রণেন আয়ন দত্তর ছবিতে একটা ইতিহাস মিশে থাকত। মাথার তেলের বিজ্ঞাপন ‘কেশরঞ্জন’-এ দেখবেন কীভাবে তেল তৈরি হচ্ছিল, সে ব্যাপারটা তিনি ধরে রেখেছেন একটা ছবিতেই। এরকম অনেক কাজই আছে তাঁর। ‘সুন্দরম’-এ আরতি ঠাকুরের লেখায় চমৎকার একটা পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তী কালে আমি দেখিনি। সাদা-কালোয় ড্রয়িংয়ের পিছনে একটা রং চাপিয়ে দেওয়া। অসামান্য দেখতে হয়েছিল তা! ‘দূরদর্শন’-এ একবার ওঁর কাজ দেখানো হয়েছিল, সেখানে এত দ্রুত ছবি এঁকেছিলেন, না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব!
ছবি: সঞ্জীত চৌধুরী
রণেনদা জন্মেছিলেন সিলেটে, ১৯২৭ সালে। কলকাতায় এসেছিলেন খানিক পরে। বড় হয়ে না অবশ্য, ছোটবেলাতেই। থাকতেন কেশব সেন স্ট্রিটের দিকে, মেছুয়াবাজারে। ভাবতে অবাক লাগে, ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির তেমন কোনও ইতিহাস ছিল না রণেনদার। মাটির পুতুল গড়তেন বলে জানি। ওঁর বাবাই নাকি ওঁকে ছবির ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর তাঁর জীবনটা বদলে যায় এই ছবি আঁকা দিয়েই। ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রায় জোর করেই আর্ট স্কুলে ভর্তি করানো। সম্ভবত রমেন চক্রবর্তীর আমল তখন। এই আর্ট স্কুলই আমর্ম বদলে দিল তাঁকে। ফিগার ড্রয়িং আর জলরং– দুই বিষয়েই তিনি অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠলেন!
দারিদ্রের মধ্য দিয়েই কাটিয়েছিলেন ছেলেবেলা। এমনকী, এই আর্ট স্কুলের সময়ও। সহপাঠীরা যখন ছবি আঁকতে যাচ্ছে দূরদূরান্তে– তখন ওঁর কাছে পয়সাই নেই! তাই বলে অবশ্য রং-তুলি উপরের কোনও তাকে রেখে অবসর নেননি। তিনি এঁকেছেন। এই কলকাতার রাস্তাঘাটেই ঘুরে ঘুরে এঁকেছেন। কখনও খালপাড়, কখনও মেছুয়াবাজার। কলেজ এগজিবিশনে ২৩টা ছবি গিয়েছিল এই আঁকা থেকেই। মজার ব্যাপার, একটি ছবিও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকেনি! পেয়েছিলেন ‘ভবানী লাহা পুরস্কার’ও। সেই পুরস্কারের টাকাতেই প্রথমবার বাইরে স্কেচ করতে যান। শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পেয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মহীরুহ। আনোয়ারুল হক, জয়নুল আবেদিন, মাখনলাল দত্তগুপ্ত ও রমেন চক্রবর্তী। মুরহেড বর্ন ও জে. এম. ডাব্লিউ. টার্নারের ছবি পছন্দ করতেন বলে একবার জানিয়েছিলেন রণেনদা। কলেজ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথমও হয়েছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দারিদ্রের মধ্য দিয়েই কাটিয়েছিলেন ছেলেবেলা। এমনকী, এই আর্ট স্কুলের সময়ও। সহপাঠীরা যখন ছবি আঁকতে যাচ্ছে দূরদূরান্তে– তখন ওঁর কাছে পয়সাই নেই! তাই বলে অবশ্য রং-তুলি উপরের কোনও তাকে রেখে অবসর নেননি। তিনি এঁকেছেন। এই কলকাতার রাস্তাঘাটেই ঘুরে ঘুরে এঁকেছেন। কখনও খালপাড়, কখনও মেছুয়াবাজার। কলেজ এগজিবিশনে ২৩টা ছবি গিয়েছিল এই আঁকা থেকেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কলেজ পাশের পর এসে পড়লেন অন্নদা মুন্সীর কবলে। ‘প্রবেশিকা’ নামে একটা সংস্থা চালাতেন অন্নদা মুন্সী। সেখানেই কাজ পেলেন রণেনদা। রণেনদাকে কমার্শিয়াল আর্টের জগতে নিয়ে আসেন এই অন্নদা মুন্সীই। ‘প্রবেশিকা’য় কাজ করতে করতেই ‘পাবলিসিটি ফোরাম’ নামের বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে প্রথম বিজ্ঞাপনের কাজ করলেন রণেনদা। তারপর বোম্বাইতে ‘স্টেনঅ্যাক’ বিজ্ঞাপন সংস্থায় চলে যান। তারপর যা করেন, তা ভাষা নির্বিশেষে বিজ্ঞাপনের জগতে এক একটা মাইলস্টোন। ছবি-আঁকা বিজ্ঞাপনে বাঙালির যে দীর্ঘকাল মুগ্ধতাবোধ ছিল, তার সৌজন্যে রণেন আয়ন দত্তর হাতের কাজ। জে. ওয়াল্টার টমসনে (পরবর্তী কালে হিন্দুস্থান টমসন) শেষ জীবনে চিফ আর্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন। ‘কল্পনা’ বিজ্ঞাপন সংস্থাতেও কাজ করেছেন টুকটাক। অনেক ছবির নীচেই তাঁর সই-সংক্ষেপ ‘Rad’ দেখতে পাওয়া যাবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কাজ দেখে মুগ্ধ ইন্দিরা গান্ধী আলাপ করেছিলেন রণেন আয়ন দত্তর সঙ্গে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অনেক সময়ই দেখা যায়, পেন্টাররা ফিগার ড্রয়িংয়ে তেমন দক্ষ হন না। কিন্তু রণেনদা ছিলেন এ ব্যাপারে অদ্বিতীয়! এবং, ইলাস্ট্রেটিভ বিজ্ঞাপনের জগতে ক্রমে উনি শ্রেষ্ঠতম হয়ে উঠলেন। এই ইলাস্ট্রেটিভ বা বর্ণনাত্মক ব্যাপারটায় ওঁর শিক্ষাগুরু মাখনবাবুর অবদান রয়েছে বলে আমার ধারণা। মাখনবাবুর অন্যান্য ছাত্রর মধ্যেও দেখা যাবে ছবিতে একধরনের গল্প বলার ভঙ্গি।
ওঁর ছবিতে একটা ইতিহাস মিশে থাকত। মাথার তেলের বিজ্ঞাপন ‘কেশরঞ্জন’-এ দেখবেন কীভাবে তেল তৈরি হচ্ছিল, সে ব্যাপারটা তিনি ধরে রেখেছেন একটা ছবিতেই। এরকম অনেক কাজই আছে তাঁর। ‘সুন্দরম’-এ আরতি ঠাকুরের লেখায় চমৎকার একটা পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তী কালে আমি দেখিনি। সাদা-কালোয় ড্রয়িংয়ের পিছনে একটা রং চাপিয়ে দেওয়া। অসামান্য দেখতে হয়েছিল তা! ‘দূরদর্শন’-এ একবার ওঁর কাজ দেখানো হয়েছিল, সেখানে এত দ্রুত ছবি এঁকেছিলেন, না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব!
বেশ কিছু প্রচ্ছদও করেছিলেন রণেনদা। প্রবোধকুমার সান্যাল-এর ‘অগ্নিসাক্ষী’, সুধাংশু দাস-এর ‘নাবিক’, দীপক চৌধুরী-র ‘দাগ’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ইত্যাদি।
রণেনদা চলে গেলেন। ৩ মার্চ, সন্ধেরাতে তিনি চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু বাংলা সাংস্কৃতিক মহল কি তাঁকে মনে রেখেছিল আদৌ?