১৮৬২ সালে মধুসূদনের সাহিত্যিক খ্যাতি এবং উজ্জ্বল ধীময়তার আলোয় সারা বাংলা তখন ভাসছে। বিদ্যাসাগরের তিনি চোখের মণি। এই সময়ে হঠাৎ মধু-কবি ঘোষণা করলেন, বাংলা সাহিত্য এবং ভাষা থেকে তিনি এবার বিদায় নিয়ে ব্যারিস্টার হবেন! স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে বারণ করলেন। মধুসূদন, বিদ্যাসাগরের এই অনুনয় শোনেননি। তাঁর দু’চোখে তখন বিলেতে ব্যারিস্টার হয়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নে তিনি বিভোর।
১৮৬২ সালের জুন মাস। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিলেত যাত্রা করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তাঁর আর নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই। তিনি সাহিত্য ছেড়ে ব্যারিস্টার হয়ে হাজার-হাজার টাকা উপার্জন করে যাপন করবেন বিলাসবহুল জীবন– যা তাঁকে কোনও দিন দিতে পারবে না বাংলা সাহিত্য।
সময়টা ১৮৬২। মধুসূদনের বয়স ৩৪। তিনি হেনরিয়েটার সঙ্গে কলকাতায় সংসার পেতেছেন। এবং দেনার দায়ে ডুবে আছেন। কিন্তু তিনি সাহিত্যিক এবং কবিখ্যাতিতে ইতিমধ্যেই দীপ্যমান। ইতিমধ্যে ‘রত্নাবলী’ নাটকের অসামান্য ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তিনি। এই অনুবাদের সূত্রে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চ।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লিখে ফেললেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। তুঙ্গে পৌঁছল নাট্যকার মধুসূদনের খ্যাতি। বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনের মতো ইংরেজি-জানা লেখক তখন ছিলই না। এখনই বা কোথায়? ৩৪ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই মধুসূদন লিখে ফেলেছেন, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’-র মতো কালজয়ী নাটক। লিখে ফেলেছেন, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড় সালিকের-ঘাড়ে রোঁ’-এর মতো অবিস্মরণীয় প্রহসন! এবং আরও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। বাংলা ভাষায় চার চারটি মহাকাব্যের জনক তিনি: ‘তিলোত্তমাসম্ভব’, ‘ব্রজাঙ্গনা’, ‘বীরাঙ্গনা’ এবং ‘মেঘনাদবধ’! ১৮৬২ সালে মধুসূদনের সাহিত্যিক খ্যাতি এবং উজ্জ্বল ধীময়তার আলোয় সারা বাংলা তখন ভাসছে। বিদ্যাসাগরের তিনি চোখের মণি।
এই সময়ে হঠাৎ মধু-কবি ঘোষণা করলেন, বাংলা সাহিত্য এবং ভাষা থেকে তিনি এবার বিদায় নিয়ে ব্যারিস্টার হবেন! স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে বারণ করলেন। ‘তোমাকে কি ভূতে পেয়েছে মধুসূদন? তুমি এখন খ্যাতির তুঙ্গে! যেমন তোমার মহাকাব্যের জন্য অবিশ্বাস্য মহিমা, তেমনি তোমার নাটকের জনপ্রিয়তা। তুমি বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে এসে আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছ। এই সময়ে তোমার অসামান্য সাফল্যের তুঙ্গ থেকে এই বয়সে কেন অনিশ্চয়তায় ঝাঁপ দিতে যাচ্ছ? এই ভুল করতে যেও না। বাংলা ভাষাকে তোমার এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। জীবনে অর্থ উপার্জনই তো সব নয়। তুমি কবি। কবিতাকে ছেড়ে যেও না।’ মধুসূদন, বিদ্যাসাগরের এই অনুনয় শোনেননি। তাঁর দু’চোখে তখন বিলেতে ব্যারিস্টার হয়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নে তিনি বিভোর। আর সেটাই সব থেকে বড় সর্বনাশ ডেকে নিয়ে এল কবির জীবনে।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের অর্থ সাহায্য তাঁকে ফরাসি দেশে কারাগার-বাসের গ্লানির হাত থেকে বাঁচাল। কিন্তু অর্থকষ্টের জন্য ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরতে তাঁর পাঁচ বছর লেগে গেল। ‘আশার ছলনে’ বিভ্রান্ত কবি অবশেষে ফিরলেন, দেশে ফিরে আসলেন কবি মধুসূদন ১৮৬৭ সালে।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
মধুসূদন বিলেতে গেলেন। এবং কলকাতার থেকেও অনেক বেশি অর্থকষ্টে পড়লেন। বিলেতে বসবাসকালে তিনি ক্রমাগত আরও ধারের মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন, ঋণে জর্জরিত হলেন মধু-কবি। সম্পূর্ণ এক ভ্রান্ত ধারণার বশে স্ত্রী হেনরিয়েটা এবং সন্তানদের নিয়ে ফ্রান্সে চলে গেলেন। তাঁর মনে হয়েছিল ফ্রান্সে কিছু কম খরচে থাকা যাবে! সেখানে এমন ধারে পড়লেন যে, তাঁর জেলে যাওয়া ছাড়া প্রায় উপায় রইল না। একান্ত নিরুপায় হয়ে শেষে তিনি বিদ্যাসাগরমশায়ের কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখলেন।
শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের অর্থ সাহায্য তাঁকে ফরাসি দেশে কারাগার-বাসের গ্লানির হাত থেকে বাঁচাল। কিন্তু অর্থকষ্টের জন্য ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরতে তাঁর পাঁচ বছর লেগে গেল। ‘আশার ছলনে’ বিভ্রান্ত কবি অবশেষে ফিরলেন, দেশে ফিরে আসলেন কবি মধুসূদন ১৮৬৭ সালে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: মেঘনাদবধ কাব্য আমার কাছে অভিনয়ের ক্লাস
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
তবে ইউরোপে তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার আগে রেখে গেল তার শেষ দান। তিনি বাংলা ভাষায় লিখলেন প্রথম সনেট, ইউরোপেই। ফিরে আসার পর তেমন উল্লেখযোগ্য আর কিছুই লিখতে পারেননি ভগ্নমনোরথ মধুসূদন। এবং ব্যারিস্টারিতেও তেমন সফল হতে পারলেন না। ঋণের ভারে, অর্থকষ্টে তাঁর শরীরও ভেঙে পড়ল। বিলেত থেকে ফেরার সাত বছরের মধ্যে ১৮৭৩-এ মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি তো মারা গেলেন।
কিন্তু তাঁর সৃষ্টি? অমরত্বের রাজসিংহাসনে চিরস্থায়ীভাবে তা বিরাজমান। নবজাগরণের ক্রান্তিলগ্নে মাইকেল মধুসূদনের স্বরূপসন্ধান কিংবা তাঁর প্রতিভার বিচার হয়তো বঙ্গসমাজ সঠিকভাবে করে উঠতে পারেনি যথাযথভাবে। কিন্তু সময়ের দর্পণে আজ সহজেই অনুমেয় বঙ্গমাতা রত্নগর্ভা। সেই রত্ন স্বয়ং মধুসূদন। বঙ্গদর্শন-এ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মধু-কবি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ভিন্ন ভিন্ন দেশে জাতীয় উন্নতির ভিন্ন ভিন্ন সোপান। বিদ্যালোচনার কারণেই প্রাচীন ভারত উন্নত হইয়াছিল, সেই পথে আবার চল, আবার উন্নত হইবে। কাল প্রসন্ন– ইউরোপ সহায়– সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও– তাহাতে নাম লেখ ‘শ্রীমধুসূদন’।”