তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। রফিকাকু গুনগুন করে গান করছিল যখন– ‘এ মেরি জোহার জবি তুঝে মালুম নেহি, তু আভি তাক হে হসি আউর মে জওয়া, তুঝপে কুরবান মেরি জান মেরি জান’, আমি স্কুল থেকে ফিরে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ওঁদের বারান্দার দেওয়াল সারাইয়ের কাজ দেখছিলাম। আমায় ডেকে একটা মৌরি লজেন্সের ছোট্ট প্লাস্টিকের ছোট কৌটো এগিয়ে দিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কাকু তোমার বাড়ি কই?’
আজ সকালে একা একা শীত করছে। ম্যাজমেজে ভাব, কেমন যেন জ্বর জ্বর। টিউব থেকে বেড়িয়েছি। রাস্তার ওপারে রোদ, এপারে বাসস্ট্যান্ড। অনেক বাস। লাল লাল বাস। আসে। যায়। আসে।
তোমার উদার কপাল ভরা চুল সরিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হল। না রে বাবা, তুমি না, জানি!
একজন বিক্সটনবাসী ক্যারিবিয়ান মহিলা! আমায় বলল, ‘জিশাস, লাভস ইউ’।
বিরক্ত হলাম। হাসিও পেল। এই না হলে বিক্সটন! এই জন্যই গুচ্ছ রাগের পরও তো লন্ডনকে এত অসহ্য রকম ভালোবাসি!
একটু রিওয়াইন্ড করছি।
দেশ। তার মধ্যে দেশ। তার মধ্যে টিউব স্টেশন। তার মধ্যে দেশি বিদেশি সাদা-কালো-বাদামি মানুষের ঘামের গন্ধ আর পচা খাবারের কালি-ঝুলি মাখা সংমিশ্রণ, নীল নীল সিট, মাঝে মাঝে হলদে-সবুজ চুলওয়ালা একটি গাল ভাঙা ভিখারির ফিরে ফিরে এসে একই আবদার আর গল্প, স্টেশনের দরজা খোলা মাত্রই নানা পারফিউমের বাহারে নাক জ্বলে যাওয়ার জোগাড়, আর সবচেয়ে মজার হল, প্রতিটা স্টেশনে এক একটা দেশ দেখা। টিউবের ভেতর থেকে বাইরেটা এক একটা দেশ । যেমন হোওয়াইট চ্যাপেলে বাংলাদেশ, সাউথ হলে পাঞ্জাব, উলিচে নেপাল, আর বিক্সটনে সেনেগাল আর জামাইকা।
…………………………………………
হাতল ধরে ওপরে উঠে এসে দেখলাম নানা দেশের অনেকে মিলে দেশে দেশে ছয়লাপ করে ফেলেছে। বাসস্ট্যান্ডে আতরের গন্ধে ম ম করছে। একজন ড্রাগনব্লাড গাছের ধূপ জ্বালিয়েছে, একজন মিশরের আতর শোকাচ্ছে সবাইকে, যদি একজন অন্তত কেনে। পাশের সস্তার প্যাটিস স্টল থেকে ভয়ানক জোরে ভেসে আসছে পিটার টসের গান– ‘স্টপ দ্যাট ট্রেন আই এম লিভিং’।
………………………………………….
টিউব থেকে বেড়িয়েই দেখা গেল একজন সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কারাওকে চালিয়ে গসপেল গাইছে। তারপর এসকেলেটর। হাতল ধরে ওপরে উঠে এসে দেখলাম নানা দেশের অনেকে মিলে দেশে দেশে ছয়লাপ করে ফেলেছে। বাসস্ট্যান্ডে আতরের গন্ধে ম ম করছে। একজন ড্রাগনব্লাড গাছের ধূপ জ্বালিয়েছে, একজন মিশরের আতর শোকাচ্ছে সবাইকে, যদি একজন অন্তত কেনে। পাশের সস্তার প্যাটিস স্টল থেকে ভয়ানক জোরে ভেসে আসছে পিটার টসের গান– ‘স্টপ দ্যাট ট্রেন আই এম লিভিং’।
‘Some going east; and-a some going west
Some stand aside to try their best
Some living big, but the most is living small
They just can’t even find no food at all
I mean, stop it
Stop that train: I’m leaving – leaving, mm-hmm
Stop that train: I’m leaving – I don’t mind!
Stop that train: I’m leaving. And I said
It won’t be too long whether I’m right or wrong
I said it won’t be too long whether I’m right or wrong.’
এখন বাসে উঠেছি।
পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম দু’জন রাস্তা তৈরির কর্মচারী হাতে ড্রিল-মেশিন নিয়ে ভয়ানক তর্ক জুড়েছে। সম্ভবত সিরিয়ান। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে হেসে ফেলছে। কার মতো যেন দেখতে। খুব চেনা আদল । আরে এ তো অবিকল রফিকাকুর মতো দেখতে! আমাদের ঠাকুরপুকুরের বাড়ির রাজমিস্ত্রি রফি কাকু।
এই তো সেদিনকার কথা মনে হয়। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। রফিকাকু গুনগুন করে গান করছিল যখন– ‘এ মেরি জোহার জবি তুঝে মালুম নেহি, তু আভি তাক হে হসি আউর মে জওয়া, তুঝপে কুরবান মেরি জান মেরি জান’, আমি স্কুল থেকে ফিরে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ওঁদের বারান্দার দেওয়াল সারাইয়ের কাজ দেখছিলাম। আমায় ডেকে একটা মৌরি লজেন্সের ছোট্ট প্লাস্টিকের ছোট কৌটো এগিয়ে দিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কাকু তোমার বাড়ি কই?’ রফিকাকু বলেছিল, ‘বিহার চেনো বাবু? আমার দেশের বাড়ি তো বিহারে ভাগলপুরে।’
‘দেশের বাড়ি কি?’
‘যেখানে আমার দেশ বাবু !’
‘তোমার দেশ ইন্ডিয়া না?’
‘কেন ভূতের বোঝা বহিস পিছে
ভূতের বেগার খেটে মরিস মিছে,
দেখ ঐ সুধাসিন্ধু উচ্ছলিছে
পূর্ণ ইন্দু পরকাশে,
ভূতের বোঝা ফেলে
ঘরের ছেলে আয় চলে আয় আমার পাশে,
মহা সিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।।’
এখন হঠাৎ বুঝতে পারলাম, রফিকাকু দেশের বাড়ি বলতে গিয়ে তোমার কথাই বলেছিল।
………………………………………….
নানা দেশের অনেকে মিলে দেশে দেশে ছয়লাপ করে ফেলেছে। বাসস্ট্যান্ডে আতরের গন্ধে ম ম করছে। একজন ড্রাগনব্লাড গাছের ধূপ জ্বালিয়েছে, একজন মিশরের আতর শোকাচ্ছে সবাইকে, যদি একজন অন্তত কেনে। পাশের সস্তার প্যাটিস স্টল থেকে ভয়ানক জোরে ভেসে আসছে পিটার টসের গান– ‘স্টপ দ্যাট ট্রেন আই এম লিভিং’।
………………………………………….
বাসে একটি কিশোরীর হাতে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, টিকিট না কেটে উঠে পড়েছে। সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছে। ও কেন স্প্যানিশ বলছে? আচ্ছা, তবে নিশ্চয়ই লাতিন। নাকি পর্তুগিজ বলল? আড় চোখে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। অমন সুন্দর আদল, আদুরে চোখের দিকে তাকাব না? আমার স্ত্রী বাবলির কথা মাথায় আসতে মনে মনে বললাম, ‘বাজে বকিস না বাবলি! তুইও তাকাতিস।’ ইশ কী ভাবল? যাক, আমার টুপিটা তো জামাইকান। বাঙালি ভাবেনি নিশ্চয়ই।
তুমি থাকলে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করতে– ‘আচ্ছা রুশো! মুসলমান, হলেই ফিলিস্তিনের কথা বলবে? কি করে জানলে, ওই মেয়েটি ভালো গসপেল গায় না?’
তোমায় শুধু বলি, তুমি আছ, তাই সব আছে। তাই তো রান্নাঘরটা আছে, তাই তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকি তাই তো অলস হবার ঝুঁকি, সব নিয়েই বেঁচে আছি। তোমার গোমড়া মুখের দিকে চাইলে বুঝতে পারি, অন্তত তুমি সত্যি বলছ, অন্তত তুমি মিথ্যে বলো না অকারণে, অন্তত কেউ তো সত্যি বলছে!
‘देख कि आहन-गर की दुकाँ में
तुंद हैं शोले सुर्ख़ है आहन
खुलने लगे क़ुफ़्लों के दहाने
फैला हर इक ज़ंजीर का दामन
बोल ये थोड़ा वक़्त बहुत है
जिस्म ओ ज़बाँ की मौत से पहले
बोल कि सच ज़िंदा है अब तक
बोल जो कुछ कहना है कह ले’
তুমি দুঃখ পাবে, একথা জেনে তোমায় বলিনি। আসলে জানো তো, গোল গোল চাকতির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে বাদামি, সাদা, কৃষ্ণকায় বা হলদে চামড়ার প্রাণী, অনেকগুলো জীব একসঙ্গে একে অপরকে দেখেছে মাপছে চিনতে চাইছে না চিহ্ন খুঁজছে কার চাকতি কোন রঙের।
ওই যে লাল তারা মার্কা ঝান্ডা হাতে যে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তা আটকে! ওটা তো এআইকেএসের ঝান্ডার মতো দেখতে। এখানকার কোনও একটি ট্রেড ইউনিয়নের ঝান্ডা। ভদ্রলোক বেটে খাটো। ভালো ব্রিটিশ স্টাইলের কলার তোলা অফিস যাওয়া মানুষের পোশাক। ব্লন্ড চুল। চোখে গোল চশমা। হাতে একটা রোল করা পোস্টার যাতে সামান্য একটা অংশ পড়া যাচ্ছে। ‘…o to Zionism’ এটুকুই পড়তে পারছি।
ও মা, উনি মুসলমান? ওই তো পরিষ্কার আরবি উচ্চারণে বললেন, ‘Assalamualaikum Warahmatullahi Wabarakatuh’। তবে ওনার হাতে ওই ঝান্ডা কেন? মাথায় টুপিও নেই। কোন চাকতির মানুষ তবে ও? কোন ইউনিয়নের? মানুষের ইউনিয়ন কেন? এখন আমার স্ত্রী থাকলে জিজ্ঞেস করতাম জার্মান ভাষায় ইউনিয়ন কি রে বাবলি? সব দেশে ইউনিয়ন লাগে কেন বল তো?
দেশ কি মানুষের? নাকি মানুষ দেশের? দেশ তো মাটিও বটে। মাটি কার সম্পত্তি? নাকি মাটিরই সম্পদ মানুষ? তাই যদি হয় তবে ইউনিয়ন করতে হয় কেন?
Raggedy, raggedy are we
Just as raggedy as raggedy can be
We don’t get nothin’ for our labor
So raggedy, raggedy are we
Hungry, hungry are we
Just as hungry as hungry can be
We don’t get nothin’ for our labor
So hungry, hungry are we
Homeless, homeless are we
Just as homeless as homeless can be
We don’t get nothin’ for our labor
So homeless, homeless are we
Landless, landless are we
Just as landless as landless can be
We don’t get nothin’ for our labor
So landless, landless are we
So hogless, hogless are we
Hogless, hogless are we
We don’t get nothin’ for our labor
So hogless, hogless are we
Union, union are we
Just as union as union can be
We don’t get nothin’ for our labor
So union, union are we
Union, union are we
Just as union as union can be
We’re gonna get somethin’ from our labor
So union, union are we.’
……………………………………………………
আরও পড়ুন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা: বেয়নেটের ঠোঁট সযত্নে বেঁকিয়ে দেয় শান্তির শ্বেত পায়রারা
……………………………………………………
বাস থেকে নেমেছি। লন্ডনের হাওয়াতেও বাণিজ্যর গন্ধ আজ।
শিগগির এসো বন্ধু আমার। এ শহর বড় বেশি রঙিন।
আমি আর এতো গুলো রঙিন চাকতির উপযুক্ত
ঠিক থাক মাপমতো চশমা খুঁজতে পারছি না।
তুমি এলে এবার একটা রাঙা লাল শাড়ি
কিনে দেব
দেবই।
আজও তোমায় চিনতে অসুবিধা হয় না অপর্ণা।
বৈরাগ্যের ভান করি, যাতে তুমি এড়িয়ে যাও
তুমি আলি চাচার দোকানের বয়াম থেকে
বিস্কুট চুরি করে পালানোর দিনে থেকে চিনি তোমায়
আমি চিনি তোমায় অপর্ণা।
কখনো নব্বইয়ের দশকে ছাতা পড়া রান্না ঘরে
মায়ের মতো করে জড়িয়ে ধরি
যখন তুমি নীল শাড়ি পড়ে রান্না ঘরে
ভাতের ফ্যান গ্যালো বেসিনে আর
কপালের ঘাম মোছো, আমি মনে মনে
এক মনে ডাকি ঠাকুরকে
এই যে আমার মা! ঠাকুর এমনটা যেন হয়
আমার মা যেন কোনওদিন আমায় ছেড়ে
চলে না যায়।
আজ আমার ভোঁতা বৈরাগ্যের নাটক প্রায় শেষ
আজ বুঝি তুমিই জননী, তুমিই দেশ অপর্ণা।
তাই কালো পোশাকে ঘুরে বেড়াই
আমি সন্তান চাই না মা
না অপর্ণা, চাই না নতুন জীবন
চাই না অমন জন্মদাগ পাওয়ার আনন্দ
সন্তান গর্ভে ধরার সুখ বড় নির্দয়
ভুলিয়ে দেয় পূর্বের সন্তানহারাদের শোক
তোমায় শুধু মা বললে ভুল করব অপর্ণা
দুগ্গার অপর্ণা হয়ে ওঠার রূপকথা শুনেছি
তোমার ভাইকে ওরা গুলি করার সময়
একবারও ভাবেনি তোমার তপুদা পাগল
হাসছিল তরতাজা হাসিমুখ ছেলেটা
তুমি ছোটভাইয়ের মুখ টিপে লুকিয়ে ছিলে
পানের বরজে, ঠান্ডা গায়ে, নির্ভয়ে
মৃত্যু বড় কাছে ছিল অপর্ণা
তাই তো অত মার খেয়েও ইজ্জত বাঁচিয়ে
এদেশে পালিয়ে এসেছিলে পাথরের মতো।
শক্ত বড়ই শক্ত।
দুর্গা থেকে অপর্ণা। শক্ত গো মা।
আমার একটা প্রশ্নের উত্তরে তুমি বলেছিলে
মানুষের হাত বড় মোলায়ম রে
আমায় নৌকোয় করে পার করিয়ে দেয় সে হাত
জাত নেই রং নেই
কখনও সে মাঝি, কখনও দোকানদার
এই তো সেদিন ওর নাম সুলেমান
আবার কোনওদিন মেরি, কোনওদিন গৌর
স্থবির সাজার ভান করেছিলাম
মনে মনে তোমার উদারতার প্রতি
হিংসায় দুঃখে রাগে ছটফট করেছিলাম।
সেদিন বুঝেছি তোমাকেই সন্তানের মতো
ভালোবেসে ফেলেছি।
মা! না দুগ্গা! না অপর্ণা।
অবয়ব মাত্র। নাম মাত্র। বিমূর্ত
কখনও ফুটফুটে ছোট্ট জননী মেয়ের মতো
কখনও গুলিস্তানের নূর
কখনও নীল শাড়ি পড়া আমার মা
বলছে, ‘বাবাই, সোয়াবিনের তরকারি আছে আজ,
আর কিছু নেই,
একটা ডিম ভেজে দেবো?’
তোমার নাম খুঁজেছি অপর্ণা। পাইনি।
আর চাই না। নাম বড়ো মিথ্যুক,
বার বার নামগুলোর কাছে হেরে যায় মানুষ।
নাম দিয়ে কি হবে?
আমি গৃহত্যাগ করবো না।
বৈরাগ্যের অভিনয় করে যাবো।
বৈরাগ্য দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যায় যন্ত্রণা।
যদি ঘুমোতে পারতাম তোমার কোলে!
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….