নবনীতার এই ‘একা’ বেড়ানোর প্রধান বৈশিষ্ট্য দু’টি। তাঁর ভ্রমণে স্থানের থেকেও বেশি রয়েছে ‘মানুষ’ দেখার কথা, তাকে জানা, চেনার কথা– ‘ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়, তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।’ নতুন জায়গাতে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে ক্রমশ বেড়ে ওঠে নবনীতার এবং তাঁর পাঠকদেরও আত্মীয়তা। দ্বিতীয়ত, নবনীতার ভ্রমণ চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিকতার চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বাঁধুনির বিরুদ্ধে এক স্বকীয় নারীবাদী মুক্তির কথা বলে।
একা বেড়ানোর কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে কলেজে পড়াকালীন আসানসোল থেকে বাসে বিষ্ণুপুর যাত্রার কথা। প্রবল ভিড়ের সেই বাসে সঙ্গী ছিল পথচলতি দেহাতি মানুষজন, এমনকী বেশ বেয়াড়া একটা ছাগলও। সত্যি বলতে কী, নিজেকে খানিক ‘নবনীতা’ ‘নবনীতা’-ই ঠেকছিল। তখনও পড়া হয়নি, মায়ের মুখেই শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’।
সেই বই পড়ার বহুবছর পরে তাওয়াং গেছি, অবশ্য একা নয়, সপরিবারে। রাস্তাও এখন অনেক সুগম। আবার গতবছর পৌষ সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে গিয়ে মনে পড়ছিল নবনীতার কুম্ভস্নানের কথা। যদিও নাস্তিক হওয়ার জন্য এবং ঠান্ডার ভয়ে (কোনটার জোর বেশি জানি না, বোধহয় দ্বিতীয়টার) সাগরে গিয়েও পুন্যস্নান করিনি। তবে পুরোপুরি নাস্তিক তাই বা বলি কী করে, যখন নবনীতার মতোই পথে পথে আপনজন তথা ঈশ্বরের ভালোবাসা কুড়িয়ে পাই আমি। পথে বেরলে মানুষ যে আর একা থাকে না, তা একবার সারা রাত বাউল-ফকির মেলায় কাটিয়ে বেশ অনুভব করেছিলাম। তাই নবনীতার লেখা পড়তে গিয়ে নতুন করে মুগ্ধতায় পেয়ে বসল।
সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হায়দরাবাদ যাচ্ছিলেন নবনীতা। যাওয়ার দিন সকালে নিতান্ত ছাপোষা এক ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রবল ব্যস্ততা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘যাচ্ছেন কোথায়? কুম্ভে বুঝি?’ সেটাই যেন ডাক হয়ে এল নবনীতার মনে। বাত-হাঁপানি-ব্লাড প্রেসার যাবতীয় অবয়সোচিত রোগ আর যুবতীর একাকী যাত্রী হওয়ার অসুবিধার ভাবনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কুম্ভে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন মনে মনে। ব্যাগ গোছালেন হায়দরাবাদের জন্য, মন পড়ে রইল কুম্ভে। হায়দরাবাদে পৌঁছে অন্ধ্রের তৎকালীন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পি. ভি. নরসিংহ রাওয়ের কল্যাণে যাওয়ার বন্দোবস্ত, কলেরার টীকা নেওয়া– সবই সম্ভব হয়ে গেল। তবে তিনি যে ‘একাই’ যাবেন, সবাইকে সেটা বিশ্বাস করানোটাই শক্ত হচ্ছিল সব থেকে।
হায়দরাবাদ তিরুপতি হয়ে কলকাতা ফেরার পরিকল্পনা একেবারে বাতিল না করে তাতে জুড়ে দিলেন তিরুপতি থেকে আবার হায়দরাবাদ ফিরে এসে সেখান থেকে দিল্লি হয়ে বেনারস– ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ যে আসে, কে আর সে কথা বলতে পারে আগে থেকে। তাঁর ভাষায়, ‘পথে কুম্ভ নাইবা পড়ল, পথ কেটে নিলেই পথ, পথ খুঁজে নিলেই পথ।’
এরপর একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। পথে ছেঁড়া কেডস মাফলার আর খোঁচাখোঁচা দাড়িওলা বৃদ্ধ শার্দূল সিং কথা বলেন চোস্ত ইংরেজিতে আর বেনারস থেকে কুম্ভগামী ট্যাক্সিভাড়ার বেশিরভাগটা দিয়ে দেন, অচিরেই হয়ে ওঠেন নবনীতার এক ‘বাবা’। প্রবল ভিড়ের মধ্যেই জুটে যায় মালবাহী দুই বিশ্বস্ত বালক ‘লালা’ আর ‘গোঙা’। কুম্ভে পৌঁছে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য চিঠি সঙ্গে থাকলেও সেই চেষ্টা না করে শুয়েছিলেন আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমের বাইরের ধুলোয়, তিনটি বাঙালি ছেলে সেখান থেকে নিজেদের তাঁবুতে নিয়ে যায় নবনীতাকে। তারপর তাঁবুতে আশ্রয়, ঘুরে বেড়ানো, রাত দুটোতে পুণ্যলগ্নে স্নান, সবেতেই তাঁর সঙ্গী জুটে যায়। একা হয়েও তিনি কখনও ‘একা’ থাকেন না। এটাই বোধহয় পথের মজা।
……………………………………………..
অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার মি. দেউড়ির সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেতেই তাওয়াং গুম্ফা দেখে আসার জন্য জিপের ব্যবস্থা করে ফেললেন নবনীতা। গুম্ফা দেখে ফিরে এসে পরিচয় হল এক মহিলা লামা ইয়েশি আনি-র সঙ্গে। পরেরদিন সকালে নেমতন্ন তাঁর বাসাতে। আর রাতের নিমন্ত্রণ সাম্প্রুং গ্রামে আরেক লামা পেমা খাণ্ডুর বাড়িতে। নতুন জায়গাতে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে এভাবেই ক্রমশ বেড়ে ওঠে নবনীতার এবং তাঁর পাঠকদেরও আত্মীয়তা।
……………………………………………..
সেই মজাই তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল জোড়হাটে আসাম মহিলা সাহিত্য সভা থেকে শুধু তুমুল বর্ষার কাজিরাঙার জঙ্গলেই নয়, একেবারেই অচেনা এক তরুণ ডাক্তার সমভিব্যবহারে মালবাহী ট্রাকে চড়ে মিলিটারির দেশ অরুণাচলের তাওয়াং-এ। সেও আর এক ‘উঠল বাই তো কটক যাই’-এর কাহিনি। ‘একা’ মেয়ের পথ চলার যাবতীয় ওজর-আপত্তি বাধা কাটিয়ে, যারা মানা করছিলেন তাদেরই কাছ থেকে সোয়েটার, টুপি, ওভারকোট, দস্তানা সব ধার করে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভারত-চিন সীমান্তরেখা ম্যাকমোহন লাইন-এর পথে।
রাজপুত ড্রাইভার, নেপালি ক্লিনার, মূলে পাকিস্তানি বর্তমানে গুজরাটের বাসিন্দা সেই তরুণ চিকিৎসক এবং চতুর্থ জন এক বাঙালি সহযাত্রী যাঁর নাম মিস্টার সেন– পঞ্চম যাত্রী নবনীতা অর্থাৎ ‘মিসেস সেন’ চললেন ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’-র উদ্দেশে। একা রওনা দিলেও পথে নামার পর কখনওই ‘একা’ থাকেন না নবনীতা। পথই জুগিয়ে দেয় চলার সঙ্গী। ভালুকপং-এর চেকপোস্টে ‘মাদ্রাজ হোটেল’-এ ডিনার সারেন ডাক্তারের সঙ্গে। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জামিরিতে গাড়ি থামলে চৌকিদারকে দিয়ে ইনস্পেকশন বাংলোর বসার ঘর খুলিয়ে স্থানীয় এক চটি থেকে চৌকি জোগাড় করে বিছানা পাতিয়ে হুলুস্থূল কাণ্ড করে রাতের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে ফেলেন নবনীতা। একই ঘরে থাকতে বিস্তর লজ্জা পেলেও নাছোড় নবনীতার সঙ্গে পেরে ওঠেন না ডাক্তার।
বমডিলাতে এসে ট্রাক বদল। নেপালি ড্রাইভার ঘনশ্যাম ছেত্রীর সঙ্গে গল্পে গল্পে কাটে পথ। ডাক্তার লালওয়ানির কর্মস্থল তাওয়াং। সেখানে পৌঁছে ডাক্তারের বিশেষ ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যাচেলর কোয়ার্টারেই উঠলেন নবনীতা। ভাব জমে উঠল ডাক্তারের পরিচারক বাহাদুরের সঙ্গেও। পরেরদিন সকালে চেনাজানা হল আরও চারজন ডাক্তারের সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন এক বাঙালি তরুণীও– সদ্য পাশ করা মেডিকেল অফিসার ডা. স্বপ্না চৌধুরি। অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার মি. দেউড়ির সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেতেই তাওয়াং গুম্ফা দেখে আসার জন্য জিপের ব্যবস্থা করে ফেললেন নবনীতা। গুম্ফা দেখে ফিরে এসে পরিচয় হল এক মহিলা লামা ইয়েশি আনি-র সঙ্গে। পরেরদিন সকালে নেমতন্ন তাঁর বাসাতে। আর রাতের নিমন্ত্রণ সাম্প্রুং গ্রামে আরেক লামা পেমা খাণ্ডুর বাড়িতে। নতুন জায়গাতে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে এভাবেই ক্রমশ বেড়ে ওঠে নবনীতার এবং তাঁর পাঠকদেরও আত্মীয়তা।
নবনীতার এই ‘একা’ বেড়ানোর প্রধান বৈশিষ্ট্য দু’টি। তাঁর ভ্রমণে স্থানের থেকেও বেশি রয়েছে ‘মানুষ’ দেখার কথা, তাকে জানা, চেনার কথা– ‘ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়, তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।’ দ্বিতীয়ত, নবনীতার ভ্রমণ চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিকতার চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বাঁধুনির বিরুদ্ধে এক স্বকীয় নারীবাদী মুক্তির কথা বলে। কথোপকথনের ছলে তিনি জানান,
মেয়েমানুষের অত খামখেয়াল ভালো নয়।
মেয়েমানুষের অত জেদ ভালো নয়।
মেয়েমানুষের অত সাহস ভালো নয়।
তাঁর ছকভাঙা ভ্রমণে ‘মেয়েমানুষের’ জন্য ‘ভালো নয়’-এর গণ্ডিগুলো ভেঙে দিয়ে গেছেন নবনীতা।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………