বাংলা ভাষায় আমরা যেসব আত্মচরিত পড়ে এসেছি তার বেশিরভাগই খুব অকপট নয়। সেখানে লেখকের জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতার কথা থাকলেও অপমান, লাঞ্ছনা বা প্রতিহিংসার অন্ধকার দিকগুলির কথা বড় একটা লেখা হয় না। সামাজিক অবস্থানজনিত কারণেই হয়তো লেখা থাকে না বৃষ্টি আর ভিজে ঘাসের গন্ধে মাখামাখি হয়ে যাওয়া যৌন অভিজ্ঞতাগুলির কথা। আজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিনে তাঁর আত্মকথাগুলো নিয়েই কথা বলা যাক।
আজ কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন। যদিও এই ‘মৃত্যুদিন’ কথাটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যতটা যায়, শ্যামলদার মতো সৃষ্টিশীল এবং সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষের বেলায় তা একেবারেই যায় না। কারণ সাধারণ মানুষেরা মারা গেলে তাদের শরীর হয় আগুনে পুড়ে, নইলে ঝুরো ঝুরো খেঁসকুটে মাটিতে চাপা পড়ে এক লহমায় ভ্যানিস। কিন্তু ক্রিয়েটিভ মানুষদের পার্থিব শরীর নষ্ট হয়ে গেলেও, তাঁদের সৃষ্টিরা চিরকাল বেঁচেই থাকে। সেইসঙ্গে তাঁরাও থাকেন অমর হয়ে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সে-ই মায়েস্ত্রো, যিনি তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প, বাজার সফর কিংবা খবরের কাগজের রিপোর্ট– সব লেখাতেই নিজস্ব আঙুলের ছাপ রেখে গিয়েছেন। তাঁর কলম দিয়ে যা যা বেরিয়েছে, তার বেশিরভাগটাই ছিল নিজের চোখে দেখা বা নিজের জীবন থেকে উঠে আসা। গল্প-উপন্যাস লেখার সময় সে-ই দেখার সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আশ্চর্য কল্পনাকে। ফলে ফিকশন এবং নন-ফিকশনের মিশেলে সেই লেখাগুলি হয়ে উঠেছিল এক-একটি হিরের খনি। পরে ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে পৃথিবীজোড়া যে তোলপাড়– তা শ্যামলের রচনায় ধরা পড়েছিল অনেক অনেক আগে। কিন্তু যেহেতু তিনি একজন বাঙালি এবং বাংলাই ছিল তাঁর লেখার ভাষা, তাই তা সারা পৃথিবীতে যথা সময়ে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। উঠে আসতে পারেনি আলোচনার কেন্দ্রে। আর আমরা যখন এটা বুঝতে পেরেছি, তখন তেলচিটে পুরোনো গামছায় চোখ মোছা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।
শ্যামলবাবুর উপন্যাস বা ছোটগল্প নিয়ে বিদগ্ধ ব্যক্তিরা বেশ কিছু আলোচনা করেছেন। কিন্তু আজ আমি তাঁর সেইসব লেখার কথা বলতে চাইব, যার ধরন হল আত্মচরিত। বাংলা ভাষায় আমরা যেসব আত্মচরিত পড়ে এসেছি তার বেশিরভাগই খুব অকপট নয়। সেখানে লেখকের জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতার কথা থাকলেও অপমান, লাঞ্ছনা বা প্রতিহিংসার অন্ধকার দিকগুলির কথা বড় একটা লেখা হয় না। সামাজিক অবস্থানজনিত কারণেই হয়তো লেখা থাকে না বৃষ্টি আর ভিজে ঘাসের গন্ধে মাখামাখি হয়ে যাওয়া যৌন অভিজ্ঞতাগুলির কথা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মকথা বিষয়ক লেখার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই ক্রাউন সাইজের সেন্টার স্টিচ করা যে পাতলা ছিপছিপে বইটির কথা মনে পড়ে, তার নাম ‘সময় বড় বলবান’। বইটির প্রকাশক ‘আজকাল’। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৬। প্রকাশকাল বইমেলা ১৯৯২। এই বইয়ের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে শুধুই বন্ধুদের কথা, বন্ধুত্বের কথা আর বন্ধুত্বের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার কথা। শ্যামল লিখছেন, ‘রোদ্দুর বা জ্যোৎস্নাকে শোনা যায় না। দেখা যায়। ছোঁয়া যায় বলব না। বলব টের পাওয়া যায়। মালুম হয়। আরেকটি জিনিসও টের পাওয়া যায়। তা হল বন্ধুত্ব। ’ কিংবা ‘নানান সময়কে জুড়ে আস্ত একটি যুগ করে দেয় যে ফেভিকল তাই-ই বন্ধুত্ব।’ আবার ‘আসলে পানীয়র চেয়ে সঙ্গটাই বড় ছিল। ঠিক এভাবেই আজকে বলতে পারি– লেখালিখিও ছিল একটা অছিলা মাত্র। আসল লক্ষ্য ছিল বন্ধুত্ব। মেশামিশি। ঘন ভালবাসাবাসি। একদম কনডেন্সড। যা দিলে অনেকগুলো হৃদয় একসঙ্গে একটি পায়েসে মিশে যায়।’ সত্যিই তো, বন্ধুত্বকে কেন শেষদিন পর্যন্ত এত গুরুত্ব দিতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়? কেন বন্ধুদের ভালোবাসতেন অত গভীরভাবে? লেখাটির এক জায়গায় রয়েছে ‘মতির শালীর ছবি দেখেই বিয়ে বসলাম। বিয়ে করে কোথায় যাই। সুনীলের অফিসে গেলাম। দুপুরবেলা। গরম। নতুন বউ নিয়ে গেছি। সুনীল বেরিয়ে এল। আমরা বেড়াতে গেলাম। কোথায়? পার্কসার্কাস কবরখানায়। মাইকেলের কবরে। কেন গিয়েছিলাম জানি না। কত কত পাথর ভেঙে পড়ে আছে। তার ভেতর দিয়ে সতেজ বুনোলতা– নাম না জানা ফুল। সাম্রাজ্য করতে এসে অসুখ-বিসুখ, যুদ্ধবিগ্রহে কত লোকের অকালবিয়োগ। তার ভেতর অবিবাহিত সুনীল, সদ্য বিবাহিত শ্যামল। আনকোরা ইতি।’ লেখালিখির জগতে যখন তাঁর কয়েকজন বন্ধু অসম্ভব নাম-যশ করে ফেলেছেন, তখন কেউ যদি শ্যামলদার কাছে এসে তেমন কোনও বন্ধুর নামে সামান্যতম কুৎসা করার চেষ্টা করত, তবে তিনি গালাগালি দিয়ে তার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে দিতেন– এ আমার নিজের চোখে দেখা। স্বাভাবিকভাবেই মনে এই প্রশ্নও জাগে, তিনি যতটা ভালোবাসতেন তাঁর বন্ধুদের, বন্ধুরাও কি তাঁকে ঠিক অতটাই ভালোবাসত?
এই রচনার নানা জায়গায় শ্যামলবাবু বিখ্যাত সব সৃষ্টিশীল মানুষদের যখন যেভাবে দেখেছেন– ঠিক সেইভাবে তাঁদের ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। পাজামায় চোরকাঁটা নিয়ে শুটিংয়ের জায়গা দেখে ভোরবেলা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা সত্যজিৎ রায়, সুন্দর বেশবাস পরে ট্রামে চেপে তাস খেলতে যাওয়া প্রেমেন্দ্র মিত্র, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে দু’হাতে দু’বালতি জল নিয়ে খালি গায়ে নিজের বাড়ির বারান্দা ধুতে আসা জীবনানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষযাত্রা– কী নয়! এছাড়া তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ, বিমল কর এঁরা তো আছেনই। যেকোনও চরিত্রের বর্ণনা পড়লে মনে হবে তাঁকে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এ কিন্তু বড় সোজা কথা নয়!
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মস্মৃতি নিয়ে এর পরের বইটি হল ‘জীবন রহস্য’। প্রকাশক ‘মিত্র ও ঘোষ’। ডিমাই সাইজের এই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩১। প্রকাশকাল পৌষ ১৩৯৯। মানে, শীত ১৯৯২। শ্যামলবাবুর জন্ম দুই বিশ্বযুদ্ধের ঠিক মাঝের বিপন্ন সময়টিতে। তিনি অখণ্ড বাংলা দেখেছেন। দেখেছেন দেশভাগ। এ বইয়ের শুরু থেকেই তাঁর ছেলেবেলার খুলনা শহরের স্মৃতি। ভৈরব আর রূপসা– দুটি নদ-নদীর স্মৃতি। তাঁর স্নেহময়ী মায়ের স্মৃতি– যিনি তাঁদের খুলনার ভাড়া বাড়ির উঠোনে বেড়া দিতেন, গান গাইতেন, ছাগল পুষতেন। বড় ছেলে কলকাতা থেকে ছুটিতে বাড়ি এলে, তার সঙ্গে সেখানকার ‘উল্লসিনী’ সিনেমা হলে চার্লি চ্যাপলিনের ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ দেখতে যেতেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বড়দা তাঁর মায়ের থেকে বয়সে মাত্র বারো বছরের ছোট ছিলেন। দেখে মনে হত, কোনও দিদিকে নিয়ে তার ছোট ভাই সিনেমায় যাচ্ছে। এই বড়দার সঙ্গেই সুরমা নামের একটি মেয়ের ভালোবাসা ছিল। বড়দা খুব ভোরে উঠে দু’টি ছোটো ভাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার পথে, সুরমার চুলে ফুল গুঁজে দিতেন। শ্যামলের চোখে সেই প্রথম প্রেম দেখা। শ্যামল লিখেছেন, নিজেও পরে অত সুন্দর করে কারও চুলে ফুল গুঁজে দিতে পারেননি। সেই স্টাইলটাই যেন একদম আলাদা ছিল।
শ্যামলবাবুর বাবা কাজ করতেন কোর্টে। তিনি ঘুষ নিতেন। অকপট শ্যামল লিখছেন, ‘‘দক্ষ লোক ছাড়া ঘুষ খেয়ে হজম করা যায় না। ঘুষ মানে ছ’কোনা সিকি, দুয়ানি, বড় তামার পয়সা। সেগুলো সন্ধেরাতে লাল কেরোসিনের প্রায়-অন্ধকার হেরিকেনের সামনে একদিন বাবাকে গুনতে দেখেছিলাম। আট টাকা ছ’আনা মোট।’’ এহেন বাবার পকেট থেকে তিনি প্রথম একটি আধুলি সরিয়ে ছিলেন বড়দার বিয়ের দিন সকালে। সেটাই তাঁর জীবনের প্রথম পকেটমারি। এরপর থেকে যতবার বাসে-ট্রামে ‘বি অ্যাওয়্যার অব দ্য পিক পকেটস’ লেখাটি দেখেছেন, ততবার চমকে চমকে উঠেছেন। মনে হয়েছে– আরে, আমিও তো একজন পকেটমার! কলকাতায় কলেজের এক সহপাঠিনী প্রেমে লেঙ্গি মেরে ইউনিয়নের ছেলেদের উসকে তাঁকে মার খাওয়ায় এবং তারা নাপিত ডেকে ধরে-বেঁধে তাঁর মাথা ন্যাড়া করিয়ে দেয়। সেই সময়কার অপমান এবং মানসিক যন্ত্রণার কথাও লুকিয়ে রাখেননি শ্যামল। যেমন লুকিয়ে রাখেননি কিশোর বয়সে না-বুঝে প্রথম বেশ্যালয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনাটিকে।
জীবনে ভালো লাগার মেয়ে কেমন হবে, সেটা বোঝাতে গিয়ে শ্যামল লিখছেন, ‘ভালো লাগার মেয়ের হাইটে কিছু যায় আসে না। গায়ের রং কিংবা কানের দুল, কিংবা ম্যাচিং ব্লাউজ, কোনোটাই পৃথিবীর কোনো ছেলে খুঁজে দেখে না। দেখে যা, তা হল রসিকতা বোঝে কিনা, মাথায় জিজ্ঞাসা জাগাবার মতো কথা বলে কিনা। কথা বলতে বলতে নিজের বুকের দিকে তাকায় না তো? হাঁটাটি ভালো হওয়া চাই। চা বোঝে। লেডিজ সিটের জন্য বাসে ছোটাছুটি করে না। কথা বলার সময় গলা যেন চিরে না যায়। গান না জানলেও পুরোনো দিনের গান যেন ভালোবাসে। গজদন্ত থাকলে খুবই ভালো। রান্নাটাকে সে যেন আবিষ্কারক এডিসনের দৃষ্টিতে দেখে। মাঝে মধ্যে ভীমসেন, বিলায়েৎ, বিসমিল্লা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত শুনলে খুব খুশি হই। নিজের থেকে।’ শ্যামল মনে করতেন, সারা দুনিয়ার সব দেশই মাতৃতান্ত্রিক। ‘মেয়েরা আমাদের আনে। তাকে নানা বয়সে নানাভাবে আমরা জড়িয়ে শুয়ে থাকি। ওরাই আমাদের ঠেলে তুলে হাঁটতে শেখায়। কাজে পাঠায়। মাতৃবাদ সব বাদের চেয়ে পুরনো এবং বনেদী।’
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মকথামূলক শেষ বইটির নাম ‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’। এটি বাংলাদেশের বই। প্রকাশক ঢাকার ‘কাগজ প্রকাশন’। ডিমাই সাইজের এই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৫। প্রকাশ পেয়েছে একুশে বইমেলা, ২০০৩-এ। এই বই তিনটি নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলার প্রয়োজন সেটা হল, ‘সময় বড়ো বলবান’ এই পুরো বইটিই ‘জীবন রহস্য’ এবং ‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’-এই বই দু’টির শেষ অংশে ঢুকে গিয়েছে। আর ‘জীবন রহস্য’-র অধিকাংশ জায়গাই ঢুকে রয়েছে ‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’-র মধ্যে। তবে এই বইগুলোকে শুধুমাত্র ‘আত্মচরিত’ বলা হয়তো উচিত হবে না কারণ এদের পাতায় পাতায় ধরা রয়েছে সেই সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নাগরিক জীবনের এক নিখুঁত মানচিত্র।
এছাড়া শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু আত্মস্মৃতিমূলক রচনার সন্ধান পাওয়া যায় ‘মনফকিরা’ প্রকাশনের ‘বুকের ভেতরের রস’ নামের একটি ডিমাই সাইজের ৮৬ পাতার পাতলা বইতে। এতে থাকা, অনেক আগে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি স্বাধীন লেখা, আলাদা পরিচ্ছেদ হিসেবে অথবা কোনও পরিচ্ছেদের অংশ হিসেবে স্থান পেয়েছে আগে উল্লেখ করা তিনখানি বইয়ের নানা জায়গায়। কিন্তু এই বইটিকে বহুদিন ধরেই আর বাজারে পাওয়া যায় না। তুমুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রকাশক কোনও এক অজানা কারণে এই বইটি ছাপানোর আগ্রহ অনুভব করেন না। শ্যামলবাবুর এই ধরনের আরও কত লেখা যে কত পত্রপত্রিকায় এখনও অগ্রন্থিত অবস্থায় ছড়িয়ে রয়েছে, তা বলা খুবই শক্ত।