’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় কারারুদ্ধ। রাজবন্দিদের একবেলার আহার বর্জন করে, তা বুভুক্ষু মানুষদের বিতরণ করার প্রস্তাব দিলেন। অনেকেই সাড়া দিল না। কিন্তু তিনি একাই নিয়মিত একবেলার আহার বর্জন করলেন। এমন মানুষ হলেন বহুজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু– নৃবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক, গান্ধী-সচিব। অন্তরঙ্গজনের কাছে তিনি ‘নির্মলদা’।
১৯৭০-’৭১ সালের কলকাতা। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের বাণী– ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’। অস্ত্র হাতে গলিতে গলিতে ছুটছে তরুণরা। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। কর্কট রোগে আক্রান্ত এক প্রবীণ সে-সময়েও পাজাম-পাঞ্জাবি পরে কলকাতার রাস্তায় ঘুরছেন। সেই প্রবীণের সমবয়সি অনেকেই ভেবেছেন, এইসব যুবক বিভ্রান্ত ও অসামাজিক। কিন্তু তিনি জানতে চাইতেন, কোন আবেগের উন্মাদনায় তরুণরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এভাবে ছুটছে। বিশ্লেষণ করতেন এই বিপর্যয়ের নেপথ্যে কী কী কারণ থাকতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজকে বদলাতে হবে সমাজকে রক্ষার জন্য, দেশকে, জাতিকে রক্ষার জন্য।
বিরল কেশ, দীর্ঘদেহী, শক্তগড়ন– এই ভদ্রলোকই বাগবাজার থেকে বালিগঞ্জ চলেছেন বিশ্বস্ত নিত্যসঙ্গী বি এ সি সাইকেলে চড়ে। পরনে ধুতি বা পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা। তাতে বই, কাগজপত্র। অনেকে তাঁকে যেতে দেখে দূর থেকে প্রণাম করত। তিনি না থেমে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম নিয়ে নিজের কাজে চলে যেতেন। কখনও কখনও সাইকেল থাকত না। হাঁটতেন। ধর্মতলায় কোনও ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলে কে.সি. দাশের দোকানে মিষ্টি কিনে খাওয়াতেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিটে ‘খাদি মণ্ডল’-এ। সেখান থেকে চলে যেতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর দপ্তরে। সেখানে সমস্ত দর্শনপ্রার্থীকে নিয়ে খবরের কাগজ বিছিয়ে মুড়ি ও বাদামভাজা খেতেন। হেঁটে ফিরে যেতেন বাগবাজার।
আবার তিনিই, ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় কারারুদ্ধ। রাজবন্দিদের একবেলার আহার বর্জন করে, তা বুভুক্ষু মানুষদের বিতরণ করার প্রস্তাব দিলেন। অনেকেই সাড়া দিল না। কিন্তু তিনি একাই নিয়মিত একবেলার আহার বর্জন করলেন। এমন মানুষ হলেন বহুজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু– নৃবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক, গান্ধী-সচিব। অন্তরঙ্গজনের কাছে তিনি ‘নির্মলদা’।
২২ জানুয়ারি, ১৯০১। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে গোপীমোহন দত্ত লেনে নির্মলকুমার বসুর জন্ম। বাবা বিমানবিহারী বসু পেশায় ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের চিকিৎসা বিভাগের সিভিল সার্জেন। বদলির চাকরি। বাংলা, বিহার, ওড়িশার জল-হাওয়ায় জড়িয়ে রয়েছে নির্মলকুমার বসুর শৈশব। ১৯১৭-তে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ এবং অর্জন করেন জেলা স্কলারশিপ। ভর্তি হন কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে। ১৯১৯-এ আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূতত্ত্বে অনার্স নিয়ে বিএসসি-তে ভর্তি হন। পেলেন ফার্স্ট ক্লাস। ১৯২২ সালে ভর্তি হলেন এমএসসি-তে। সে-সময় গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের শুরু। তরুণ নির্মলকুমার নিজেকে শামিল করলেন সেই আন্দোলনে। ওই সময়ে সি এফ অ্যান্ড্রুজের নেতৃত্বে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ আর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের পুনরুদ্ধার শিবিরের ব্যবস্থা করার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করলেন নির্মলকুমার। ঋদ্ধ হল তাঁর মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
চোখের সামনে হিন্দু-মুসলমানের এরকম ভ্রাতৃঘাতী হনন নির্মলকুমারকে বিচলিত করেছিল। জীবনের বিপুল ঝুঁকি নিয়ে নির্মলকুমার বিপন্ন, ভীত, সন্ত্রস্ত হিন্দু ও মুসলমানদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন। সেই বছরই ১৭ অক্টোবর নোয়াখালিতে দাঙ্গা শুরু। ৬ নভেম্বর গান্ধীজি দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে ছুটে যান। নির্মলকুমার তখন নোয়াখালি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের শিবিরে শিবিরে ঘুরে দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নানা মর্মান্তিক কাহিনি লিপিবদ্ধ করছিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ স্তিমিত হতেই নির্মলকুমার মন্দির স্থাপত্য নিয়ে চর্চা শুরু করলেন পুরীতে। তিনি গভীর অভিনিবেশে লক্ষ করেছিলেন যে, এদেশের মানুষদের মন্দির দর্শনের যত আগ্রহ, মন্দির সম্বন্ধে জানার উৎসাহ অনেক কম। নির্মলকুমার দর্শনার্থীদের পুরীর মন্দিরে বসিয়েই মন্দিরের ইতিহাস ও স্থাপত্য সম্বন্ধে সহজ কথায় তথ্য পরিবেশন করতেন, সেই বর্ণনায় তাঁরা অভিভূত হতেন। সেই রকমই একদিন পুরীর মন্দিরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তরুণ বাঙালি ছেলেটির সাবলীল বক্তৃতায় তিনি মুগ্ধ হলেন।
স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সস্নেহ পরামর্শে, নির্মলকুমার স্নাতকোত্তর স্তরে নৃতত্ত্ব বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন। সাল ১৯২৩। ১৯২৫-এ এমএসসি পাশ করলেন। শুধু উত্তীর্ণ নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বছর এমএ, এমএসসি-র সমস্ত পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন নির্মলকুমার। তাঁর এমএসসি-র গবেষণার বিষয় ছিল ‘ভারতের বসন্ত উৎসব’। আদিবাসী জাতির মধ্যে হোলি উৎসবের প্রকৃতি এবং অঞ্চলভেদে তার বৈসাদৃশ্য আলোচনা করলেন ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক প্রবন্ধ ‘A Short Account of Holi Festival’-এ। প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে।
সাংস্কৃতিক-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে নির্মলকুমারের উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। তিনি ওড়িশার পার্বত্য অঞ্চলে জুয়াং উপজাতিদের মধ্যে ক্ষেত্র-গবেষণার কাজ করেন। জুয়াংদের সম্পর্কে প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানার জন্য তিনি অরণ্যবাসী জুয়াংপল্লিতে কিছুদিন বসবাস করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটা জাতিকে জানার অন্যতম মাধ্যম ভাষা, ভাষা না জানলে তাদের সঙ্গে মানসিক বন্ধন ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে না কিছুতেই। জুয়াংদের ভাষা শীঘ্র আয়ত্ত হোক, এমন প্রার্থনা করে পুজো-অর্চনার আয়োজন করেছিলেন সেই গ্রামের মুখিয়া। এ ঘটনা ইতিহাসে বিরল। নির্মলকুমার তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, আয়ত্ত করেছিলেন তাঁদের ভাষাসংস্কৃতি ও যাপনপ্রণালী। নির্মলকুমার হয়ে ওঠেন তাঁদেরই একজন। ফলে তাঁদের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতাকে এত অনুপুঙ্খভাবে তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলেন।
১৯৩০ সাল। ২৯ বছর বয়সি নির্মলকুমার যোগ দিলেন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। বোলপুরের কাছে এক হরিজন বস্তিতে গড়ে তোলেন খাদি সংঘ। আশপাশের নিম্নবর্গের মানুষদের শিক্ষার জন্য নৈশ বিদ্যালয়ও স্থাপন করলেন। সাল ১৯৩১। লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেওয়ার জন্য জেলে যেতে হল তাঁকে। তৃতীয় শ্রেণির বন্দি। প্রথমে সিউড়ি জেল, তারপর দমদম সেন্ট্রাল জেল। ১৯৩২-এ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও কর্মপন্থা বিষয়ে পড়ার ও লেখার সুযোগ পান। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘Selections from Gandhi’। সেই বছরই নভেম্বর মাসে বোম্বাই থেকে ফেরার পথে নির্মলকুমার কৃষ্ণ কৃপালনীকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ধার সেবাশ্রমে গান্ধীজি ও আবদুল গফফর খানের সঙ্গে দেখা করেন। নির্মলকুমারের কাছে গান্ধিজী সত্যাগ্রহ, সমাজ পুনর্গঠন ও নানা বিষয়ে তাঁর উপলব্ধির সম্যক ব্যাখ্যা দেন।
১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে নির্মলকুমার নৃতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্ব পড়াতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্বকে জানতে হলে যেতে হবে মাটির কাছাকাছি, মাটি খনন করে সব দেখতে হবে, জানতে হবে। সুযোগ এল ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে খনন কাজ ও অনুসন্ধানের। ১৯৪৮ সালে অধ্যাপক ধরণী সেন-এর সঙ্গে প্রকাশ করলেন ‘Excavations in Mayurbhanj’– যে বইটির পাণ্ডুলিপি তিনি সম্পূর্ণ করেছিলেন কারাবাসের সময়ে। তাঁর ছাত্ররা পরবর্তীকালে লিখেছেন, ‘নির্মলকুমার বসু আমাদের শিখিয়েছিলেন সব কিছু হাতে-কলমে। কীভাবে প্রত্নসামগ্রী চিনতে হয়, জানতে হয়, যাচাই করতে হয়, যত্নে সংগ্রহ করতে হয়, সংরক্ষণ করতে হয়। ছাত্র আর শিক্ষকের একসঙ্গে কাজে মেতে ওঠার ফলে শিক্ষার কাজ হত অনেক প্রাণবন্ত ও কার্যকর।’
নির্মলকুমার বসু মধ্য ওড়িশার জুয়াং এবং ছোটনাগপুরের মুণ্ডা ও ওরাওঁদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে, বৃহত্তর হিন্দু পরিবেশে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রবণতাগুলির বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেছেন। ১৯৪১ সালের ৩ জানুয়ারি। বারাণসীতে অনুষ্ঠিত হল ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন। সেই অধিবেশনে নৃতত্ত্ব শাখায় তিনি পড়লেন– ‘The Hindu Method of Tribal Absorption’। তাঁর বক্তৃতার নির্যাস হল, বৃহত্তর শক্তিশালী বর্ণজাতিভিত্তিক হিন্দু সমাজের ধারা ধীরে ধীরে অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে, তাদের নিজস্ব আচার-আচরণকে সম্পূর্ণ ভেঙে না দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিতে হিন্দুসমাজও সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল হয়েছে।
নির্মলকুমার বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। ’৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। দমদম সেন্ট্রাল জেলে আগস্ট ১৯৪২ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত থাকাকালীন, তিনি সহবন্দি মানুষদের থেকে অবিভক্ত গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা, কৃষিজ পণ্য, হস্তশিল্প ইত্যাদির এক অনুপুঙ্খ বয়ান লিপিবদ্ধ করেন তাঁর ডায়েরির পাতায় পাতায়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা একদল গ্রাম্য মানুষ, কয়েদি, হয়তো তার মধ্যে যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তও আছে, যারা পরাধীন দেশের ব্রিটিশ জেলে কারাবাস করছে– তারা একজন দেশপ্রেমী নৃতাত্ত্বিকের সামনে বসে স্মৃতি খুঁড়ে আনছে তার গ্রামদেশের অজস্র আপাততুচ্ছ খুঁটিনাটি, নানা ব্যবহারিক বস্তু আর উপাদানের কথা। পরিব্রাজক নির্মলকুমার বসু অবিভক্ত বাংলা পরিব্রজন করেছেন সহবন্দিদের মাধ্যমে। ‘বিয়াল্লিশের বাংলা’ সেই তথ্যসংগ্রহের ফসল। তাঁর এই রচনা ঠিক অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ নয়, বরং খোলামেলা বর্ণনায় এখানে তিনি পাঠককে তাঁর যাত্রা ও চিন্তার সহযাত্রী করে নেন। এই বইতে অবিভক্ত গ্রামবাংলা যে অনুপুঙ্খতায় ফুটে উঠেছে, তার অনেক কিছুই কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে। যেসব জীবিকা, জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান নির্মলবাবু লিপিবদ্ধ করেছেন, তার কিছু কিছু এখন আর কোথাও-ই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে দেশকে, দেশের মাটি ও মানুষকে, তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হাট বা মেলার সম্বন্ধে পাঠকের অনুরাগ এবং অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পাবে, বাংলার এক সামগ্রিক চিত্র প্রস্তুত করবেন– এই ছিল নির্মলকুমারের ইচ্ছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৯৩০ সাল। ২৯ বছর বয়সি নির্মলকুমার যোগ দিলেন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। বোলপুরের কাছে এক হরিজন বস্তিতে গড়ে তোলেন খাদি সংঘ। আশপাশের নিম্নবর্গের মানুষদের শিক্ষার জন্য নৈশ বিদ্যালয়ও স্থাপন করলেন। সাল ১৯৩১। লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেওয়ার জন্য জেলে যেতে হল তাঁকে। তৃতীয় শ্রেণির বন্দি। প্রথমে সিউড়ি জেল, তারপর দমদম সেন্ট্রাল জেল। ১৯৩২-এ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মহাত্মা গান্ধির আদর্শ ও কর্মপন্থা বিষয়ে পড়ার ও লেখার সুযোগ পান। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘Selections from Gandhi’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণব্যবস্থার পূর্ণ জ্ঞান সঞ্চয় করে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর এই নিরলস চেষ্টার ফসল ‘হিন্দু সমাজের গড়ন’। নির্মলকুমার বসু লিখেছেন– ‘হিন্দুসমাজ বহুদিন যাবৎ নানা জাতির সংহতির দ্বারা গড়িয়া উঠিয়াছে।’ তিনি লক্ষ করেছিলেন, মধ্য ওড়িশার পাল্লাহড়ায় ‘অনার্য’ জুয়াং আদিজনজাতির মধ্যে স্নানের পবিত্রতা, উপবাসের নিয়ম, ধূপ-ধুনো জ্বালার অভ্যাস, হলুদ, আলোচাল ইত্যাদির ব্যবহার। পাশাপাশি লক্ষ্মীদেবী, প্রাচীন ঋষি-পত্নীদের নাম গ্রহণ, যা বিশেষভাবে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির লক্ষণ বহন করে। তিনি আরও লক্ষ করেছিলেন, জুয়াংদের মোরগ বলি, তাদের আপন দেবতা বুঢ়াম বুড়ো ও বুঢ়াম বুড়ির পুজো। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ও লৌকিক সংস্কৃতির এক অনবদ্য সহাবস্থান।
নির্মলকুমার বসু এটাও উল্লেখ করছেন– ‘হিন্দু সমাজের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যে সকল শ্রেণিভেদ লক্ষিত হয় এবং শাস্ত্রকারগণ যে সকল ব্যবস্থা দ্বারা সমাজ পরিচালনার চেষ্টা করিতেন; এই উভয় বিষয়কে একত্র করিলে ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজের গঠন সম্বন্ধে আমাদের মনে একটি সংহত চিত্র ফুটিয়া ওঠে।’ অর্থাৎ জাতিপ্রথা যে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে তা অস্বীকৃত হয়নি। তবে জাতিপ্রথা যেভাবে বিভিন্ন জাতিকে বেঁধে রেখেছে, তা নির্মলকুমার বসুর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ইলা মিত্র ও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া তেভাগার কিছু নাম
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৯৪৬-এর আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ– বাংলার ইতিহাসে একটি অন্ধকারময় দিন। কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু সেদিন। চোখের সামনে হিন্দু-মুসলমানের এরকম ভ্রাতৃঘাতী হনন নির্মলকুমারকে বিচলিত করেছিল। জীবনের বিপুল ঝুঁকি নিয়ে নির্মলকুমার বিপন্ন, ভীত, সন্ত্রস্ত হিন্দু ও মুসলমানদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন। সেই বছরই ১৭ অক্টোবর নোয়াখালিতে দাঙ্গা শুরু। ৬ নভেম্বর গান্ধীজি দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে ছুটে যান। নির্মলকুমার তখন নোয়াখালি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের শিবিরে শিবিরে ঘুরে দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নানা মর্মান্তিক কাহিনি লিপিবদ্ধ করছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর নির্মলকুমারের কাছে অনুরোধ ছিল, তাঁর একান্ত সচিব ও বাংলা অনুবাদক হিসেবে কাজ করার জন্য। নির্মলকুমার বিনীতভাবে জানিয়েছিলেন, ‘আমি বিজ্ঞানকর্মী, সেটাই আমার মূল কাজ। রাজনৈতিক আন্দোলনে সহায়তা করি দেশের সংকট সময়ে নিজেকে দূরে রাখতে চাই না বলে। মানুষের পাশে দাঁড়ানো সবসময় দরকার এই বিশ্বাস রেখে চলি।’ নির্মলকুমার নোয়াখালিতে গান্ধীজির সহযাত্রী হন। সেই অভিযান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিজ্ঞানী নির্মলকুমার চেয়েছিলেন, সমকালের বহুমান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ওই অবিসংবাদিত নেতার বিরল ব্যক্তিত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। চেয়েছিলেন, প্রত্যহের সাধারণ জীবনযাত্রার মধ্যে থেকে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়, সেই অসাধারণ মানুষটিকে বুঝে নিতে, চিনতে। বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে, সমাজমনস্ক সংস্কৃতিকর্মীর দৃষ্টিকোণ থেকে গান্ধীজিকে দেখেছিলেন নির্মলকুমার। তাঁর বিজ্ঞানসম্মত অন্বেষায় লব্ধ প্রাণবন্ত স্মৃতিচারণ– ‘My Days with Gandhi’ গ্রন্থটি। প্রকাশকাল ১৯৫২।
নির্মলকুমার বসু তো শুধু অধ্যাপক ছিলেন না। তিনি নিরলস কর্মী, চিন্তার জগতে স্বতন্ত্র এক মানুষ। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় নৃবিজ্ঞান চর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ‘Man in India’ জার্নালের চতুর্থ সম্পাদক নির্মলকুমার। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭২– মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই জার্নালে প্রকাশিত একাধিক প্রবন্ধে আদি জনজাতির কল্যাণকর্মে নৃবিজ্ঞানের গবেষণাভিত্তিক জ্ঞানের যে বিশেষ প্রয়োজন তা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, গবেষণাকে ভারতীয়ত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমাদের নিজস্ব প্রয়োগ পদ্ধতি ব্যবহার করে সমস্যার বিশ্লেষণ করতে হবে।
নির্মলকুমার বসুর মন ছিল সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত। সেই মনকে গড়ে নিয়েছিলেন তিনি নিষ্ঠা, অনুশীলন, অনুসন্ধান ও অধ্যয়নের মাধ্যমে। ১৯৫৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি ‘অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হবার পর নৃতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় ঐতিহ্য গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দু’মাসের মধ্যেই শুরু করলেন, ভারতীয়দের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তুর গঠনের আঞ্চলিক বিস্তার বিষয়ে একটা সমীক্ষা। ভারতবর্ষের ‘বিবিধের মধ্যে ঐক্য’– এর রূপটি যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য যে তথ্যগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা কিন্তু অভিজ্ঞ ক্ষেত্র-গবেষক দিয়ে সংগ্রহ করাননি। একান্ত আস্থার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একগুচ্ছ নবীন যুবক-যুবতীকে পাঠিয়েছিলেন ভারতবর্ষের ৩২২টি জেলার গ্রামে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ৩১১টি জেলার ৪৩০টি গ্রাম থেকে ৪১টি বিষয়ে তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল। খোলা মনে, অনুসন্ধিৎসু চোখে মানুষের সমাজকে দেখতে শিখিয়েছেন তিনি। সেই বিপুল ক্ষেত্রানুসন্ধানের ফসল ১৯৬১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘Peasant Life in India: A Study in Indian Unity and Diversity’। বইটির ভূমিকায় নির্মলকুমার লিখছেন, বাস্তব জীবনের সঙ্গে গভীর প্রত্যক্ষ পরিচয়ই মনে হয় সমস্ত সমাজ-বিজ্ঞানে অনুপ্রবেশের শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পথ।
১৯৬৭ সালে অসমের রাজ্যপালের অনুরোধে নির্মলকুমার বসু উত্তরপূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে গেলেন, ওই অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে একটি বিবরণ তৈরি করার জন্য। তিনি প্রতিবেদন লিখলেন ‘Edcational Problems of NEFA’. সেই বছরেই নির্মলকুমার ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুরোধে তফশিলি জাতি ও তফশিলি উপজাতির কমিশনার-এর পদে যোগ দেন। তিন বছর ওই পদে ছিলেন। কাজ করেছেন হৃদয়, মনন ও চিন্তন দিয়ে। সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছেন অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়ন ও কল্যাণ সম্ভাবনার পথরেখা।
নির্মলকুমার বসু আমাদের দেশের প্রধান এক নৃতত্ত্ববিদ, যিনি ওড়িশার জুয়াং, ছোটনাগপুরের হো, মুণ্ডা, ওরাওঁ জনজাতি, বোলপুরের মুচি, ডোম, বাউরিদের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি , যিনি অনায়াসে নিরক্ষর মুচি, জঙ্গলের আদিবাসী অথবা একজন দাম্ভিক প্রশাসক বা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কোনও স্তর ভেদ না করে, সহজভাবে মিশে যেতে পারতেন। আবার এই মানুষটিই মন্দির-স্থাপত্যের ও ভাস্কর্যের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের অধীর পিপাসায় ছুটে গিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে। কলকাতার সমাজজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে গিয়েও তিনি বলেছেন, একজন অনুসন্ধানকারীর সার্বিক পদ্ধতিই হল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ। যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানী পরিচয়ের আড়ালে তাঁর সংবেদনশীল শিল্পীসত্তার উদ্ভাস ঘটেছে কোনারকের মন্দির, রবীন্দ্রনাথের ছবি, রামকিঙ্করের ভাস্কর্য বিষয়ে লেখাগুলিতে। যুক্তির কঠোর লাগাম ছেড়ে তখন তিনি প্রকৃতির রূপে মগ্ন হয়েছেন।
নির্মলকুমার বসু নিজেকে পরিব্রাজক হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসতেন, নৃতত্ত্বচর্চাও করেছেন পরিব্রাজক রূপে। জঙ্গলে বিরহড় জাতি, সমুদ্রতীরের নুলিয়া জাতি, হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের আচার-ব্যবহার আলোচনা করে তিনি বলেছিলেন– ‘সমাজকে অপরিবর্তনীয় ভাবা একটা মহৎ ভ্রান্তি। মানুষকে সব দেশে সব অবস্থায় দেখিলে সেই ভ্রান্তি আমাদের কাটিতে পারে। নৃতত্ত্বের সবচেয়ে বড় দান এইখানে। সে নানা দেশের সংবাদ আনিয়া আমাদের ছেলেবেলাকার সংস্কার হইতে মনকে মুক্ত করিয়া দেয়। আত্মপ্রসাদ দোষ কাটাইয়া সমগ্র মানবজাতিকে পরমাত্মীয় বলিয়া ভাবিতে শেখায়।’ এই শিক্ষায় আমরা কি প্রাণিত হতে পারি না !
তথ্যপঞ্জি:
বসু, নির্মলকুমার। ১৩৫৬। নবীন ও প্রাচীন। কলকাতা: বেঙ্গল পাবলিশার্স।
বসু, নির্মলকুমার। ১৩৫৬। হিন্দু সমাজের গড়ন। কলকাতা: বিশ্বভারতী।
বসু, নির্মলকুমার। ১৩৬৬। পরিব্রাজকের ডায়েরি। ২য় সংস্করণ। কলকাতা: বিদ্যোদয় লাইব্রেরি।
Bera, Gautam Kumar. 2009. The Wanderlust Anthropologist– Anthropological Profile of Nirmal Kumar Bose. Allahabad: The Oriental Institute of Cultural and Social Research.
দে, অভীককুমার। ২০০৩। নির্মাল্য– অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু শতবর্ষ স্মরণ। কলকাতা: লোকসংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ।
সিংহ, পূর্ণিমা। ২০০১। নির্মলকুমার বসু। কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
Sinha, Surajit. 1986. Nirmal Kumar Bose: Scholar Wanderer. New Delhi: National Book Trust.
Sinha, Surajit. 1997. Nirmal Kumar Bose Memorial Lecture, 1993. New Delhi: Indira Gandhi National Centre for the Arts.