আমরা যারা ফ্যান, শুধু আমরাই জানি, শেষ ক’টা বছর আমরা কেমন ছিলাম। প্রত্যেকবার কী শূন্য লাগত হল থেকে বেরিয়ে! ‘হ্যারি মেট সেজাল’-এর শেষে পাথর হয়ে বসে থেকেছি, শরীর নিয়ে বাইরে বেরতে, মোবাইলে উত্তর দিতে ‘কেমন হয়েছে’, মিথ্যে বলার জোরটা পর্যন্ত চলে গেছিল। কিন্তু শাহরুখের মতো বুক চিরে ‘কিরণ’ না লিখলেও,আমাদের বুকের ভেতর একটা গোটা দেশ রয়েছে ওর নামে।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
আসল কারণ কী জানেন? লোকটাকে অনেকগুলো মানুষ ভালোবাসে। যখন ঘৃণার ব্যবসায়ীরা ঢোল-কত্তাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে, তখন এই লোকটা যে আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছে, তা আমরা একদিনের জন্যও ভুলিনি। তাই এই বছরের ২ নভেম্বর আমাদের প্রত্যেকের। আমরা, যারা ওঁর সিনেমা রিলিজের দিন দোল খেলি, একসঙ্গে অনেকগুলো টিকিট কেটে পইতের মতো গলায় জড়িয়ে ছবি তুলি, অথবা কাজের চাপে যাওয়া হয়নি ওপেনিং ডে, কিন্তু মন পড়ে গুরুর থানে, মাঝখান থেকে প্রেজেন্টেশন পুড়ে যায়– এমন সবার। আমরা যারা ফ্যান, শুধু আমরাই জানি, শেষ ক’টা বছর আমরা কেমন ছিলাম। প্রত্যেকবার কী শূন্য লাগত হল থেকে বেরিয়ে! ‘হ্যারি মেট সেজাল’-এর শেষে পাথর হয়ে বসে থেকেছি, শরীর নিয়ে বাইরে বেরতে, মোবাইলে উত্তর দিতে ‘কেমন হয়েছে’, মিথ্যে বলার জোরটা পর্যন্ত চলে গেছিল। কিন্তু শাহরুখের মতো বুক চিরে ‘কিরণ’ না লিখলেও,আমাদের বুকের ভেতর একটা গোটা দেশ রয়েছে ওর নামে। তাই জানতাম আবার আমরা এমন একটা ২ নভেম্বর পাবো, যেদিন আমরা জাবড়া ফ্যান চালিয়ে খুলে নাচতে পারব, গুরুই ফিরিয়ে দেবে সেই ২ নভেম্বর। আজ সেই দিন।
লতা মঙ্গেশকরের প্রিয় দু’জন অভিনেতার নাম দিলীপ কুমার এবং শাহরুখ খান। সুরের সম্রাজ্ঞী নিজে একাধিক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন। তাঁর দেহাবসানের পর শাহরুখ উপস্থিত হলেন, দোয়া করলেন নিজের ধর্ম মেনে। চারদিকে রটে গেল, তিনি নাকি থুতু দিয়েছেন সম্রাজ্ঞীর শরীরে। শাহরুখকে ঘিরে যা ঝড় এই কয়েকটা বছর গেছে, তার সামনে এ যদিও কিছুই নয়। কিন্তু শাহরুখ একবারের জন্যও আত্মপক্ষ সমর্থনে বেরিয়ে আসেননি। নীরবে কাজ করে গেছেন। আমি একজন বাবা, আমি জানি, সন্তানের সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে গেলে নিজের শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়। সেখানে ছেলের জেল, বুকের ভেতর বাজবে না একজন বাবার? বাবার তো কোনও গরিব-বড়লোক হয় না। কিন্তু সেই সময় ও অত ঝড়ের মধ্যে অবিচল থাকার যে উদাহরণ তিনি রেখেছেন, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটা শিক্ষা।
শাহরুখ কিন্তু আজ আর শুধু সিনেমার তারকা নন। তাঁর সাক্ষাৎকার আজ অনেকের এগিয়ে চলার রসদ। তাঁর মহিলাদের প্রতি যে সম্ভ্রম, তা থেকে শিক্ষা যদি কয়েকজন ফ্যানও নেয় তা-ই বা কম কী? শাহরুখ কেমন অভিনেতা, তা নিয়ে অনেক মত থাকতে পারে। কিন্তু শাহরুখ যে ‘গ্লোবাল আইকন’ তা অস্বীকার করবে কে? এবং তা শুধু অভিনয় করে সম্ভব নয়। আমি তো অন্তত কোনও চিত্রতারকাকে সেই সময় বা পরেও পুরস্কার নিতে উঠে অমর্ত্য সেনকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন দেখিনি, কারণ সেসময় অমর্ত্য সেন ক’দিন আগে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। ভারসাচে আর গুচির বলিউডে তাই তিনি এক বিরল ব্যতিক্রম। শাহরুখ যেভাবে নিজের কাছের মানুষদের আগলে রাখেন, তা-ই বা ক’জন পারে। শাহরুখের দিদি বাবা-মা পরপর চলে যাওয়ার অভিঘাত সামলাতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারান। এই দুঃখগুলো আমার-আপনারই মতো। তাঁকে আগলে রেখেছেন একজন ভাই। কোনও চিত্রতারকা নন।
আমরা যারা বারবার হেরে যাই, তাদের জিতে যাওয়ার আরেক নাম শাহরুখ খান। তাই শাহরুখের হেরে যাওয়া আমাদের কাছে ব্যক্তিগত ক্ষতি। আমরা যারা নিখুঁত নই, তেমন তালেবর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই কোনও, তাদের একটা স্বস্তির বারান্দার নাম শাহরুখ খান। কারণ তাঁকে দেখে আমরা শিখেছি সব নায়ক নিখুঁত হয় না। আমরা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর রামাধিরের ভাষায় ‘বোকা’, কারণ আমরা শাহরুখের পর্দার প্রেমে বয়ে গেছি। কিন্তু বোকা হয়েই যদি বেশি মজা পাওয়া যায়, তখন খামোকা কাঠের মতো চালাক হতে যাব কেন, সে-ই বরং বেশি আহাম্মক আমার কাছে।
তাই আজ আসলে আমাদের কাছে এক আলোর জন্মদিন। যে আলো আমাদের প্রজন্মকে দিনের পর দিন বুঝিয়েছে, ‘কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।’ একদিন আমার বয়স হলে, সহজ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, শাহরুখ তোমায় কী দিয়েছিল– আমার ঘোলাটে চোখ অনেকগুলো দৃশ্য ভাবতে ভাবতে হয়তো বলবে– ‘মুহূর্ত, আর কী চাই?’