিমে। বিদ্রোহী অবয়বে। স্কুলে পড়তুম তখন। কলামন্দির কোন দিকে, গানওয়ালা বসে কোন সুরের হাট-বাজারে, জানতাম না। বয়ঃসন্ধির পূর্বরাগ তখন। ‘লাল ফিতে সাদা মোজা’কে প্রেম বলি। বেলা বোসকেও বেশ বড় দেখায়। সে সময়ই কোনও পড়ন্ত বিকেলে, এক না চাওয়া ফুরসতে আপনার মেঘ-কণ্ঠে ‘তোমাকে চাই’ শ্রবণ। কলের গানে। এবং তার গভীরতার এক আঁজলাও বুঝতে না পেরে ‘বুঝতে পারিনি’-র ‘শিশুপালে’ নাম রেজিস্টার। বড় আহাম্মকের মতো একটা লম্বা সময় পর্যন্ত বন্ধুদের কাছে বড়াই করতাম, অঞ্জন আগে। সুমন পরে। আসলে বলতে পারতাম না, অঞ্জন বুঝি। সুমন বুঝি না। বলতে পারতাম না, অঞ্জন আমাদের গায়ক। আর সুমন অঞ্জনদের গায়ক। গায়কের গায়ক। গুরুঠাকুর কিংবা দাদাঠাকুর।
তা ছাড়া একটা সুবিধে ছিল মস্ত। একের জায়গায় তিন মুখ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন বাংলা গানের দেহে (আর গোটা সাতেক নাম পেলে নিশ্চিত ‘দশানন’ই করে ফেলত বাঙালি)! সব নাকি জীবনমুখী। আপনারা এক-এক জন তার উৎসমুখ। অঞ্জন, আপনি, নচিকেতা। বাঙালি তারিয়ে দেখত, শুম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধ। বাপ-জ্যাঠারা ফুট কাটত, তোদের সুমন কী গায় যেন? জীবনমুখী, অ্যাঁ জীবনমুখী? তা, আমাদের হেমন্ত-মান্না কী গাইত রে? মরণমুখী? অ্যা, হ্যা, হ্যা, হ্যা (সে কুৎসিত হাসি আজও শুনতে পাই)। আসলে শিল্প-পোড়া বাঙালির হিসেবপত্তর বড় সহজ ছিল। উঠতে হলে, কেসি নাগের অঙ্কের বানর ছানার মতো তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠো। আমরা মৌজসে দেখি। চালাও পানসি বেলঘরিয়া। একা-একা ক্ষীর খাবে ওটি হচ্ছে না!
বহু, বহু বছর পরে শেষে দু’-পাত্তর ওল্ড মঙ্ক সুমন ধরাল। পরিচয় করাল। আলাপ হল চকিত নয়, প্রকৃত প্রেমের সঙ্গে। যে প্রেম বেদনার। যে প্রেম বিদ্রোহের। যে প্রেম চুম্বনের। যে প্রেম যন্ত্রণার। যে প্রেম যৌনতার। নেকুপুষু নীলাঞ্জনারা সে দৃশ্যে ছিল না আর। সুযোগই পেত না। বেলা বোসের লাইনেও আর ফোন যেত না। ধীরে-ধীরে আপনার ডাকে ‘সাড়া দিলাম’, এই নশ্বর জীবনের মানে বুঝতে শিখলাম। বাংলা কথায়, নব্য বাংলা গান কাকে বলে চিনতে শিখলাম। কিন্তু মুশকিল হল, তদ্দিনে আপনি আর নিছক গানওয়ালা নন। আপনার নতুন পরিচয় হয়েছে। আমার জন্ম থেকে আপনি-আমি পড়শি না হলেও নিকটবর্তী। আপনি থাকেন বৈষ্ণবঘাটা। পুতুল পার্কের কাছে। আমি থাকতাম, গড়িয়া মিলন পার্কে। ভবিতব্য দেখুন, পরিবর্তনের সঙ্গী হয়ে আপনি আমার এলাকা থেকেই ভোটে দাঁড়ালেন। জিতলেন। বাড়ির পাশের অ্যান্ড্রুজ কলেজে ছুটলাম। আপনাকে দেখব বলে। গিয়ে দেখলাম, কলেজ গেটের বেঞ্চিতে আপনি। আশপাশে রাজনীতির পেটকাটি-চাঁদিয়ালরা উড়ছে, আর আপনি শ্রীযুক্ত কবীর সুমন বেঞ্চিতে শুয়ে, দু’হাতে চোখ ঢেকে, একরাশ অবজ্ঞা নিয়ে!
সে দিন বুঝেছিলাম কবীর সাহেব, কতটা ঔদাসীন্য থাকলে পরে সুমন হওয়া যায়। পরের বছর পনেরোয় আপনি বুড়ো হয়েছেন, আমি বড় হয়েছি, আপনার গান অমর হয়েছে। কিছু কিছু বুঝি এখন আপনার গান, তবে পুরোটা নয়। এটাও জানি, এক জীবনে হবে না। আবার ফিরে আসতে হবে। আপনারই লেখা জাতিস্মরের মতো। ফিরতে হবে সুমন বুঝব বলে। কেন কে জানে মনে হয়, বাঙালি জাতটাকেও তাই করতে হবে। অশিক্ষার ছাইভস্ম থেকে আবার পুনর্জন্ম নিতে হবে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আপনাকে নিয়ে গালমন্দই শুনে এসেছি কবীর সাহেব। জেনে এসেছি, আপনি মন্দ লোক। বহু সম্পর্ক আপনার, বহু বিবাহ, বহুগামী আপনি। নারীলিপ্সার সরেস গল্প শুনেছি কত। সত্যি-মিথ্যা যাচাইয়ের ইচ্ছেই হয়নি কখনও। বাঙালির দ্বিচারিতা বিবশ করে রেখেছিল যে! দিয়েগো মারাদোনার নারীসঙ্গ নিয়ে খোঁজ কবে নিয়েছে বাঙালি? ভিভ রিচার্ডসের অবৈধ প্রেম নিয়ে ঘৃণার থুতু কবে ফেলেছে? নাকি ঘুমোতে যায়নি ব্রায়ান চার্লস লারার ভোররাত পর্যন্ত পার্টি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায়? কেন, এঁরা কেউ বাঙালি নন বলে? আচ্ছা, বাঙালি তার সংস্কৃতি-পুরুষদেরও চরিত্র-চর্বণে কখনও বসেছে কি? দেখেছে কার ক’টা ছিল বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম? দেখেনি। কারণ, তাঁরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুরস্কার বাগিয়েছেন। কবীর সাহেব, যা আপনি পারেননি। পারলে কবে আপনাকে নিয়ে ধেই নৃত্য শুরু হয়ে যেত! পক্ষীবিষ্ঠায় সজ্জিত মর্মর মূর্তি বসে যেত!
তাই লিখলাম, গুস্তাখি মাফ করবেন আমাদের। না করলেও কিছু করার নেই। কুকুরের পেটে যেমন ঘি সহ্য হয় না, বাঙালির পেটে তেমন সুমন সহ্য হয় না। সহ্য হলে, সিনেমা হলে সে ‘আলফা মেল’ দেখতে ছুটত না। নিজের অভিধানে উত্তম, অধমের পাশে স্বচ্ছন্দে বসিয়ে নিত উগ্র পুরুষের সহজলভ্য অভিধাকে। হাতের কাছে যে আছে। যে গুণী। যে জিনিয়াস। যে ঐশ্বরিক। যে প্রেমিক। যে স্বয়ংসিদ্ধ। যে নারীর পুরুষ। যে পুরুষের পুরুষ। ব্যাভিচার যার একমাত্র পরিচয় নয়। ধর্মান্তর যার বুনিয়াদ নয়। তখন আপনার রাগী গানে, হয়তো হারানো মান খুঁজে পেত বাঙালি। ফিরে পেত প্রেম, ছুঁয়ে দেখত কামনা। কখনও কখনও মনে হয়, যে কথায় আপনি সুর দিয়েছেন, তা দিয়েই নতুন গীতবিতান সৃষ্টি করা যেতে পারত কবীর সাহেব। করা যেত। কিন্তু করা হয়নি। করা হবেও না। পঁচাত্তর কেন, আপনার একশো পঁচাত্তরেও না। নোবেলই যত্ন-আত্তি করে রাখতে পারিনি আমরা। সেখানে ‘দুর্মুখ’ কবীর সুমনের সৃষ্টি কোন ছাড়!
তবু জানি, শত দুর্নাম শেষেও ঠিক থেকে যাবেন আপনি, থাকবেন ঠিক। সিগারেট কাউন্টারে। মদের গেলাসে। অবাধ্য প্রেমিকার হাতে। ঝগড়া-আপোসে। দ্রোহী রমণের সুখে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বুটে। চলে যাওয়ার আগে যে দেশের নাগরিকত্ব নিন আপনি নাগরিক কবিয়াল, জানবেন আপনার এক স্বতন্ত্র দেশ আছে। প্রতিবাদের দেশ। বিদ্রোহের দেশ। বিপ্লবের দেশ। দ্বেষ বধের দেশ। যার কালা আদমি বাসিন্দাকুল অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গকে জ্বলন্ত কয়লাগুঁড়ো ছুড়ে মারে রোজ। এবং মারার আগে আপনারই গান গায়। হয়তো বিজাতীয় ভাষায়। হয়তো বিজাতীয় সুরে। কিন্তু গায়, ঠিক গায়। আর শেষে , সব শেষে জন্ম দেয় নতুন কবীর সুমনদের।
কবীর সুমনেরই স্পর্শে। কবীর সুমনেরই বীর্যে। কবীর সুমনেরই গর্ভে!