রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা সোজাসুজি দাঁড়িয়ে নেই, খানিক হেলানো। সে হাতের লেখা ছাড়া-ছাড়া নয়, বরং অক্ষর জুড়ে জুড়ে যায়। একার্থে ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ। সেই হাতের লেখা থেকেই রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দেন চিত্রকলার রাজ্যে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিই হয়ে দাঁড়ায় সেই অতলান্ত দরজা। কলেজ পাড়ার ফুটপাথে কেনা বইয়ের গায়ে, নাম-উপহারের লেখায় রবীন্দ্রলিপির ছাঁদ পাওয়া যায়। এমনকী, সুকান্ত ভট্টাচার্যের হাতের লেখাও রবীন্দ্রনাথের বলেই যেকোনও সময় ভ্রম হতে পারে!
সূর্য যখন ঢলে যায় খানিক, দুপুর গড়িয়ে ঊন-বিকেল, ইশকুল ফেরত বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি, বিক্রি হচ্ছে আমসি-আচার-কুল, পুরাতনী হাওয়া দিচ্ছে গাছের নতুন পাতায়, খসেও পড়ছে কিছু চিরকালের জন্য– এই যে দৃশ্য, যা ভাবতে শুরু করলে আপনি-আমি ক্রমে আরও ধারাবাহিক দৃশ্য রচনা করে ফেলতে পারি, তা-ই রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার সমার্থক। না, কোনও আজগুবি তত্ত্ব বা খাপছাড়া কথা বলতে চাইছি না। একথা বলছি, কারণ রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা খাড়া নয়, লম্বালম্বি না। মাথার ওপর থেকে সেই রবিতেজ এসে পড়ে না। তা খানিক বিলম্বিত, সূর্যপোড়া ছাইয়ের থেকে দূরে, নিজস্ব বর্ণে-গন্ধে রচিত। এই যে ফন্টে আপনারা লেখা পড়ছেন এখন, এই ফন্ট যদি স্কেল দিয়ে মেপে দেখেন, ত্রিকোণমিতির বিদ্যা ফলান, দেখবেন, এগুলো প্রতিটিই ৯০ ডিগ্রি খাড়া। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা, যে-হাতের লেখা সুপরিচিত এবং বাঙালির হাতে হরে-দরে নকল হয়ে এসেছে, তার ধরন খানিক হেলে পড়া। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মোহন বোস, প্রমাণ করেছেন এ জিনিস। মাথার ওপরকার যে রবি, সেই রবি তাই রোদ দিয়েছে, আর রবীন্দ্রনাথ দিয়েছে ছায়া। দুই রবির মধ্যে এই হল ফারাকের জায়গা। রবি ও রবি মিলেই গড়ে ওঠল আমাদের রৌদ্রছায়ার সংকলন।
সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই সেই প্রথম বাঙালি, যাঁর হস্তলিপি আপামর বঙ্গসাধারণের হয়ে উঠল রোল মডেল। অগণন বাঙালির হাতের লেখা হয়ে উঠেছিল সফল কিংবা অসফল রবীন্দ্রহস্তাক্ষর। কেউ কেউ হয়তো বা এই নকলনবিশি করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন একেবারে অন্য একটি পথ। সে পথেও নিশ্চয়ই এই হস্তাক্ষরের কিছু কিছু ছায়া থেকে গিয়েছেই। পাণ্ডুলিপির লেখাপত্র দেখলেই বুঝতে পারবেন, রবীন্দ্রনাথের আগে যাঁরা বাংলা ভাষায় লিখে নাম করেছেন– বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদনও হাতের লেখায় তেমন ভালো ছিলেন না। ভালোর থেকে এখানে ‘শিল্পিত’ বলাই কি শ্রেয়? হয়তো। ফলে তাঁদের অনুকরণে হাতের লেখা গড়ে উঠার কোনও ঘরানা তৈরি হয়নি। তবে, প্রশ্ন উঠতেই পারে, রবীন্দ্রনাথেরও আগে বাঙালিরা কি হাতের লেখার কোনও মডেল পায়নি? তা হয়তো পেয়েছে। বাংলা পুথি এবং বাংলা প্রাইমারের কথা ভুলে যাই কী করে! পুথির হাতের লেখার যে ধরন তার উপকরণের জন্যই তার ধারাটা খানিক অন্যরকম। খাগের কলম দিয়ে, বাংলা তো বটেই, বিশেষ করে যে সংস্কৃত পুরাতন লিপির খোঁজ পাওয়া যায়, তার ধরনখানা একইরকম। ওই হাতের লেখার টানের নেপথ্যে পুথি লেখকদের শুধুই যে নিজস্ব ভঙ্গি রয়েছে– তা-ই নয়, লেখার উপকরণের ভঙ্গিও ঢুকে পড়ছে। জীবিকার স্বার্থে পুঁথি-লিখিয়েদের হস্তলিপি বিশেষ আলাদা হয়নি। পুথির হাতের লেখা বিশিষ্ট গড়ন এবং ঘরানা মেনেই লেখা। এছাড়াও নিশ্চয়ই জবরদস্ত ভালো হাতের লেখার অধিকারী বহু বাঙালিই ছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো বিচ্ছুরণের সুযোগ ছিল না। ফলে সেই হাতের লেখা কোনওভাবেই জনপ্রিয়-গণপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। রবীন্দ্র-ব্র্যান্ড নির্মাণের কৌশলে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা তো এখনও অপরাজিত। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখাকে অহরহ ব্যবহার করা এখনও যথেষ্টই ‘ইন থিং’।
রবীন্দ্রনাথেরও একখানা পুঁথি ছিল বটে। ‘মালতী পুঁথি’। কিশোর রবীন্দ্রনাথের লেখার খাতা। সেই খাতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে-হাতের লেখাকে পরবর্তীকালে রবীন্দ্র-লিপি বলে আক্ষরিকভাবে চেনা যায়– সেই অক্ষরের সঙ্গে এই অক্ষরের ফারাক যথেচ্ছ। তবে একেবারে সুমেরু-কুমেরু দূরত্ব– সেকথাও বলছি না। ‘পূরবী’ কিংবা ‘রক্তকরবী’র পাণ্ডুলিপিতে হস্তলিপির সংশোধন বা কাটাকুটি তো হাতের লেখারই এক্সটেনশন। তাঁর চিত্রচর্চারই আরেকরকম নিবেদন। ল্যাপটপ-তুখড় ডিজিটাল রবীন্দ্রনাথ হয়তো-বা চিত্রচর্চার জন্য অন্য কোনও উপায় খুঁজে নিতেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সে পথে ওঁর হাতের লেখা এমন অমোঘভাবে আলোচিত হত না। সেই কাটাকুটি, হাতের লেখাকে রাখা ও না-রাখার শিল্পিত অন্ধকার ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। প্রতিমা দেবী ‘গুরুদেবের ছবি’ প্রবন্ধে লিখছেন– ‘কাটাকুটির খেলা একদিন চিত্রজগতের দ্বারে এসে ঘা দিল।’ ওই হাতের লেখাই আসলে লেখক রবীন্দ্রনাথ ও ছবির রবীন্দ্রনাথের মিলনমুহূর্ত। এবং তা খুব নিয়ন্ত্রিত, সুচিন্তিত, করায়ত্ত মিলন নয়। সেই মিলনে যা অসম্ভব, যা অবাস্তব তার প্রতি সংবেদনশীল হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘সন্ধ্যাসংগীত’-এর সূচনায় রবীন্দ্রনাথ অক্ষরের ছাঁদ নিয়ে কথা পেড়েছেন। কী সেই কথা? বলেছেন, ‘কাঁচা বয়সে পরের লেখা নক্ল করে আমরা অক্ষর ফেঁদে থাকি বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মধ্যেও নিজের স্বাভাবিক ছন্দ একটা প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে পরিণতিক্রমে সেইটেই বাইরের খোলসটাকে বিদীর্ণ করে স্বরূপকে প্রকাশ করে দেয়।’ হাতের লেখাও ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বরূপ খোঁজার পথ। সেই পথেই তো রবীন্দ্রনাথ পেলেন ছবির নতুন দরজা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথেরও একখানা পুঁথি ছিল বটে। ‘মালতী পুঁথি’। কিশোর রবীন্দ্রনাথের লেখার খাতা। সেই খাতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে-হাতের লেখাকে পরবর্তীকালে রবীন্দ্র-লিপি বলে আক্ষরিকভাবে চেনা যায়– সেই অক্ষরের সঙ্গে এই অক্ষরের ফারাক যথেচ্ছ। তবে একেবারে সুমেরু-কুমেরু দূরত্ব– সেকথাও বলছি না। ‘পূরবী’ কিংবা ‘রক্তকরবী’র পাণ্ডুলিপিতে হস্তলিপির সংশোধন বা কাটাকুটি তো হাতের লেখারই এক্সটেনশন। তাঁর চিত্রচর্চারই আরেকরকম নিবেদন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রলিপি থেকেই তো তৈরি হয়েছিল বিশ্বভারতীর সিল। বারেবারেই বদলে বদলে গিয়েছিল ওঁর ‘র’ এবং ‘ঠ’ লেখার খসড়া। ‘র’ অর্থে রবীন্দ্রনাথ এবং ‘ঠ’ অর্থে ঠাকুর, তার সংক্ষেপিত এই যে রূপ, র ও ঠ-এর নানা আকার, মাত্রা– তা দিয়েই পরবর্তীকালে রথীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতীয় সিল। এই ‘র’ ও ‘ঠ’ লেখার চর্চা রবীন্দ্রনাথ ‘ক্ষণিকা’র খসড়ার প্রথমবার ঘটাচ্ছেন। সময়টা ১৯০০ সাল। ক্রমে এই ‘র’ ও ‘ঠ’ চলে যাবে রবীন্দ্রচিত্রকলার দিকেই। তাহলে একথা বললে কি অতিশয়োক্তি হবে যে, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ছায়াতেই বড় হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা?
রক্তকরবী– যে রবীন্দ্রনাটকের এ বছর শতবর্ষ– তার পাণ্ডুলিপিতেই তো আরেক বদলে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের দেখা মিলছে। যে রবীন্দ্রনাথ, পূর্বতন রবীন্দ্রনাথকে শিল্পের চেয়ার থেকে সরে যেতে বলে, দিব্যি জাঁকিয়ে বসছেন। রবীন্দ্রনাথের ছবির ব্যাপারে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের চমৎকার একটি প্রবন্ধ রয়েছে। সে প্রবন্ধের নাম–‘রবীন্দ্র-চিত্রের ভিত্তি’। সেখানে বিনোদবিহারী লিখছেন– কাগজের উপর কলম দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হিজিবিজি কাটার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এইভাবে কলম চালাতে গিয়ে কলমের মুখে কতকগুলি আকার অনায়াস আত্মপ্রকাশ করে। এইসব অচেতন মনের সম্বন্ধ মনোবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। মনোবিজ্ঞানীদের ব্যাখা বাদ দিয়েই এই রকম কাটাকুটির আরও একটি দিক সম্বন্ধে প্রশ্ন হতে পারে– এইসব আকার আমরা পেলাম কোথা থেকে?
এই সমস্ত আকারই আসলে দেখা-উত্তীর্ণ ছায়া, স্মৃতি-উত্তীর্ণ ছায়ার সম্বল– তার সঙ্গে অবশ্যই মিলে রয়েছে অনিয়ন্ত্রণ উন্মাদ কালি ও কলমের আন্তঃসম্পর্কটি। সেইসব রূপের হয়তো বাস্তবের কোনও প্রমাণিত রূপান্তর নেই– কিন্তু ছায়া কি কেবলই বাস্তবনিষ্ঠ কোনও বস্তু?
এ লেখায় আপাতত রবীন্দ্র-চিত্রকলাকে অব্যাহতি দিই। ফেরা যাক নিপাট হাতের লেখার কাছে। ১৯২৬ সালে দুরন্ত এক কাণ্ড ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ– কী সেই কাণ্ড? হাতের লেখাতেই ছাপা হল একটি আস্ত বই। রবীন্দ্রনাথ যে বইয়ের নাম দিলেন, ‘লেখন’। ভূমিকায় লিখছেন, ‘এর প্রধান মূল্য হাতের অক্ষরে ব্যক্তিগত পরিচয়ের। সে পরিচয় কেবল অক্ষরে কেন, দ্রুতলিখিত ভাবের মধ্যেও ধরা পড়ে। ছাপার অক্ষরে সেই ব্যক্তিগত সংস্রবটি নষ্ট হয়– সে অবস্থায় এইসব লেখা বাতি-নেবা চিনে লণ্ঠনের মতো হালকা ও ব্যর্থ হতে পারে। তাই জর্ম্মনিতে হাতের অক্ষর ছাপাবার উপায় আছে খবর পেয়ে লেখনগুলো ছাপিয়ে নেওয়া গেল। অন্যমনস্কতায় কাটাকুটি ভুলচুক ঘটেছে। সেসব ত্রুটিতেও ব্যক্তিগত পরিচয়ের আভাস রয়ে গেল।’
মনে করুন, রবীন্দ্রনাথ ‘সন্ধ্যাসংগীত’ লিখছিলেন ১৮৮২ সালে। সেই ভূমিকায় যা লিখেছিলেন, এ লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি, স্বরূপের প্রকাশ। ‘লেখন’-এর প্রকাশ সাল ১৯২৬। তখন রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা ব্যক্তিপরিচয় বহন করে চলেছে এমনভাবেই যে তিনি, সামান্যতম কাটাকুটি, যা একেবারেই ‘রক্তকরবী’ কিংবা ‘পূরবী’র কাটাকুটি না হলেও, রাখলেন। এবং সেই ভুলচুকেও রবীন্দ্রছাপ রইল।
এই ব্যক্তিগত পরিচয়ের ছাপখানাকেও রবীন্দ্রনাথ আক্রমণ করতে ভোলেননি। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে সেই স্বেচ্ছা-আত্ম-আক্রমণে রবীন্দ্রনাথ যা বলিয়েছেন, তাতে ওঁর হাতের লেখা রয়েছে নিশানায়। যেন গুলি এসে প্রথম লাগবে তাঁর হাতের লেখায়, তারপর হাতে।
‘…তাঁর রচনারেখা তাঁরই হাতের অক্ষরের মতো– গোল বা তরঙ্গরেখা, গোলা বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে। ওটা প্রিমিটিভ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মক্শো-করা।’
অথচ তারপরও– আর কেউ নয়, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ছায়াতেই গড়ে উঠতে লাগল অগুনতি বাঙালির হাতের লেখার গড়ন। অবশ্যই মনে পড়বে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। সুকান্তর হাতের লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা পাশাপাশি রাখলে সাধারণ মানুষ অন্তত অনেক ক্ষেত্রেই ফারাক ঠাওর করতে পারবেন না। এমনকী, ফুটপাথ থেকে কেনা বহু পুরনো বইয়ের ভেতরে যে হাতের লেখার উদাহরণ পেয়েছি, তাতে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ছাঁদ রয়েছে। গ্রাফোলজি যাঁরা চর্চা করেন বা রবীন্দ্র-বিশারদ– তাঁদের চোখে ধুলো দেওয়া অবশ্য আলাদা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার অনিবার্য টান থেকে সরে আসতে চেয়ে অন্য ছাঁদের হস্তলিপির দিকে ঝোঁকেন তিনি।
১৯৬২ সালে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখাকে ছাপার অক্ষরে এনে ফেলার একটি টেকনিকাল বৃত্তি পেয়েছিলেন পরিতোষ সেন। সেই বৃত্তি ছিল ফরাসি সরকারের। সে কাজে যদিও নানারকম বাধাবিপত্তির কারণে উপসংহারে পৌঁছনো যায়নি। কিন্তু সে অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে পরিতোষ সেন রবীন্দ্রনাথের করলিপি নিয়ে চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন,
“–ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ধ’ অক্ষরটি। যেন একটি বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে তার মাথাটি বুকের নরম পালকের মধ্যে গুঁজে ঘুমোচ্ছে। শুধু ঠ্যাং জুড়ে দিলেই হল। কিংবা ‘দ’ অক্ষরটি যেন মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে একটি লোক দাওয়ায় বসে আছে। তার সঙ্গে সামান্য কল্পনা মেশালেই, গাছপালা, মানুষজন পশুপাখি অনেক কিছুই দেখা যাবে।”
দ-কে এই যে দাওয়ায় এনে ফেলার কথা বললেন পরিতোষ সেন– এ কি ছায়ার কথা নয়? দাওয়ার ছায়াতেই তো সেই কল্পনাপ্রসূত লোকটি, বিশ্রাম নিচ্ছে খানিক। পরিতোষ সেন সেই লেখাতেই জানাচ্ছেন সত্যজিৎ রায়ের মতে রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরই বাংলায় প্রথম ‘ইটালিক’ লেখা। ৯০ ডিগ্রি দাঁড়িয়ে থাকার বিপরীতে এই ৮০-৭৮ ডিগ্রি হেলে থাকা খানিক ছায়ার দিকেই নির্ভার ঝুঁকে থাকা। নির্ভার এইজন্যই যে সবসময়ই, এমনকী, যুক্তাক্ষর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তা বাড়তি ঝুঁকে পড়েনি। বজায় রেখেছে সাম্য।
যে হাতের লেখা অনুসরণ করে অনেক বাঙালির হাতের লেখা গড়ে উঠল– অনেকে নিজস্বতা চেনাতে সরেও গেলেন সেই ছাঁদ থেকে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা গড়ে উঠল কীসের ছায়ায়? কারও হাতের লেখার প্রভাব কি পড়ল গিয়ে তাতে? সত্যজিৎ চৌধুরীর ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’-এ একরকম উত্তর মিলেছে এই প্রশ্নের।
‘ঠাকুরবাড়ির জেষ্ঠ্য পুরুষদের মধ্যে অনেকের লেখার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার ছাঁদের মিল পাওয়া যায়। যেমন দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের’।
যাঁর হাতের লেখা জীবৎকালেই বহু লোকে নকল করেছে, সেই হাতের লেখার জন্য কি বিপাকে পড়েননি রবীন্দ্রনাথ? পোস্ট-অফিসে নিজের স্পেশাল সিগনেচার করতে হত তাঁকে। নকলনবিশিদের দক্ষতায় আস্থা রেখে সেই মৌলিক হস্তাক্ষরের সিগনেচারখানা ডাকবিভাগ ছাড়া জনসমক্ষে সেভাবে আসেনি বহুদিন। সে সই দেখানো হয়েছিল ডাকবিভাগের প্রদর্শনীতে । আরেকবার এক হুলস্থুল কাণ্ড ঘটেছিল খাস বিশ্বভারতীতেই, রবীন্দ্রনাথের নিজের ডেরায়। অবিকল রবীন্দ্রলিপিতে নোটিস পড়েছিল: ‘আজ ক্লাশ ছুটি’। সেই রবীন্দ্রলিপিকারের নাম পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়বে দ্রুতই, তা অবশ্য রবীন্দ্রলিপি হুবহু নকল করার জন্য নয়, নিজের লেখার খাতিরেই। তিনি– মুজতবা আলী।
… রবিচ্ছায়া-য় আরও পড়ুন …
পবিত্র সরকার-এর লেখা: ছায়াসুনিবিড়
রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনায় মানুষ ব্রাত্য ছিল না
জয়দীপ ঘোষ-এর লেখা: ছায়ার সঙ্গে কুস্তি
শ্রুতি গোস্বামী-র লেখা: ছায়ার নারীস্বরূপ কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ?