কোথাও, কোনও পরিচয়ের খাঁচাতেই কবিতা সিংহকে বন্দি করা চলে না। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘কবির উত্তরণ কেবল একই কবিতার নব নব লিখনেই হয় না, হয় নিজেকে অতিক্রমের মধ্যে দিয়ে।’ আজ যদি জীবিত থাকতেন কবিতা সিংহ, যদি সচল থাকত তাঁর কলম, আর. জি. করের নির্যাতিতা, ধর্ষিতা ও খুন হয়ে যাওয়া চিকিৎসকের প্রতি ভালোবাসা ও সমানুভূতিতে দ্রব হৃদয়ের টানে হয়তো প্রথমে একটি নারীবাদী কবিতাই তিনি লিখতেন, চরম যন্ত্রণাবোধের কবিতা, তারপর তাঁর মধ্যে নিশ্চয়ই জেগে উঠত ক্রোধ, গর্জে উঠত প্রতিবাদ।
বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাঁর আতপ্ত অক্ষরে লিখিত হয়েছে একের পর এক অগ্নিভ কবিতা। কবিতার সম্ভারে তাঁর রচনা চিরকালের সম্পদ। তাঁকে নিয়ে যেখানে যত আলোচনা, সবখানে তিনি ‘নারীবাদী’ পরিচিতি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই! বাস্তব মেয়েদের অভিজ্ঞতা, চিৎকার, সহন ও সহ্যাতীত এমনই ধারাবাহিক যন্ত্রণাময় করে রেখেছে, যে, নারী নিজের ভাষায় নিজের কথা বললে পুরুষতন্ত্রের কানে তা প্রথমে দুর্বোধ্য ঠেকে। ক্ষমতার অন্ধ পর্দা ছিঁড়ে যদি বা সেইসব নারীভাষের অর্থ কিছু মগজে পৌঁছয়, সেখানে পুরুষতান্ত্রিকের নিজের ভূমিকা নিজেকেই বিপন্ন করে তুলতে থাকে, এবং, দর্পণে স্বরূপদর্শন যদি কদর্য বোধ হয়, আত্মপ্রতারণার জন্য ব্যঙ্গাত্মক হা-হা হাসি ও বাঁকা উক্তি ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। তাই নারীর কথন মাত্রই নারীবাদ। পুরুষতন্ত্রের প্রভুত্বকামী দুর্গ থেকে নারীকে বাদ দেওয়াই তার উদ্দেশ্য।
বাদ দেওয়ার অনেক উপায় আছে। খাটো করা। অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া। বাতুলতা বলে নস্যাৎ করা, এমন আরও কত। কিন্তু এতকিছুর পরেও, নারীর পৃথক ইতিহাস লিখতে বাধ্য হয়েছে সভ্যতা। নারীকে নতুনতর দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য হয়েছে সমাজ। নারী স্বয়ং তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে করতে চলেছে। তাই, কাউকে ‘নারীবাদী’ বলে আলাদা খাঁচায় পুরে ফেলার ফন্দি বিশেষ কার্যকর হয় না। কবিতা সিংহের ক্ষেত্রেও হয়নি। কোনও নারীর পক্ষেই নারীবাদী আভূষণ লজ্জা বা ক্রোধের নয়, বরং গরিমার। কারণ নারীবাদ নারীর নিজস্ব প্রকাশের ভাষা, নিজস্ব অধিকার আদায়ের অস্ত্র। এর মধ্যে দাসত্বের ফাঁদ নেই, শোষণের পরিকল্পনা নেই, কাউকে তাচ্ছিল্য করা নেই। মানবেতিহাসের নৈতিক এবং নিরপেক্ষ অবস্থান ঠিক কীরকম হওয়ার কথা, নারীবাদ সেইসব চিহ্নিত করে। কবিতার বারুদ আগুনের মধ্য দিয়ে কবিতা সিংহ ঠিক তাই করেছেন। অমোঘ তাঁর উপলব্ধি।
কত অভিজ্ঞতার পর বেরিয়ে আসে এমন এক সরল কিন্তু অন্তর্ভেদী কাব্যপঙ্ক্তি!
কবি যে কেবল কল্পনার ডানায় উড়ে চলেন, তা তো নয়, কবির চেতনায় বাস্তবের তরঙ্গাঘাত নগ্ন নির্মম সত্যের দাবিতে আর্ত রব তুলতে থাকে। সেই বাস্তবতা সর্বদা আত্ম-সংঘর্ষ নয়। নয় নিজদেহ হতে রক্তপাত। দৃষ্টি দ্বারা, শ্রুতি দ্বারা স্পর্শের অনুভবশক্তি যার আছে, সে অপরের কান্নাকে কবিতার ভাষা দেয়। দেওয়া সম্ভব।
এইসব ক্রোধ, বিপন্নতা, অসম্মান ও যন্ত্রণার প্রকাশের জন্য নারীবাদী হতে পারা জরুরি, কিন্তু নারী হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সমান সহমর্মিতায় কোনও নারীবাদী পুরুষের পক্ষেও এমন কাব্যিক প্রকাশ সম্ভব। পৃথিবীতে যত অবিস্মরণীয় মহাকাব্য লিখিত হয়েছে, যতদূর জানা গিয়েছে, তাদের রচয়িতা পুরুষ, নারীর অবস্থান ও মানস বর্ণনার জন্য তাঁদেরও অনুভব সম্বল ছিল বলে ধরে নিতে হবে। আজকের ভাষায় নারীচরিত্রের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনের কারণে তাঁদের অন্তত আংশিক নারীবাদীও বলতে হবে, কারণ সৃজনশীলতার পরিসরে লিঙ্গচিহ্ন তুলে ধরা মানবসভ্যতার আধুনিক অসুখ। যে কোনও উপায়ে শ্রেণি গড়ে দিতে পারলে মানবসমাজ সম্ভবত নিরাপদ বোধ করে। যদিও সেই নিরাপত্তা বিলাসী ভাবনামাত্র, পদ্মপাতায় জল।
ইদানীং, যখন সমকামী সম্পর্ক, রূপান্তরকামী মানস সমাজে স্বীকৃত হয়ে উঠছে, সৃজনশীলতার মধ্যে তার পরিচিতি সেই লিঙ্গপরিচয় জড়িয়ে তৈরি হয়ে উঠছে। সকল ধরনের মানুষ অভিন্ন সমাজের অন্তর্ভুক্ত হবে, আধুনিক সভ্যতার এই ধর্মই কাম্য। কিন্তু একথা ভুলে গেলে কেমন করে চলবে, লিঙ্গভিত্তিক পরিচিতি এবং প্রতিভাবিচার প্রকৃতপক্ষেই আদিমতা, কারণ, যৌনতা ব্যক্তিগত, যৌনতা স্বাধীন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে নারীকে দাসত্ব করিয়েছে, নারীর পারঙ্গমতা অস্বীকার করে চলেছে, নারীকে যেমন ভুলতে দেওয়া হচ্ছে না, পুরুষের চোখে সে ভোগ্যবস্তু, পুরুষকে যেমন শিখিয়ে তোলা হচ্ছে না, যে, নারী স্বাধীন সত্তা, চাইলেই তাকে বলাৎকার করার বিন্দুমাত্র অধিকার তার নেই, নারী ভোগ্যবস্তু নয়, সেভাবেই অপরাপর লিঙ্গপরিচিতি ক্ষমতালোভী ও বর্বরের হাতে নিপীড়িত হবে। তাই সৃজনশীলতা ও শিল্পের পরিসরে লিঙ্গভিত্তিক সীমা ও শ্রেণি প্রগতির অনুকূল নয়।
কবিতা সিংহকে ‘নারীবাদী’ বলা হচ্ছে, একটি দিকে তা প্রযোজ্য, কিন্তু তিনি শুধুই নারীর অস্তিত্ব নিয়ে নিজের রচনা সীমায়িত করেননি। তাঁকে দেখতে হবে একজন বলিষ্ঠ কবি পরিচয়ে, একজন অসামান্য গল্পকার হিসেবেও। তাঁর কবিতাগুলিতে নারীত্ব কখন সর্বানুগ তন্ময়তায় প্রবেশ করে এবং লিখতে থাকে একজন মানবের তরে মানবের অনুভবের কথা, পাঠ করলে অশ্রুসজল আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় থাকে না। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে লিখিত কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি যেমন,
‘যাওয়া’ কবিতায় তিনি তুলে ধরেন এক অস্বস্তিকর প্রতিকৃতি প্রদর্শন। তার জন্যও বোধ করি তাঁকে নারীবাদী তকমার চাকচিক্য ঘষে বাড়াতে হয়নি। সেই পরোয়াই ছিল না তাঁর। থাকা উচিত নয় কারও। অনুভব, উপলব্ধি জগতের দশ দিগন্তে প্রসারিত করে দেওয়ার জন্য। কোথাও, কোনও পরিচয়ের খাঁচাতেই তাকে বন্দি করা চলে না। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘কবির উত্তরণ কেবল একই কবিতার নব নব লিখনেই হয় না, হয় নিজেকে অতিক্রমের মধ্যে দিয়ে।’ কেমন সেই অতিক্রম?
আজ যদি জীবিত থাকতেন কবিতা সিংহ, যদি সচল থাকত তাঁর কলম, আর. জি. করের নির্যাতিতা, ধর্ষিতা ও খুন হয়ে যাওয়া চিকিৎসকের প্রতি ভালোবাসা ও সমানুভূতিতে দ্রব হৃদয়ের টানে হয়তো প্রথমে একটি নারীবাদী কবিতাই তিনি লিখতেন, চরম যন্ত্রণাবোধের কবিতা, তারপর তাঁর মধ্যে নিশ্চয়ই জেগে উঠত ক্রোধ, গর্জে উঠত প্রতিবাদ, পুনরায়, অন্যতর ভাষায় তিনি বলে উঠতেন,
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।