রাস্কিন বন্ডকে মাঝে মাঝে মনে হয় উদাসীন এক আশ্চর্য সন্ন্যাসী। কিংবা তাও যেন নয় ঠিক। কারণ, সন্ন্যাসী সব পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে হাঁটেন মুক্তির পথে। আর তিনি, রাস্কিন বন্ড এই পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গেই যেন আত্মীয়তা পাতান। তাঁর জীবন, তাঁর দর্শন উঠে আসে এই গাছপালা-মানুষ-প্রকৃতির মিলনক্ষেত্র থেকেই। তাই অনায়াসে তিনি পাঠককে বলতে পারেন– ‘If you are alone and with nothing to do, grow something’.
প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
তিনি লেখেন বৃষ্টিভেজা পাহাড়ের কথা। পাইন গাছের ডালে দোলা দেওয়া আলতো বাতাসের কথা। লিখে রাখেন হঠাৎ-ফোটা টকটকে লাল পপিফুল আর জানলার কাচে এসে ডানা ঝাপটানো হলদে পাখির গল্পও। শব্দের টানে জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে ওঠা-নামা করা নানারকম মানুষের প্রতিকৃতি আঁকেন যত্নে। আর এই সব ছোট ছোট দৃশ্যের মধ্যে থেকেই তুলে আনেন বিস্ময়কর সব মণিমুক্তো।
তিনি রাস্কিন বন্ড।
জীবনকে দেখেন ভারী স্বচ্ছ এক লেন্সের মধ্য দিয়ে, একেকটি আণুবীক্ষণিক মুহূর্তকেও সে লেন্সে বিশাল দেখায়, সুন্দর দেখায়। সুখ কাকে বলে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চলে যান একটি চেরিগাছের বর্ণনায়– যে কিনা রাত্রির বৃষ্টিতে নুয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ এক ধাক্কায় ঋজু হয়ে দাঁড়ায় আবার, লেখকের মুখে ছুড়ে দেয় পাতার ফাঁকে সঞ্চিত জলকণারাশি। ‘This, too, is happiness’– তৃপ্ত প্রত্যয়ে লেখেন তিনি।
একটা কাঠবিড়ালীর সঙ্গে কী করে তাঁর ভাব হল, কীভাবে সেটি তাঁর টেবিলে উঠে আসে খাবারের টুকরো খুঁজতে, সে প্রসঙ্গে বলেন– ‘‘I’m not looking for pets; it is enough that he seeks me out when he wants company.’’ ভাবি, সম্পর্ককে এমন সহজ চোখে কে বা কবে দেখেছেন আর?
দেরাদুন-মুসৌরি-ল্যান্ডোরের হিমালয় তাঁর প্রায় সমস্ত লেখার আবহে বেজেছে। লেখার নাম কখনও রেখেছেন ‘ওয়ন্স আপন আ মাউন্টেন টাইম’, কখনও ‘মাউন্টেন ইন মাই ব্লাড’। লিখেছেন পাহাড়ি অন্ধকারে ভেসে আসা পেঁচাডাক, প্যান্থারের গন্ধ পাওয়া ভীত হরিণের চিৎকারের কথা। ওক-দেবদারু-ওয়ালনাট গাছের সাহচর্যের কথা। লেখেন, ‘Some sounds cannot be recognized. They are strange night sounds, the sounds of the trees themselves, stretching their limbs in the dark, shifting a little, flexing their fingers. Great trees of the mountains, they know me well.’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘আ বুক অফ সিম্পল লিভিং’-এর ভূমিকায় লিখছেন একটি গাঁদাফুলের চারার কথা। একটা বাড়ির দেওয়ালের ফাটলে গজিয়ে ওঠা সেই চারাগাছটির দিকে আকস্মিকভাবেই নজর পড়েছিল রাস্কিন বন্ডের। গাছের গোড়া থেকে প্লাস্টারটুকু যত্নে সরিয়ে নেন তিনি, আর সেই ফাঁকা জায়গাটায় পরম মমতায় ভরে দেন মাটি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গাছেরা তাঁকে ভালো করে চেনে– এ উক্তি শুধু তাঁকেই মানায়। ছোটদের জন্য যখন কলম ধরেন ভারতের গাছপালা নিয়ে লেখার জন্য, দেখি শুধু পাহাড়ি গাছ নয়, বট-অশ্বত্থ-আম-মহুয়া সব গাছকেই কেমন হাতের তালুর মতো চিনে নিয়েছেন। শুধু সে গাছের ফুল কেমন, পাতা কেমন তার বর্ণনা নয়– এদেশের বিভিন্ন জনজাতির জীবনে তার ভূমিকা, এদেশের লোককথায় সেসব গাছের জড়িয়ে থাকার কথাও তাই তুলে এনেছেন অনায়াসে। বোঝা যায়, সংস্কৃতিগত ভাবে ভিন্ন পরিসরে জন্ম নিয়েও এদেশের আত্মার সঙ্গে আদ্যন্ত মিশে গিয়েছেন তিনি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: মারিও মিরান্ডার ছবির দেশে জনসংখ্যা খুব বেশি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘আ বুক অফ সিম্পল লিভিং’-এর ভূমিকায় লিখছেন একটি গাঁদাফুলের চারার কথা। একটা বাড়ির দেওয়ালের ফাটলে গজিয়ে ওঠা সেই চারাগাছটির দিকে আকস্মিকভাবেই নজর পড়েছিল রাস্কিন বন্ডের। গাছের গোড়া থেকে প্লাস্টারটুকু যত্নে সরিয়ে নেন তিনি, আর সেই ফাঁকা জায়গাটায় পরম মমতায় ভরে দেন মাটি। তারপর প্রতিদিন সকালে এসে জল দিয়ে গেছেন সেখানে। গাছও কথা রেখেছে– বড় হয়ে উঠেছে একটু একটু করে। মাঝে মাঝেই তার ডালে এসেছে ছোট্ট কমলা রঙের ফুল।
তাঁর লেখা পড়তে গেলে মনে হয়, রাস্কিন বন্ড আসলে এই কাজটিই করে গেছেন আজীবন, করে যাচ্ছেন। শুষ্ক দেওয়াল-ফাটলে যে পুষ্প-সম্ভাবনা অচিরেই শুকিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে মৃত্তিকার নরম প্রলেপ এনে দেওয়া। জলসিঞ্চন করে যাওয়া, অবিশ্রাম। পাঠকের মনে যাতে একটু একটু করে সৌন্দর্যচেতনার কুঁড়ি ধরে।
এই সৌন্দর্য, বস্তুত কোনও আরোপিত বিষয় নয়। রাস্কিন বন্ডের কাছে তা এক বৃহত্তর জীবনবোধেরই টুকরো, যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে পরতে পরতে মিশে থাকে মানুষের বেঁচে থাকা। সত্যি কথা বলতে, ‘সৌন্দর্যচেতনা’ বা ‘জীবনবোধ’-এর মতো শব্দগুলি তাঁর লেখা প্রসঙ্গে ব্যবহার করতে কুণ্ঠা হয়– কারণ, অমন ভারী ভারী শব্দ তিনি নিজে তো লেখেন না! তিনি যা-কিছু লেখেন, তা জলের মতো সহজ-সুন্দর। কোনও চাতুর্য ছাড়াই যা প্রবেশ করে পাঠকমনের ভিতরদালানে। জলের মতোই স্বচ্ছ, জলের মতোই জীবনদায়ী।
দেরাদুনে বড় হওয়া এই কিশোর কী করে যেন তুমুলভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলেন ভারতবর্ষকে। তাই মাঝে কিছুদিন ইংল্যান্ডে চলে গেলেও কয়েক বছরের মধ্যেই ফিরে আসেন ভারতে, এদেশকেই করে নেন তাঁর ঘরবাড়ি। কৈশোরে লেখা তাঁর প্রায়-আত্মজৈবনিক প্রথম উপন্যাস ‘রুম অন দ্য রুফ’-এ পাই সেই ছবি, যেখানে Rusty নামের অনাথ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হওয়ার প্রাকলগ্নে– ‘…the pulsating throb and tremor of the train trashing him away; away from India, from Somi, from the chaat shop and the bazaar; and he did not know why; except that he was lost and lonely…’
আর ইংল্যান্ডে গিয়ে? স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন হিমালয় পাহাড় সম্পর্কে– ‘Οnce you have lived with them for any length of time, you belong to them. There is no escape.’ ফলে, তিনি যে কিছু বছরের মধ্যেই ফিরে আসবেন ভারতে, পাহাড়ের কোলে– এ নেহাতই অনিবার্য ছিল বলে মনে হয়। এই যাপন যে খুব মসৃণ তা নয়। যেমন ‘ল্যান্ডোর ডেজ’-এ লিখছেন, ল্যান্ডোর-মুসৌরির সকাল মানে বেশিরভাগ দিনই কলে জল নেই, বিকেল পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি নেই, টেলিফোন বিকল। কিন্তু এক প্রবল বর্ষণদিনে বৃষ্টি থামায় যে-ই না সূর্য বেরিয়ে এল, সঙ্গে এল হলুদ প্রজাপতির ঝাঁক– এতেই যিনি খুশি হয়ে যেতে পারেন; ভাবতে পারেন সকালে বাইরে বেরতে না-পারার সব লোকসান পুষিয়ে গেল, তাঁকে দমিয়ে রাখে, সাধ্য কার?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ছায়ার নারীস্বরূপ কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাস্কিন বন্ডকে মাঝে মাঝে মনে হয় উদাসীন এক আশ্চর্য সন্ন্যাসী। কিংবা তাও যেন নয় ঠিক। কারণ, সন্ন্যাসী সব পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে হাঁটেন মুক্তির পথে। আর তিনি, রাস্কিন বন্ড এই পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গেই যেন আত্মীয়তা পাতান। তাঁর জীবন, তাঁর দর্শন উঠে আসে এই গাছপালা-মানুষ-প্রকৃতির মিলনক্ষেত্র থেকেই। তাই অনায়াসে তিনি পাঠককে বলতে পারেন– ‘If you are alone and with nothing to do, grow something’. ত্রিশ বছর আগে তাঁর পোঁতা হর্স চেস্টনাট গাছ আজ কীভাবে ফুলের উপহারে ভরিয়ে দিচ্ছে তাঁকে, শোনাতে পারেন সে গল্প। নিরুদ্বিগ্ন স্বরে বলতে পারেন, ‘Nothing like a hailstrom to clear the sky. Even as I write, I see a rainbow forming.’
মনে হয় সমস্ত উপন্যাসে, দিনলিপিতে, কবিতায়, ডায়রিতে আসলে তিনি একটিই লেখা লিখেছেন, লিখে চলেছেন। সে লেখার শুরু নেই। শেষ নেই। পৃথিবীর বুকে গাছের আদিম গন্ধের মতো গভীর সেই লেখা। তিনি রাস্কিন বন্ড, সে লেখার নির্জনতম লিপিকার।
কবির কোনও ভ্যানিটি ছিল না। যেখানে সেখানে বসে পড়তেন চায়ের ঠেকে। কেউ চাইলেই এক টুকরো কাগজে কোনও কবিতার লাইন লিখে দিতেন। তারপর সেটার কী হত, জানতেও চাইতেন না। এমনিই ছিল তাঁর সরল জীবন-যাপন। সেই প্রয়াত কবি অরুণ চক্রবর্তীকে নিয়ে এই বিশেষ স্মৃতিচারণা।