তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ছায়া কীভাবে পড়ে দর্জিপাড়ায়? মতি নিজের চোখে দেখেছেন, মাটির একটা পাত্র পাশে রেখে ব্ল্যাক ওয়ার স্কোয়ারের সংলগ্ন বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকা এক মৃত নারীকে। স্তনবৃন্তের আকার দেখে তবে চেনা গিয়েছিল সে নারী। সারি সারি কঙ্কালের ওপর যেন চামড়ার মোড়ক।
২৫, তারক চ্যাটার্জি লেন।
যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ এবং গ্রে স্ট্রিটের ক্রসিং-এর কাছাকাছি জায়গা থেকে আস্ত গলিটা যেন এক সর্পিল বাঁক নিয়েছে, দেহাতি রোদ্দুরে। ১৯৭৭-এর মার্চের সকালে বসন্ত-বাতাস উত্তর কলকাতার এই এঁদো গলিতেও মৃদুমন্দ ঢুকে পড়ছিল। কত কত বছর আগের কথা। তবু সে’সবই মতি নন্দী অবিকল মনে রাখতে এখনও যেন বাধ্য করছেন।
তাঁর বসবাস তো হতেই হবে এই গলিতে। বাস থেকে নেমে গলিতে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকালেই এইসব দৃশ্যপট পর পর আসতে থাকে। যেন চলচ্চিত্রে শুরুর টাইটেল পড়ছে। সঙ্গে আবহসংগীত– কর্পোরেশনের কলের জল বগ বগ করে পড়েই যাচ্ছে, আঁজলা ভরে তা খায় একজন। খালি গায়ের ছেলের দল বড় রিং গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে চলেছে গলিতে। ঘণ্টাবাঁধা একটা বড় পাঁঠার পিঠে চড়ে হেলে-দুলে যায় এক রুগ্ন কিশোর, ওদিকেই। রাস্তার ধারে বসে চুল কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ। কাঁচির ওঠা-নামা। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘাড় ঘোরাতেই দেখা যায় দোতলার ঝোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা। ভিজে কাপড়ের বালতি তাঁর হাতে। ঝেড়ে নিয়ে একে একে রোদ্দুরে মেলে দেওয়ার শব্দ। সঙ্গে মুখের বকবকানি:
–হ্যাঁলা, তুই করেছিস কী ? ম্যা গো ! ছি ছি ছি!
মতি নন্দীর এরকম এক গলিতেই তো থাকার কথা। এদেরই তিনি দেখেছেন আর লিখে গিয়েছেন। উত্তর কলকাতা আর তার গলি। তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সে’সব দেখা। গলির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে।
তাঁদের পৈতৃক বাড়ির পুরনো অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ছাদের ঘরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। আর দেখা যায় আলো। রোদ ঝলমলে ছাদ। পরনে নীল-চেক লুঙ্গি, মেদহীন ডাম্বেল-ভাঁজা খালি গা তাঁর। ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে সেদিন হাত দিয়ে তিনি উত্তর কলকাতা দেখান আর বলেন:
–একশো লেখক একশো বছর ধরে লিখলেও উত্তর কলকাতার গলির গল্প লেখা শেষ হবে না।
মাঝে মাঝেই একবার করে চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে নিজেই জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন। ইয়া বড় পিতলের একটা বাটা থেকে পান সেজে নিয়ে ছাদে আসেন আর কথা বলেন:
–‘‘উত্তর কলকাতা জানতে হলে ছাদ দেখতে হবে। আমার প্রথম গল্পের নাম ‘ছাদ’! দেশ পত্রিকায় যখন বেরোয়, মণীন্দ্র কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ি। তারপর ‘পরিচয়’-এ পরপর দুটো গল্প ‘চোরা ঢেউ’ আর শারদীয় সংখ্যায় ‘বেহুলার ভেলা’ বেরোয়। তখন ‘পরিচয়’ ছিল বিখ্যাত পত্রিকা। সম্পাদনায় মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ‘বেহুলার ভেলা’ বেরোবার পর আর আমাকে পিছনে তাকাতে হয়নি। পাঠক গ্রহণ করলেন আমাকে অন্তর থেকে। এঁদো কানাগলির চরিত্ররা তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।” এরাই কখনও নায়ক, কখনও বা খলনায়ক। নিজেই লিখেছেন সেকথা:
‘অনুসন্ধান করে এগোতে এগোতে চরিত্ররা একসময় কানাগলির মুখে দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। ওইখানে আমাকেও থামতে হয়।’
মতি নন্দী কখনও তাঁর লেখায় এগিয়ে যাওয়ার পথ বাতলে দেননি। কোনও বাণী উচ্চারণ করে বলেননি– এই হোক, তাই হওয়া উচিত। যা তাঁর বলার কথা, চরিত্ররাই সেসব বলেছে। গ্রামের প্রান্তিক মানুষ নয় কেউ, শহুরে নিম্নবিত্ত চরিত্ররাই ওঁর লেখার বিষয়। সেই অর্থে মতি নন্দী এক নাগরিক লেখকও। শহরে বোমা পড়ার হিড়িকে পারিবারিক কারণে একবারই মাত্র কিছুদিনের জন্য হুগলির দশঘরা গ্রামে গিয়ে তিনি থাকেন। তাও এসেছে অল্প কিছু লেখায়। মতি জানিয়েছেন এইভাবে:
“আমার অধিকাংশ লেখার চরিত্র এসেছে এই গলিটা থেকেই। এতেই আমি সড়গড়। এই পরিবেশেই আমার প্রধান চরিত্রের বাস।”
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেন ‘মতি একটা আইসবার্গ’। সুনীলের পর্যবেক্ষণ, ‘মতির ছোটগল্পে যে বাস্তবতা থাকে, তা যেকোনও মানুষের মর্মমূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়।’ ‘মতি জ্যান্ত এবং কিকিঙ’ লিখেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তাঁর লেখায় ভাষার কসরত নেই, নেই ফর্মের ভাঙাগড়ার খেলা। ন্যারেটিভেই চরিত্রগুলো আলগোছে কথা শুরু করে। পৌঁছে যায় কিন্তু তুঙ্গে। বীভৎসতায়, দুঃখ-সুখ আর মমতায় মাখামাখি হয়ে। নির্মেদ গদ্য তাঁর অহংকার। যেন তাঁর শরীরটার মতোই।
গল্প লিখতে সময় নিতেন অনেকটাই। কিন্তু পাঠক টেরই পান না ঘষামাজার, কাটাকুটির। সারাদিনে হয়তো লিখতে পেরেছেন একটি মাত্র পূর্ণ পৃষ্ঠা। কিন্তু লেখা সাবলীল, পরিশ্রমের চিহ্ন আদৌ নেই। নিজের ভাষায় বলেন এভাবে:
–একটা গল্প লিখতে কখনও ছ’মাস লেগেছে। অযত্নের লেখা ছাপতে দিইনি। বঙ্কিমচন্দ্রকে মান্য করে লিখে ফেলে রেখেছি।
তাঁর যে কোনও একটা গল্প পড়লেই টের পাওয়া যায়– লেখার চেয়ে বেশি না-লেখাতে তাঁর গুরুত্ব যেন বেশি। ‘চূড়ান্ত সম্পাদিত’ যাকে বলে। ‘রাস্তা’, ‘‘ছ’টা পঁয়তাল্লিশের ট্রেন’, ‘শবাগার’, ‘একটি মহাদেশের জন্য’, ‘একটি পিকনিকের অপমৃত্যু’– এসব গল্প পড়লেই বোঝা যায় তাঁর গদ্যের মুনশিয়ানা। বড় আকারের লেখা হয়তো এজন্যই লিখতে পারেননি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেন ‘মতি একটা আইসবার্গ’। সুনীলের পর্যবেক্ষণ, ‘মতির ছোটগল্পে যে বাস্তবতা থাকে, তা যেকোনও মানুষের মর্মমূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়।’ ‘মতি জ্যান্ত এবং কিকিঙ’ লিখেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ।
আর তাই হয়তো উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্প লেখাতে তাঁর ঝোঁক বেশি ছিল। দু’-তিনটি গল্প লেখার পরই ‘নক্ষত্রের রাত’ (সে-সময়ে নাম ‘ধুলো বালির মাটি’) উপন্যাস লিখেই ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেলেন। তাঁর পাঠক পেয়েছেন আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু ভাবনায় বৃহৎ– দ্বাদশ ব্যক্তি, বারান্দা, বাওবাব, করুণাবশত, বনানীদের বাড়ি, সাদা খাম, ছায়া সরণিতে রোহিণী কিংবা একেবারে শেষে ‘বিজলিবালার মুক্তি’-র মতো উপন্যাস। তবে সেই অর্থে বিশাল প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে উপন্যাস কখনওই তিনি লেখেননি। নিজে তা অস্বীকার না করে বরং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:
–উপন্যাস কি আমি লিখেছি? মনে তো হয় না। সব তো বড় গল্প। ঢোঁড়াই চরিত মানস, পুতুল নাচের ইতিকথা, পথের পাঁচালী, হাসুলী বাঁকের উপকথা, গড় শ্রীখণ্ড এইসব হল বাংলা সাহিত্যের স্তম্ভ উপন্যাস।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ভালো চুটকি লেখা হলেও তা কালজয়ী হতে পারে, বিশ্বাস করতেন শিবরাম
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
খেলা কেন লেখায় আসবে না? বাংলা সাহিত্য ভ্যাদভেদে হওয়ার একটি কারণ তো অবশ্যই লেখকদের ক্রীড়া-বিমুখতা। তিনি স্ট্রাইকার, স্টপার লিখলেন। তাঁর ‘কোনি’ পড়ে পাঠক কাঁদলেন। লিখলেন ‘শিবা’, ‘তুলসী’, ‘জীবন অনন্ত’। সততা আর কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প যে কিছু হয় না, এটা শৈশব থেকেই কিশোর মনে গেঁথে দিতে চাইলেন। আর সেখানেও চরিত্রগুলো এল ওই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে, গলির ঘরগুলো থেকে। একের পর এক ব্যর্থতায় তাদের প্রাণপণ যুদ্ধ, লড়াই, টিকে থাকা। অবশেষে কঠোর পরিশ্রমের পর সফলতার একটু মুখ দেখতে পাওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনি। মেয়েদের ক্রিকেটে ‘কলাবতী’ এসেছে নানা রঙের কাহিনিতে। সাঁতার, সাইকেল, বক্সিং, ফুটবল, ক্রিকেট, কুস্তি কোনটা লেখেননি? নিজে খেলোয়াড় ছিলেন বলেই মাঠ আর মাঠের বাইরের আলো অন্ধকার– দুটোরই প্রতিফলন তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁর নখের আয়নায়।
মতি নন্দীর স্মৃতির গলিতে উত্তর কলকাতার কত যে দগদগে নাম! কত রঞ্জন-রশ্মি! এদিকে হরি ঘোষ স্ট্রিট তো, ওদিকে দুর্গাচরণ মিত্র। সেদিকে দর্জিপাড়া তো অন্যদিকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বা কাশী বোস লেন। ভারতীয় ফুটবলের প্রথম পদ্মশ্রী গোষ্ঠ পাল আর সাঁতারের আরতি সাহা দু’জনেই তারক চ্যাটার্জি লেনের। মতি লিখছেন– ‘ভারতে এমন একটা গলি দ্বিতীয় আর আছে কি?’ আবার ওই একই গলির বাসিন্দা দুই সংগীতজ্ঞ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিমান মুখোপাধ্যায়।
তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ছায়া কীভাবে পড়ে দর্জিপাড়ায়? মতি নিজের চোখে দেখেছেন, মাটির একটা পাত্র পাশে রেখে ব্ল্যাক ওয়ার স্কোয়ারের সংলগ্ন বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকা এক মৃত নারীকে স্তনবৃন্তের আকার দেখে তবে চেনা গিয়েছিল সে নারী। সারি সারি কঙ্কালের ওপর যেন চামড়ার মোড়ক।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: বাঙালি পাঠক সাবালকত্ব হারাবে যদি তার সন্দীপন অপঠিত থাকে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মতি অবাক হয়ে যান একদিন শুনে যে, ৪৬ মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে জন্মেছেন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন সেই শৌখিন ও সুদর্শন কবি, যিনি লিখেছেন– ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল!’ কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, চোখে নীল কাচের চশমা পরা ফুলবাবুটি হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত হেদোয় যেতেন আর চিত হয়ে জলে ভেসে থাকতেন। মতি আরও অবাক হয়ে যান যখন শোনেন, ১০১ বাড়িটি আর এক কালজয়ী কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর। যে বাড়িতে কে না এসেছেন– বঙ্কিম, মাইকেল থেকে মা সারদা।
মতি নন্দীর স্মৃতির গলিতে কত গল্প। মতির ফুটবলের নায়ক শৈলেন মান্না আর ক্রিকেটের পঙ্কজ রায়। একবার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের একটা খেলার ব্যালান্স রিপোর্ট করতে গিয়ে হেডলাইন করেন ‘মোহনবাগান জিতেছে, ইস্টবেঙ্গল খেলেছে’! এরকম কত যে গল্প হলেও সত্যি, লিখে শেষ হবে না! আপাতদৃষ্টিতে ম্যাড়মেড়ে, কিন্তু জীবনগুলো গলিকে করে তোলে বৈচিত্রময়। রঙিন। বহুদূর ব্যাপ্ত তার উজ্জ্বলতা। গলিত সুখ।
উত্তর কলকাতার গলি মতির লেখায় শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে এক একটি মহাদেশ। লেখকের একটা অহংকার থাকা উচিত, তিনি বিশ্বাস করতেন। আর বলতেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হল সে, যে নকআউট হতে হতেও, রিং-এ পড়ে যাওয়ার আগে, শরীরের সব এনার্জি জড়ো করে, উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা ঘুষি মারতে পারে।’
গলির সম্রাট মতি নন্দীকে সেলাম!