‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে শহরের চার বন্ধুর মধ্যে তিন জন যুবক বক্সার পরে কুয়োর জলে স্নান করতে আসে এবং দৃশ্যের মধ্যে গাড়ি করে ঢুকে পড়ে দুই নায়িকা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে তিনটির মধ্যে শুরু হয় এক চরম অস্বস্তি। পরিচালক সিনেমায় মেল ভয়ারিজমের গালে একটা ঠাস্ করে চড় কষান। আমরা এইসব জটিল ব্যাপার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধু ভাইবোনের বৃষ্টিতে স্নান করার একটা দৃশ্যের কথা ভাবতে থাকি আর পিছনে দেশ রাগ বাজতে থাকে।
‘স্নান’ শব্দটার সঙ্গে কেমন যেন একটা নরম টলটলে স্নিগ্ধতা মিশে থাকে। আমার মেয়েলি ছোটবেলায়, নীল-সবুজ পাখির মতো আমার বাবা এবং মা– তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক নির্মল পুকুর পাড়ে একটা সাদা রঙের থই থই দোতলা সংসার পেতেছিল। গভীর শীতকালের ব্রাহ্মমুহূর্তে যদি কোনও কোনও দিন আমার ঘুম ভেঙে যেত, শুনতে পেতাম– পাশের পাড়ার এক সুঠাম কাকু ভোরের ট্রেন ধরে শহরে কাজে যাবে বলে সেই বরফ কুচি ভর্তি পুকুরের মিষ্টি জলে পাকা লাল রুই মাছের মতো ঝপাং ঝপাং আওয়াজ করে গুনে গুনে ১৩ বার দ্রুত লয়ে ডুব দিয়ে চলেছে। তার খাটিয়া বউ তখন হয়তো এক হাতে নিজের উষ্ণ সোয়ামির জন্য ঝাল ঝাল টিফিন বাক্স গুছিয়ে নিচ্ছে ও অন্য হাতে কালচে স্টোভের ওপর আদা দিয়ে লাল চা বানানোর জন্য একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে জল গরম বসিয়েছে। সেসব সময় সুঠাম কাকুর খাটিয়া বউয়ের পাশে রাখা ভাঙা টেপ রেকর্ডারটার ভিতর খুব আস্তে আস্তে একটা মলিন ক্যাসেটে ঘুরে চলত আশার আয়েশি গলায় ‘আর কত রাত একা থাকব…’।
সেই কাকু-কাকিমার বাড়ির পাশেই থাকত, দাদা-বউদিদের সংসারের বোঝা, প্রায় বছর চল্লিশের একটি অবিবাহিত ‘কালো’ মেয়ে। আমি নিশ্চিত যে, রাতের পর রাত জেগে কালো মেয়েটি সেই গানখানা শুনতে শুনতে নিজের গলায় দড়ি দিয়ে শূন্যে ঝুলে পড়ার স্বপ্ন দেখত নির্ঘাত। আমাদের ছোটবেলাতেই ওই কালো পিসিটা কোনও এক বৃষ্টির রাতে সত্যি সত্যিই গলায় চুমকি বসানো একটা হলুদ ওড়নার ফাঁস জড়িয়ে উড়ে গিয়েছিল সেই অলৌকিক ছাদবাগানে, যেখানে দেবশ্রী রায়-তাপস পালের ছবি বুকে নিয়ে বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে জুড়িয়ে নিচ্ছিল ওম ওম বুকের জ্বালা। তারপরেও সেই সুঠাম কাকু সারা বছর ধরে, সপ্তাহে ছয় দিন, ঠিক ব্রাহ্মমুহূর্তের সময় তারা ভরা আকাশের নিচে, আমাদের বাড়ির পাশের পুকুরটায় নিয়মিত ডুব দিয়েছে, পাড়ায় দুর্গাপুজোয় মাইকের ভিতর নায়িকা-নায়কের ছবি বুকে নিয়ে স্নান সেরেছে দুর্বার, আমরা ছোটরা প্রত্যেকে জলে ডুব দিয়ে খেলেছি গোপন ধরাধরি, আর আমাদের স্মৃতি থেকে বিলকুল ধোঁয়া হয়ে উবে গিয়েছে সেই দাঁত-উঁচু আইবুড়ো কালো মেয়েটি।
অনেক বছর পর যেদিন ভোরবেলা বেকার আমি আমার বিলিতি ভাগনেকে নিয়ে পুরীর জগন্নাথদেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন ভগবানকে স্নান করানোর জন্য সাদা গামছার মতো একটা পোশাক পরানো হয়েছে, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন সেই ছোটবেলার পাড়ায় ফেলে আসা ‘কালো পিসি’ হলুদ একটা ভিজে জবজবে সিফন জড়িয়ে আমার অতৃপ্ত বুকের ছাদে এসে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করল। মন্দির থেকে বেরিয়ে, যে-দোকানে জুতো রাখা ছিল, সেখানে শুনলাম বাজছে নতুন ‘টিপ টিপ বরসা পানি…’। আমার মনে পড়ল পুরনো অক্ষয় কুমারের লোমশ বুকখানা, যেখানে কৈশোরে কতবার আগুন জ্বালিয়ে আমি চুপিচুপি রান্নাবাটি খেলেছি; পাশের বাড়ির ছেলেটি সঞ্জীব কুমার সেজেছে সেই মিথ্যে ঘর ঘর খেলায়। তাকে আমি বলেছি, ‘যাও স্নান সেরে এসো, আমার রান্না রেডি’, আর সে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠেছে ‘ঠান্ডে ঠান্ডে পানি সে নাহানা চাহিয়ে/ গানা আয়ে ইয়া না আয়ে গানা চাহিয়ে’। এইসবের মাঝখানে কেটে গেছে কত কত বছর। আমি এলেবেলে দুধ-ভাতের মতো বড় হয়েছি খালি। বৃষ্টিতে ভিজে শ্যামবাজার থেকে রাজবল্লভপাড়া অবধি কাঁদতে কাঁদতে মেসে ফিরেছি, কানে দেওয়া হেডফোনে বেজেছে ‘তুঝে ইয়াদ না মেরি আয়ি, তো কিসিসে আব ক্যায়া কেহেনা’।
ততদিনে বুঝে গিয়েছি, কীভাবে শাহরুখ খান আর আমি প্যারালাল ইউনিভার্সের বলিউডে, এক বাথটব শ্যাম্পেনের ভিতর স্নান সারাতে সারতে লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপন শুট করছি। এর মধ্যে অবশ্য এ-ও জেনে ফেলেছি, একজন আর্ট ফিল্মের ‘কালো’ নায়িকা এবং একজন অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যান ‘আজ রাপাট যায়ে’ গানে বেদরদি নেচে, মোলায়েম লিপ মিলিয়ে আর ফাটাফাটি স্নান করে, এই ইউনিভার্সেরই কিছু নিচু স্টিরিওটাইপ ধারণাকে একেবারে ছারখার করে দিয়েছে।
আমার কলেজ জীবনে তখন আরও একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, চলতি প্রথা ভেঙে এক ‘কালো’ বঙ্গললনা সমুদ্র থেকে স্নান সেরে উঠে, আরেক বাঙালি মেয়ের গাওয়া ‘জাদু হ্যায়, নশা হ্যায়’-এর মৌতাত ছড়িয়ে দিয়েছে আসমুদ্র হিমাচল। ছোটবেলায় দেখা রাজ কাপুরের সিনেমায় মন্দাকিনী বা জিনাত আমানের স্নানের দৃশ্য, অথবা ইদানীংকালে ‘দেবরা’ সিনেমায় জাহ্নবী কাপুরের স্নানের দৃশ্যের থেকে আগের দু’টি দৃশ্য আমার কাছে তাই অনেক বেশি জরুরি। পরের দৃশ্যগুলো যেন সেই মহাভারতের যুগে গোপিনীদের কাপড় চুরি করে শ্রীকৃষ্ণের লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের স্নান দেখার এক্সটেনশন মাত্র। ঠিক তেমনভাবেই আমার কাছে জরুরি ‘রিমঝিম গিরে শাওন’ গানে নায়ক-নায়িকার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সারা শহর জুড়ে ঘুরে-ঘুরে প্রেম করা। গানটাতে একটা সময় আর তার জিয়োগ্রাফি এমনভাবে ধরা রইল, যার দরকার কোনও দিন ফুরবে না। এই গানটার দৃশ্যায়নের কাছে কোন ছাড়, ‘জুবি ডুবি জুবি ডুবি পা পা রা’ কিংবা ‘জো হাল দিল কা, ইধার হো রহা হে’-এর মতো গানগুলোর দৃশ্য। একইরকম ভাবে ‘তাল’ সিনেমায় ‘দিল ইয়ে বেচ্যান হে’-এর থেকেও ‘সাইরাত’ সিনেমার শুরুর দিকে প্রেমে উথালপাথাল হয়ে নায়কের স্লো মোশানে এসে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে স্নান করার দৃশ্য আমার অনেক কাছের। প্রথমটাতে পিছনে রহমান বাজছে আর দ্বিতীয়টাতে অজয়-অতুল– দুটোতেই সেই অর্থে নায়কের মনে পূর্বরাগ জন্মেছে, কিন্তু আমি বাছব পরেরটাকেই।
ছোটবেলায় চমকে গিয়েছিলাম টিভিতে সুপ্রিয়া চৌধুরীর একটা স্নানের দৃশ্য দেখে। উত্তমকুমার ‘দেখুক পাড়া পড়শিতে’ গাইছে আর আমি লজ্জা পেয়ে পাশের ঘরে চলে এসেছি। ‘টাইটানিক’-এ গাড়ির ভিতর ঘামে স্নান করে যাওয়া জ্যাক আর রোজকে দেখেও একই রকম লজ্জা পেয়েছিলাম। দুটো দৃশ্য কত আলাদা, কিন্তু কোথাও যেন একটা বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো আমাকে একটু একটু করে টিনএজ হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এর পরে এসেছে, ‘হাম তুম’ সিনেমায় ‘সাঁসো কো সাঁসো মে ঢলনে দো যারা’, ‘ফানা’ সিনেমায় ‘দেখো না’, ‘ধুম’ সিনেমায় ‘দিলবারা’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-তে ‘কোয়ি লড়কি হ্যায়’, আরও কত কত বলিউডি গান– যেখানে বৃষ্টিতে স্নান করতে করতে নায়ক-নায়িকারা প্রেম করছে, নাচ করছে, মজা করছে, কিন্তু আমার মন চলে যায় বারবার কেন জানি না ওই একটা ‘শাওন বরসে, তরসে দিল’ গানটায়। বোধহয় গানটার মধ্যে একটা বিষণ্ণ বৃষ্টিস্নাত অপেক্ষা আছে তাই। আজীবন রথের দিন বৃষ্টি হবেই আর আমি এখনও এই ন্যালাখ্যাপা বড়বেলাতেও মেলায় না গিয়ে পুরনো বৃষ্টির গানের প্লে-লিস্ট খুলে বসব, ‘এক লড়কি ভিগি ভাগিসি’, ‘লাগি আজ শাওন মে’, ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’– র সঙ্গে থাকবে গরম গরম পিঁয়াজি আর ধোঁয়া ওঠা দুধ চা। আবার কখনও কখনও বা ‘ডিডিএলজে’-তে কাজল সাদা টাওয়েল পরে নাচবে অথবা অরিজিৎ সিং গাইবে ‘শাওন আয়া আয়া হ্যায়’ কিংবা ঐশ্বর্য ‘নান না রে, নান না রে’ করে বৃষ্টির জলে স্নান সারবে অবিরাম। একটু একটু করে আমার মন চলে যাবে ‘বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি, এ কোন অপরূপ সৃষ্টি’তে, তখন অবশ্য আমাদের বন্ধুদের হাতে উঠে এসেছে লাল লাল জাদু জল।
আমরা তখন একটু একটু করে ‘মাসান’ সিনেমার ভিকি কৌশলের মতো যে যার ‘না পাওয়ার নদী’-তে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোর ফেলে দেওয়া আংটিগুলো খুঁজতে শুরু করেছি। কেউ কেউ আবার ‘রং দে বসন্তি’ সিনেমার মতো লাফ মারছি অনেক অনেক ওপর থেকে নিচের অকুল জলের ভেতর। আমার কোনও দিনই ইচ্ছা করেনি ‘আশিকি’-র নায়কের মতো বৃষ্টি বাঁচিয়ে কোর্টের তলায় নায়িকাকে চুমু খেতে, বরং ‘বসন্ত বিলাপ’-এর চিন্ময়ের মতো প্রেমিকার সামনে ভয়ে ‘বাবা রে’ বলে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করেছে ভরা পুকুরের জলে। এমন করে প্রেমের পুকুরে যদি স্নানই না করলাম, তাহলে ব্যাপারটা আর জ্যান্ত হল কই? ওই স্মুথ সিন্থেটিক বলিউড যেন বাস্তবে ঘটার জন্য নয়।
শেষ করার আগে আমার দুটো প্রিয় স্নানের দৃশ্যের কথা বলে যাব, একটা জার্মানি ওয়েব সিরিজের আর দ্বিতীয়টি জগৎ বিখ্যাত এক বাংলা সিনেমার। প্রথমটার নাম হল ‘ডার্ক’। প্রথম সিজনে আমরা দেখি একদল টিনেজার একটা ঝিলে সবাই মিলে স্নান করতে নামে এবং সেখানে সবাই ওই জলের তলায় লুকিয়ে থাকা এক ডাইনিকে নিয়ে একটি মেয়েকে ভয় দেখায় এবং সেই নিয়ে সবার মধ্যে বেশ এক চোট হাসিঠাট্টাও হয়। গুরুত্বহীন দৃশ্য ভেবে আমরা সবাই বেমালুম ভুলেও যাই সেটা। চমক আসে শেষ সিজনে, দর্শক একে একে দেখে সেই ঝিলের অতীত, ওই মেয়েটির সঙ্গে সেই ভয় দেখানো ডাইনিটার সম্পর্ক এবং আমরা শিখি চিত্রনাট্যে আপাত অতি তুচ্ছ একটা ঘটনা কীভাবে কত জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয় সিনেমাটি হল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। শহরের চার বন্ধুর মধ্যে তিন জন যুবক বক্সার পরে কুয়োর জলে স্নান করতে আসে এবং দৃশ্যের মধ্যে গাড়ি করে ঢুকে পড়ে দুই নায়িকা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে তিনটির মধ্যে শুরু হয় এক চরম অস্বস্তি। পরিচালক সিনেমায় মেল ভয়েরিজমের গালে একটা ঠাস্ করে চড় কষান। আমরা এইসব জটিল ব্যাপার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধু ভাইবোনের বৃষ্টিতে স্নান করার একটা দৃশ্যের কথা ভাবতে থাকি আর পিছনে দেশ রাগ বাজতে থাকে। আমরা ভুলে যাই কিছুক্ষণ পরে এই কারণেই দিদিটা অসুখে পড়ে মরবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমবিদ্যালয়ের আশ্রমকন্যাদের অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেখানে আলাদা করে কোনও প্রহরী রাখতেও দেননি। মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে এতটাই মূল্য দিতেন তিনি। তাই চিত্রনিভার স্কেচ করতে যাওয়ার জন্য তিনি কোনও সীমানা নির্দেশ করেননি, ছবি আঁকার জন্য তিনি যতদূর খুশি যেতে পারতেন।