নতুন চাকরি পেলে, বাড়ির লোক তাকে একটা রসগোল্লা খাইয়ে মিষ্টিমুখ করাবেই। এক সময় বিয়ে-বউভাতে বাড়িতে খাওয়ার শেষপাতে কে ক’টা রসগোল্লা খেতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হত। বালতি ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এলে– ‘পুরোটাই পাতে ঢেলে দিন’– এমন আওয়াজ শোনা যেত। জামাই শ্বশুরবাড়ি আসার সময় জামাইয়ের হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি না থাকলে, কেমন যেন বেমানান মনে হবে! শালীদের কাছ থেকে বেরসিক, কিপটে এমন কথাও শোনা যেত। এমনকী, শ্মশানে শ্মশান-বন্ধুদের ‘জামাই-আদরে’ খাওয়ার বা খাওয়ানোর দৃশ্য চোখে পড়বেই। জন্ম থেকে মৃত্যু– সর্বত্র রসগোল্লা!
‘ম্যাজিক’ অর্থাৎ ভেলকি, যাদুবিদ্যা। ‘রসগোল্লা’ নামটা ম্যাজিকের মতোই– রস+গোল্লা, ‘রস’ হল মিষ্টি স্বাদযুক্ত তরল পদার্থ– তাকে কী করে গোল্লা করবেন? আবার ‘গোল্লা’ শব্দের একটি অর্থ শূন্য। শূন্য যদি সংখ্যায় লেখা হয়, তাহলে ‘০’ (শূন্য) লিখতে হবে। বৈদিক ঋষিগণ আবার অন্তরিক্ষ, অম্বর, গগন, নভঃ প্রভৃতি শব্দের একই অর্থ– আকাশ আর সংখ্যা ০ (শূন্য)। ‘গোল্লা’কে যদি শূন্য ধরা বা ফাঁকা ধরা হয়, তাহলে ‘রসগোল্লা’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় রসশূন্য! রসগোল্লা কী এক ম্যাজিকে ভ্যানিশ হয়ে গেল!
এবার হেঁয়ালির দুটো লাইন শোনাই:
‘রসিকের কাছে আছে রস।
গোল্লা করে তাকে বশ।।’
‘গোল্লা’ ক’রে অর্থাৎ, কোনও দ্রব্যকে গোলাকৃতি করে, রসে ডুবিয়ে, রসিক মানুষ যা সৃষ্টি করলেন, তাকে ‘রসগোল্লা’ মিষ্টান্ন বলা হল। ‘মিষ্টান্ন’– মিষ্টি+অন্ন থেকে এসেছে তাই, এর অর্থ মিষ্টিভাত বা পায়েস। তবে শুক্ল যজুর্বেদে ‘মিষ্টীকৃতনি’ অর্থে মধুর রসে সিক্ত দ্রব্যগুলিকে মিষ্টান্ন বলা হয়েছে। সুতরাং, রসগোল্লাকেও ‘মিষ্টান্ন’ বা ‘মিষ্টি’ বলা যাবে।
যে কোনও জিনিসের গোল্লা রসে ডোবালেই রসগোল্লা হয়ে যাবে! কি, বিশ্বাস হল না তো কথাটা? চলুন, দেখা যাক। চাল গুঁড়ো করে তার সঙ্গে দই মিশিয়ে ভালো করে মর্দন করে, আধ ছটাক পরিমাণ গোলাকৃতি করে ভেজে, ‘দুই তার বন্ধ’ চিনির রসে চালের ভাজা গোল্লা ডুবিয়ে রাখলে– চালের রসগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। আরও আছে। দুধ ঘন করে ক্ষীর গোল্লা পাকিয়ে ‘তিন তার রসে মগ্ন’ করলেই তৈরি হয়ে যাবে ক্ষীরের রসগোল্লা। আবার আমের রসগোল্লাও করা যাবে, আমের গোলা-রস দিয়ে ময়দা মেখে “গোলাকৃতি করে ঘিয়ে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে ‘আমের রসগোল্লা’ হয়ে যাবে!”
এমনই আরও ‘রসগোল্লা’ তৈরির প্রস্তুত প্রণালী ছাপা রয়েছে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘পাকরাজেশ্বর’ বইতে।
আমরা এখন ‘রসগোল্লা’-র ইতিহাস বলতে বুঝি, বড়পর্দার রসগোল্লা-র গল্পটি। এখানে রসগোল্লার স্রষ্টা হিসেবে বাগবাজারের নবীন দাসকে দেখানো হয়েছে। নবীন দাসকে নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে– ‘রসগোল্লার কলম্বাস– বাগবাজারের নবীন দাস।’
নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতে এসেছেন ভেবে আমেরিকার মাটিতে পদার্পণ করেন– আবিষ্কার হয় ‘আমেরিকা’। রসগোল্লার ক্ষেত্রেও তাই। রসগোল্লা ছিল নানা নামে, নানা রকমের। সেগুলির মধ্য থেকে আধুনিক স্পঞ্জ রসগোল্লার স্রষ্টা হিসেবে সম্মানিত হন নবীন দাশ। কিন্তু তিনি রসগোল্লার আবিষ্কারক নন। শ্রদ্ধেয় কিরণচন্দ্র দত্ত ‘বাগবাজার’ গ্রন্থে জানিয়েছেন– “পূর্বে রসগোল্লা ছিল– তার নাম ‘দানাদার-রসগোল্লা’, কোন কোন স্থলে ‘ডেলা রসগোল্লা’। নবীন স্পঞ্জ রসগোল্লা সৃষ্টি করিবার পূর্বেই যে যে দোকানে নবীন কার্য করিয়াছিলেন সেখানে ও অন্যান্য দোকানে রসগোল্লা নামে শক্ত দানাদার চিনি দিয়া ঢাকা বা ডেলা রসগোল্লা প্রস্তুত হইত। কিন্তু এই নূতন ভাবে প্রস্তুত অভিনব জমিদার রসগোল্লা সবেদা (চালের গুঁড়ো) ও ক্ষীর না মিশাইয়া, নবীনেরই সৃষ্টি। তিন বৎসর পূর্বে আরম্ভ করিয়া ১২৭৫ সালে (১৮৬৮ খ্রি.) রসসাগরে ভাসমান অসংখ্য জালিযুক্ত ও রস পরিপূর্ণ ছানার এই গোলক (স্পঞ্জ রসগোল্লা) সৃষ্টি করেন।”
…………………………
রানাঘাটের পালচৌধুরী জমিদারদের বাঁধা-ময়রা ছিলেন ফুলিয়ার হারাধন ময়রা। একদিন জমিদারবাড়ির মিষ্টি তৈরি করতে বসেছেন হারাধন ময়রা, এই সময় তাঁর শিশুকন্যা কাঁদছিল, তার কান্না থামাতে হারাধন হাতের ছানা গোল্লা করে চিনির রসে ছেড়ে দিলে নতুন একপ্রকার মিষ্টান্ন প্রস্তুত হল। এই নতুন মিষ্টি জমিদারবাবুর হাতে তুলে দিলে তিনি খেয়ে রসের গোল্লাকে ‘রসগোল্লা’ নামকরণ করলেন।
…………………………
তাহলে ছানার রসগোল্লা কে প্রথম আবিষ্কার করেছেন? রানাঘাটের পালচৌধুরী জমিদারদের বাঁধা-ময়রা ছিলেন ফুলিয়ার হারাধন ময়রা। একদিন জমিদারবাড়ির মিষ্টি তৈরি করতে বসেছেন হারাধন ময়রা, এই সময় তাঁর শিশুকন্যা কাঁদছিল, তার কান্না থামাতে হারাধন হাতের ছানা গোল্লা করে চিনির রসে ছেড়ে দিলে নতুন একপ্রকার মিষ্টান্ন প্রস্তুত হল। এই নতুন মিষ্টি জমিদারবাবুর হাতে তুলে দিলে তিনি খেয়ে রসের গোল্লাকে ‘রসগোল্লা’ নামকরণ করলেন।
………………………………………..
আরও পড়ুন ‘দই’ নিয়ে অম্বরীশ ভট্টাচার্য-র লেখা: আমাকে লাল দইয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে দেওয়া যেতে পারে
………………………………………..
এই অমৃতসম রসগোল্লা খেলে নাকি অপুত্রার পুত্র হয়, নির্ধনের ধন হয়, আর সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়! এসব সত্যিই হয় কি না জানি না, তবে অপুত্রার পুত্র হলে– নানা জনের এককথা– এবার ছেলে হয়েছে রসগোল্লা খাওয়াতে হবে কিন্তু! নির্ধনের ধনপ্রাপ্তি হয় মিষ্টান্নের ব্যবসায়ে। আর শেষ কথা সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়– একথা সত্য!
এই ধরুন, যে ছাত্রটি ভালো পরীক্ষা দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করলে, পাস করার পর সকলে বলল, রসগোল্লা খাওয়াতে হবে কিন্তু! যে-ছেলেটি সারা বছর ফাঁকি দিয়েছে, সে জানে আমি ফেল করবেই– রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি পৌঁছলে– চিৎকার ধ্বনিতে প্রতিধ্বনি হল– ‘এতগুলো সাবজেক্টে রসগোল্লা পেলি!’– কি, সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল না?
নতুন চাকরি পেলে, বাড়ির লোক তাকে একটা রসগোল্লা খাইয়ে মিষ্টিমুখ করাবেই। এক সময় বিয়ে-বউভাতে বাড়িতে খাওয়ার শেষপাতে কে ক’টা রসগোল্লা খেতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হত। বালতি ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এলে– ‘পুরোটাই পাতে ঢেলে দিন’– এমন আওয়াজ শোনা যেত। জামাই শ্বশুরবাড়ি আসার সময় জামাইয়ের হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি না থাকলে, কেমন যেন বেমানান মনে হবে! শালীদের কাছ থেকে বেরসিক, কিপটে এমন কথাও শোনা যেত। এমনকী, শ্মশানে শ্মশান-বন্ধুদের ‘জামাই-আদরে’ খাওয়ার বা খাওয়ানোর দৃশ্য চোখে পড়বেই। জন্ম থেকে মৃত্যু– সর্বত্র রসগোল্লা!
……………………………………
আরও পড়ুন ‘সন্দেশ’ নিয়ে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, একদলা সন্দেশ মিশিয়ে দিয়ে তাতে
……………………………………
রসগোল্লার মধ্য দিয়েই সচ্চিদানন্দ আনন্দ পাওয়া যায়– এমন কথা বলেছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তিনি কোন্নগরে হরিসভার অনুষ্ঠান শেষে প্রসাদ সেবার পর, মুখে একটি রসগোল্লায় কামড় দেওয়ার পর সমাধি লাভ করেন। সমাধিভঙ্গের পর কেন এমন হল, জিজ্ঞেস করতেই ঠাকুর বললেন, ‘রসগোল্লায় কামড় দেবার পর সেই রস ছিটকাইয়া যখন গলায় পরে তখন সেই রসবিন্দুতে ব্রহ্মানন্দ রসের অনুভব করিয়া সমাধিস্থ হইয়াছিলাম।’
রামচন্দ্র দত্ত নরেনকে বললেন, ‘তুই একবারটি ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বর চল, গেলে রসগোল্লা খাওয়াবো।’ রসগোল্লার টানে সেখানে গিয়ে নতুন আনন্দ-রসে ডুবে গেলেন! নরেন ধীরে ধীরে বিবেকানন্দ হয়ে গেলেন! এটা রসগোল্লার ম্যাজিক-টান নয়? আপনি কি বলেন?
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved