‘চরিত্রহীন’-এর ৫০০ পাতা পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। লেখা তবু ছাড়েননি! আবারও লিখলেন। কিন্তু ছাপতে দিতে চাননি। প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে রেঙ্গুন থেকে লিখছেন– “‘চরিত্রহীন’ তোমাকে পড়তে দিতে পারি কিন্তু মুদ্রিত করবার জন্য নয়। এটা চরিত্রহীনের লেখা ‘চরিত্রহীন’– তোমাদের সুরুচির দলের মধ্যে গিয়ে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়বে– তা ছাড়া অত্যন্ত অশোভন দেখাবে।” ১৭ জানুয়ারি ‘শরৎ সমিতি’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রয়াণ দিবসের ভাষণ দিলেন নলিনী বেরা। ভাষণটি প্রকাশিত হল রোববার.ইন-এ।
আজ বলতে দ্বিধা নেই, বরং বলতে ভারি ইচ্ছাই হচ্ছে যে, আমার প্রথম ‘শরৎচন্দ্র-পাঠ’ পি. কে. দে সরকারের ‘এ টেক্সট বুক অব হায়ার গ্রামার, কম্পোজিসন অ্যান্ড ট্রান্সলেসন’ বই থেকেই। কথাটা বালখিল্যসুলভ শোনালেও বাস্তবিক সত্য। শৈশবে, কি গ্রামে কি দু’-তিন মাইল দূরবর্তী স্কুলে, পাঠ্যপুস্তক ব্যতিরেকে একটা আস্ত গল্প কি উপন্যাস হাতে পাওয়া নিতান্তই দুরূহ ছিল! তার কারণ এক নম্বর অশিক্ষা। তদুপরি ভৌগোলিক অবস্থা।
গ্রামে একজনও নিদেনপক্ষে মেট্রিক পাশ ছিল না। ওই বড়জোর থ্রি-ফোর পাস। তা বলে গ্রামে কী আর বই আসত না? হাট-ফেরত বাঁকে করে ঝুলতে ঝুলতে একদিকে আসত কলমি শাকের আঁটি, আরেকদিকে লাল শালুতে মোড়া ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘বৃহৎ লক্ষীচরিত্র’, ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’, কখনও সখনও ‘বাৎস্যায়ণের কামশাস্ত্র’। আর তারপর থেকে বেশ ক’-মাস ওই বই নিয়েই গ্রামজুড়ে টানা-হিঁচড়ানো, গুজগুজ, ফুসফুস, গুঞ্জন, গান– ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বুঝে কি আনজনে’–!
সত্যরঞ্জন, ডাকনাম ‘টুম্পা’। গরু চরায়, অনেক বড় অবধিই সে ‘ন্যাংটা ভুটুং’। তার বড় বউদি একদিন আমারই সামনে তার ওই, ওই জিনিসটা নেড়ে দিয়ে বলল, ‘কী গো দেওর, রস যে গড়িয়ে পড়ছে!’ বলা বাহুল্য, ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে আমাদের দু’জনেরই অ্যাডোলেসেনস্। আর, গরুবাগাল সত্যরঞ্জনের না হোক আমার ‘পি. কে. দে সরকার’। পি. কে. দে সরকারের ‘এ টেক্সট বুক অব হায়ার গ্রামার, কম্পোজিশন অ্যান্ড ট্রান্সলেশন’ বইয়ে ট্রান্সলেশন তো ট্রান্সলেশন, এহো বাহ্য ‘সাহিত্য পাঠ’!
ওই যে বাংলায় একেকটা অনুচ্ছেদ, নিম্নে ইংরাজিতে অনুবাদ– ইংরেজি যেমন-তেমন, ওই বাংলাটা! বাংলার ওই টুকরো-টাকরাই যা মেরে যেত আমার অন্তরে, মোক্ষম ঘা! নাড়িয়ে দিত সত্যরঞ্জনের– ওই, ওই– জিনিসটা নয়, আমার ভিতরের কলকবজা, অন্তর ব্রহ্মাণ্ড! কী অসাধারণ কথাংশ– ‘‘একদিন সে তাহারই মতো একজন দরিদ্রকে কাছে পাইয়া বলিল, ‘এখানে খাও কি করিয়া?’ সে বলিল, ‘চাকরি করিয়া খাটিয়া খাই। কলিকাতায় রোজগারের ভাবনা কি?’ সুরেন্দ্র বলিল, ‘আমাকে একটা চাকরি করিয়া দিতে পার?’ সে বলিল, ‘তুমি কি কাজ জান?’ সুরেন্দ্রনাথ কোন কাজই জানিত না, তাই সে চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল।’’
অথবা, ‘‘অকস্মাৎ ইন্দ্র সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ‘আমি যাব।’ আমি সভয়ে তাহার হাত চাপিয়া ধরিলাম– ‘পাগল হয়েছ ভাই।’ ইন্দ্র তাহার জবাব দিল না। একটা বড় ছুরি পকেট হইতে বাহির করিয়া বাঁ-হাতে লইয়া কহিল, ‘তুই থাক, শ্রীকান্ত। আমি না এলে ফিরে বাড়িতে খবর দিস্– আমি চললুম।’ তাহার মুখ পান্ডুর, কিন্তু চোখ দুটি জ্বলিতে লাগিল। তাহাকে আমি চিনিয়াছিলাম। আমি নিশ্চয় জানিতাম, কোন মতেই তাহাকে নিরস্ত করা যাইবে না– সে যাইবেই। ভয়ের সহিত চির-অপরিচিত তাহাকে আমিই বা কেমন করিয়া বাধা দিব।’’
কোন গল্প বা উপন্যাসের অংশ, লেখক কে– কিছুই জানতাম না। মুদ্রিত অংশটুকু বারবার পড়তাম, বারবার! মন ছটফট করত– কখন কবে ‘সমগ্র’টা পড়তে পারব! তারপর একদিন অকস্মাৎ যেন আমাদের পড়ার টেবিলে আমারই ঠিক পিঠের কাছে একটা ‘হুম্’ শব্দে আছড়ে পড়ল ‘ছিনাথ বউরূপী’! এখনও লাইনগুলো হুবহু মুখস্ত আছে–
‘‘সে দিনটা আমার খুব মনে পড়ে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত হইয়াও শেষ হয় নাই। শ্রাবণের সমস্ত আকাশটা ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া আছে, এবং সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে। সকাল সকাল খাইয়া লইয়া আমরা কয় ভাই নিত্য প্রথামত বাইরে বৈঠকখানায় ঢালা-বিছানার উপর রেড়ির তেলের সেজ জ্বালাইয়া বই খুলিয়া বসিয়া গিয়াছি। বাহিরের বারান্দায় একদিকে পিসেমশাই ক্যাম্বিশের খাটের উপর শুইয়া তাঁহার সান্ধ্যতন্দ্রাটুক উপভোগ করিতেছেন, এবং অন্যদিকে বসিয়া বৃদ্ধ রামকমল ভট্চার্য আফিং খাইয়া, অন্ধকারে চোখ বুজিয়া, থেলো হুঁকায় ধূমপান করিতেছেন। দেউড়িতে হিন্দুস্থানী পেয়াদাদের তুলসীদাসী সুর শুনা যাইতেছে….”
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: মৃত তারার সন্তান ও একটি সুইসাইড নোট
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
প্রতিটি বাক্য প্রতিটি শব্দ যেন পাথর কুঁদে কুঁদে তৈরি, ওজন করে মেপে মেপে বসানো। কাহিনিটি ‘শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী’ নামে ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকায় প্রথম ছাপা হচ্ছিল। প্রথম দু’মাসের লেখক ‘শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা’। পরের দু’মাস ‘শ্রীশরচ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’। তারপর থেকে বরাবর ‘শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’। ছাপতে দিয়েও লেখকের অতৃপ্তি, খুঁতখুঁতানি, ছদ্মনাম ধারণ। পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হরিদাস চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে জানান–
“‘শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী’, যে সত্যই ‘ভারতবর্ষে’ ছাপিবার যোগ্য আমি তাহা মনে করি নাই– এখনও করি না।… বিশেষ তাহাতে গোড়াতেই যে সকল শ্লেষ ছিল, সে সকল যে কোন মতেই আপনার কাগজে স্থান পাইতে পারে না, সে ত জানা কথা।”
“আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারি নাই।”
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘চরিত্রহীন’-এর ৫০০ পাতা পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। লেখা তবু ছাড়েননি! আবারও লিখলেন। কিন্তু ছাপতে দিতে চাননি। প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে রেঙ্গুন থেকে লিখছেন– “‘চরিত্রহীন’ তোমাকে পড়তে দিতে পারি কিন্তু মুদ্রিত করবার জন্য নয়। এটা চরিত্রহীনের লেখা ‘চরিত্রহীন’– তোমাদের সুরুচির দলের মধ্যে গিয়ে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়বে– তা ছাড়া অত্যন্ত অশোভন দেখাবে।” ‘দেবদাস’ প্রসঙ্গে ফের ‘ভারতবর্ষ’-এর কর্তৃপক্ষ প্রমথ নাথকে, ‘‘‘দেবদাস’ নিয়ো না, নেবার চেষ্টাও করো না। ঐ বইটা একেবার মাতাল হইয়া বোতল বোতল খাইয়া লেখা। ওটার জন্য আমি নিজেও লজ্জিত। ওটা ‘ইম্মরাল’। বেশ্যা চরিত্র ত আছেই; তাছাড়া আরও কি কি আছে বলে মনে হয় যেন।”
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
জীবনে তিনি কী এমন ‘কুৎসিৎ-আচার’ করেছেন যে রেঙ্গুন থেকে বিভূতিভূষণ ভট্টকেও লিখছেন, “পরম কল্যাণীয় পুঁটুভায়া,–
বুঝিতে পারি যে, আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব সকলেরই আমি ঘৃণার পাত্র। এ বোঝা যে কত মর্মান্তিক তাহা বলিলে লোকে বিশ্বাস করিবে না। জানি, বিশ্বাসের কোন রাস্তা আমি রাখি নাই– চিরপ্রবাসী, দুঃখী, কুৎসিৎ-আচারী আমি কাহারো সম্মুখে বাহির হইতে পারিব না, কিন্তু পুঁটু, সমস্তটাই কি আমার নিজের হাতে গড়া? আমার ঘুড়ির নীচে ভার নাই, আমার তীরের মাথায় ফলা নাই, আমার নৌকায় হাল নাই– এখন সোজা চলিতেছি না বলিয়া যে ধিক্কার দিয়া দু-হাত দিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছ, তাহার সবটাই কি আমার দোষে? সাধু সাজিতেছি না ভাই– এত পঙ্কিল জীবনে সাধুত্বের ভান খাটিবে না– কিন্তু তোমরা ত ভাল, তবে তোমরাই বা এত নিষ্ঠুর হইলে কেন?”
পঙ্কিল জীবন? শরৎচন্দ্রের জীবনী আমরা যতটুকু জানি ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬। হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্ম। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। ডাক নাম ‘ন্যাড়া’। হাতে খড়ি প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায়। তারপর পিতার বিহারে ডিহ্রিতে চাকুরি। ভাগলপুরে মাতুলালয়ে বসবাস। ফের দেবানন্দপুরে প্রত্যাবর্তন। হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ‘ফার্স্ট’ ক্লাসের ছাত্র। পিতার আর্থিক অনটনে পড়া বন্ধ। আবার ভাগলপুর। বাঁধো গাঁঠ্রি চলো মুসাফির! তেজনারায়ণ, জুবিলী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ। ডিকেন্সের ‘এ টেল অব্ টু সিটিজ’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, লর্ড লিটনের ‘মাই লাভ’ পড়ে ফেললেন। প্রকাশ করলেন হাতে-লেখা পত্রিকা ‘শিশু’। লিখলেন গল্প ‘কাকবাসা’ ‘কাশীনাথ’। মা মারা গেলেন ১৮৯৫-এ। পরের বছরই দেবানন্দপুরের বসতবাটি বিক্রি। ভাগলপুরের খঞ্জরপুরে নিরূপমা দেবী ওরফে ‘বুড়ী’ ও তার ভাই বিভূতিভূষণ ভট্ট ওরফে পুঁটুর সঙ্গে ঘনিষ্টতা। তদুপরি প্রতিবেশী রাজেন্দ্রনাথ মজুমদার ওরফে ‘রাজু’ র দুরন্তপনায় নিত্যসঙ্গী। যে কী না ‘শ্রীকান্ত’-এর ‘ইন্দ্রনাথ’। শরৎচন্দ্র গাইতেন, তবলা ও বাঁশি বাজাতেন, অভিনয় করতেন, মেয়ে সাজতেন। মিসেস হেনরি। উডের ‘ঈস্টলিন’ ও মেরি করেলির ‘মাইটি এটম’-এর ভাবালম্বনে লিখলেন যথাক্রমে উপন্যাস ‘অভিমান’ আর ‘পাষাণ’। চাকরি করলেন গোড্ডায় রাজ বনালী এস্টেটে। সাঁওতাল পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসে। চাকরি ছাড়লেনও। তারপর তো তাঁবুতে তাঁবুতে, শ্মশানে-মশানে! পিতার উপর অভিমানে নিরুদ্দেশ যাত্রা, নাগাসন্ন্যাসীদের পাল্লায় পড়া। তার মধ্যেই ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’, ‘কোরেল’, ‘চরিত্রহীন’ লিখে যাওয়া। পিতার মৃত্যুতে ভাগলপুরে প্রত্যাবর্তন। তারপর চাকুরি নিয়ে রেঙ্গুন।
‘চরিত্রহীন’-এর ৫০০ পাতা পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। লেখা তবু ছাড়েননি! আবারও লিখলেন। কিন্তু ছাপতে দিতে চাননি। প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে রেঙ্গুন থেকে লিখছেন– “‘চরিত্রহীন’ তোমাকে পড়তে দিতে পারি কিন্তু মুদ্রিত করবার জন্য নয়। এটা চরিত্রহীনের লেখা ‘চরিত্রহীন’– তোমাদের সুরুচির দলের মধ্যে গিয়ে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়বে– তা ছাড়া অত্যন্ত অশোভন দেখাবে।” ‘দেবদাস’ প্রসঙ্গে ফের ‘ভারতবর্ষ’-এর কর্তৃপক্ষ প্রমথ নাথকে, ‘‘‘দেবদাস’ নিয়ো না, নেবার চেষ্টাও করো না। ঐ বইটা একেবার মাতাল হইয়া বোতল বোতল খাইয়া লেখা। ওটার জন্য আমি নিজেও লজ্জিত। ওটা ‘ইম্মরাল’। বেশ্যা চরিত্র ত আছেই; তাছাড়া আরও কি কি আছে বলে মনে হয় যেন।” এই যে অপরাধ বোধ, মাঝে মাঝেই চারিত্রিক টানাপোড়েন, বারেবারেই নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, ভবঘুরে, বাউন্ডুলে, জুয়াড়ি-গাঁজাড়ি বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো পলাতক-বিপ্লবীদের সঙ্গে ওঠা-বসা, তদুপরি নারী চরিত্র চিত্রণ তা যেন শরৎচন্দ্রকে কালজয়ী রুশ সাহিত্যিক ‘ফিওদশ দস্তয়েভস্কি’র সমগোত্রীয় করে তুলেছে। বলতেই হয়, ‘বাংলা সাহিত্যের দস্তয়েভস্কি শরৎচন্দ্র’! হাইতি দ্বীপের নিগ্রো অধিবাসীরা গল্প-বলিয়ে ‘রিচার্ড লুই স্টিভেনসন’কে বলত ‘টুসি টালা’ অর্থাৎ Story Tellar, কেউ কেউ শরৎচন্দ্রকেও বলতে চান ‘টুসি টালা’। কিন্তু তিনি কি কেবলই Story Tellar? সেকথা মানলে তাঁর প্রতি নিদারুণ অবিচার করা হয়। ‘বড়দিদি,’ ‘বিরাজবউ’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘পণ্ডিতমশাই’। সর্বোপরি ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস হিসাবে অতুলনীয়। উপন্যাস আধুনিক যুগের সমান্তরাল ইতিহাস হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছে। শরৎচন্দ্রের তাবত উপন্যাসই সমাজ বাস্তবতাকে বিধৃত করেছে। ‘শ্রীকান্ত’ তো বিশ্বসাহিত্যে জায়গা করে নেওয়ার মতোই উপন্যাস। সেরভেন্তেসের ‘দন কিহোতে’ লরেন্স স্টার্নের ‘ট্রিসট্রাম শ্যান্ডি’ কি দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট’-এর কাছাকাছিই রাখব ‘শ্রীকান্ত’ কে। যেন এক রূপকথার ‘জার্নি’, অশেষ যাত্রা।
আর ‘মহেশ’ ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ তো পৃথিবীর যে কোনও দেশের সেরা ছোটগল্পের সঙ্গেই তুলনীয়। কী নেই শরৎচন্দ্রের গল্পে? বাস্তববাদী ‘প্লট’ জাদুকরী ভাষা, ‘স্যাটায়ার’, সম্পর্কের জটিলতা, প্রেম-অপ্রেমের তির্যকতা, এমনকী, আধুনিক সাহিত্যের লক্ষণ যে ‘অ্যালিনিয়েশন’, নিঃসঙ্গতা বা বিচ্ছিন্নতাবোধ– তাও যেন উপস্থিত। সর্বোপরি তাঁর দরদি মন। আমার সর্বোচ্চ ভালোলাগার জায়গাটুকুও যেন ওই।
“গ্রামের নাম কাশীপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু, দাপটে তাঁর প্রজারা ঢুঁ শব্দটি করিতে পারে না– এমনই প্রতাপ।
ছোটছেলের জন্মতিথি পূজা। পূজা সারিয়া তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় বাটী ফিরিতেছিলেন। বৈশাখ শেষ হইয়া আসে, কিন্তু মেঘের ছায়াটুকু কোথাও নাই, অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে।
সম্মুখের দিগন্ত জোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মতো তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিম ঝিম করে– যেন নেশা লাগে।
ইহারই সীমানায় পথের ধারে গফুর জোলার বাড়ি। তাহার মাটির প্রাচীর পড়িয়া গিয়া প্রাঙ্গন আসিয়া পথে মিশিয়াছে এবং অন্তঃপূবের লজ্জা সম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে।”
যেন শুরু হয়ে গেল শরৎচন্দ্রের ‘সাব-অলটার্ন’ যাত্রা। রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখেও বলছি, এর আগে এমন করে প্রান্তিক মানুষদের ছবি আর কে-ই বা এঁকেছেন!
‘‘বিঘে-চারেক জমি ভাগে করি, কিন্তু উপরি উপরি দু’সন অজন্মা– মাঠের ধান মাঠে শুকিয়ে গেল– বাপ-বেটিতে দু’বেলা দুটো পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পাইনে। ঘরের পানে চেয়ে দেখ বিষ্টি-বাদলে মেয়েটাকে নিয়ে কোণে বসে রাত কাটাই, পা ছড়িয়ে শোবার ঠাঁই মেলে না। মহেশকে একটিবার তাকিয়ে দেখ, পাঁজরা গোনা যাচ্ছে–’।
আশ্চর্য হই, যখন ভাষাবিদ অধ্যাপক সুকুমার সেন মহাশয়ও ‘মহেশ’ গল্পটির উৎস সন্ধানে শরৎচন্দ্রের উপর রবীন্দ্রনাথের ‘চৈতালী’র সনেট ‘পুঁটু’ কবিতার প্রভাবের কথা বলেন। পাঠককে পাতা উল্টে দেখতে বলি শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ (১৯২৬) গল্পটি, আর স্মরণ করিয়ে দিই রবীন্দ্রনাথের চৈতালী’র (১৩০৩) সনেট ‘পুঁটু’।
“চৈত্রের মধ্যাহ্নবেলা কাটিতে না চাহে
তৃষাতুরা বসুন্ধরা দিবসের দাহে।
হেনকালে শুনিলাম বাহিরে কোথায়
কে ডাকিল দূর হতে, “পুঁটুরাণী আয়।”
জনশূন্য নদীতটে তপ্ত দ্বিপ্রহরে
কৌতূহল জাগি উঠে স্নেহ কন্ঠ সুরে।
গ্রন্থখানি বন্ধ করি উঠিলাম ধীরে,
দুয়ার করিয়া ফাঁক দেখিনু বাহিরে।
মহিষ বৃহৎকায় কাদামাখা গায়ে
স্নিগ্ধনেত্রে নদীতীরে রয়েছে দাঁড়ায়ে।
যুবক নামিয়া জলে ডাকিছে তাহায়
স্নান করাবার তরে, “পুঁটুরানী আয়”।
হেরি হেন যুবারে, হেরি পুঁটুরানী তারি
মিশিল কৌতুকে মোর স্নিগ্ধ সুধাবারি।।
কবিতাটির রচনাকাল ২৩ চৈত্র, ১৩০২ সাল। (এখানে বলে দিই শরৎচন্দ্রের গল্পের শীর্ষকটির আসল মানে ‘মোষ’।) বক্তব্যটি সন্দেহজনক। যুক্তিটা আদৌ যুক্তিযুক্তও নয়, বরঞ্চ হাস্যকর। পল্লিবাংলায়, কি তখন কি এখনও, প্রিয় ছেড়ি-ছাগল গরু-মোষ ইত্যাদি পোষ্যের নামকরণ করা হয়। যেমন ‘কালাপাহাড়’ ‘আদরিনী,’ ‘পুঁটুরানী’ ‘মহেশ’। তা বলে ‘মহেশ’ কখনওই ‘মোষ’ নয়। মহেশ ‘শ্রেষ্ঠ দেবতা’, শিব। “কুচ যুগ কনক,– মহেশ সম জানিয়ে’– গো। গ্রামাঞ্চলে বলদের ‘কুঁদ’কে বলে ‘শিব’। ‘বাশুয়া বলদ’-কে শিবজ্ঞানে পূজা করা হয়। গফুর তার বলদকে আদর করে ‘মহেশ’ নামে তাকাতেই পারে। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কিন্তু মহিষের নাম ‘মহেশ’ অর্থাৎ শিব রাখলে শুদ্ধতার হানি ঘটে বইকি। ‘মহিষ’ তো যমের বাহন! তাকে ‘শিব’ বানালে চলে? “ঘোর নাদৈঃ প্রবিশতি মহিষঃ”।
‘ভাঙা প্রাচীরের গা ঘেঁষিয়া একটা পুরাতন বাবলাগাছ– তাহার ডালে বাঁধা একটা ষাঁড়।’ ‘ষাঁড়’ শব্দটি শ্রবণে ও পঠনে কোনও কোনও সমালোচক উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন। শরৎচন্দ্রের আমলে কি ‘ষাঁড়’ দিয়েই চাষাবাদ হত? নিশ্চয়ই হত না। কেননা ধর্মের ষাঁড় ‘শিব’। তার অণ্ডকোষ কেটে ‘হেলে’ বা হালের বলদ করা হয় না। সে যার-তার খায়, স্বাধীনভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেরায়। গোহালের দড়িতে সে কখনওই বাঁধা পড়ে না। গফুরের ‘মহেশ’ ষাঁড় নয়, হেলে-বলদই। ‘গরুটার জন্যেও এক আঁটি এক আঁটি ফেলে রাখতে নেই? ব্যাটা কসাই!’ কিংবা, ‘যেমন চাষা তার তেমনি বলদ। খড় জোটে না, চাল-কলা খাওয়া চাই!’ অথবা ‘মহেশ, তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আটসন প্রিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস, তোকে আমি পেটপুরে খেতে দিতে পারিনে– কিন্তু, তুই ত জানিস তোকে আমি কত ভালবাসি।’
অলমেন ইতি। পরিশেষে বলি, সারাজীবন ‘ছি-ছিক্কার’-এর মতো সমগ্র শরৎ সাহিত্যে এক প্যাথোস যেন রিন্ রিন্ করে বেজে চলে। চিরপ্রেমী চিরশিল্পী শরৎচন্দ্রের জীবন গবাক্ষ পথে ‘দেবদাস’-এর মতোই যেন একটা ‘করুণার্দ্র স্নেহময়’ সুর ভেসে আসে–
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে–