আত্মস্ফূর্তির এই তাগিদ ছাড়াও আর একটি প্রেরণার সূত্রও কিন্তু উঠে আসে তাঁর লেখায়, সেটি বিশেষ অভিনিবেশের দাবিও রাখে। রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী তিনি৷ কিন্তু সে গান তো তাঁর নিজের জিনিস নয়। ‘চিরদিনই কি ঋণী হয়ে থাকব সেই স্রষ্টার কাছে? আমার সত্তা, আমার আত্মপ্রকাশ কই? যা ভাবি, যা বলতে চাই তার ভাষা কি আমার অনায়ত্তই থেকে যাবে?… আমার বলার কথা সাধারণ। সেই কথা আমার মতো করেই আমি বলতে চাই। এই তো আমার খেয়াল, এই তো আমার খুশি।’
আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে সুচিত্রা মিত্র বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যমটিকেই। সন্দেহ নেই, তা গান। তাছাড়া অভিনয় এবং নৃত্যেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল। গানের মতো অত ব্যাপক না হলেও তাঁর জীবনের পাবলিক স্পেয়ারেরই অংশ ছিল। তবু তারপরেও, সুচিত্রা মিত্র কলম তুললেন, অর্থাৎ, কিছু তো বাকি ছিল তাঁর নিজেকে মেলে ধরার ইচ্ছায়। সুচিত্রার নিজের কথায়– ‘নবছর যখন বয়স তখন হঠাৎ কোন খেয়ালে একটি পদ্য লিখে ফেলি… সত্যি বলতে কী এই পদ্য হাত দিয়ে বেরুনোর পর আমাকে আর ঠেকানো যায়নি।… লেখার নেশায় যেন পেয়ে বসেছিল। যা মনে হত, যা ভাবতাম, যা দেখতাম এমনকী যা না দেখতাম সব কিছু নিয়েই লিখে যেতাম, লিখেই যেতাম। বাবা-মা শুধু নয়, আমার দাদা আর ছোট ভাই-এর সস্নেহ প্রশ্রয়ে আমার খ্যাপামির ঘোড়া লাগামহীন ছুটে বেড়িয়েছে অনেকদিন।’
ছড়ার কলম তাঁর ছুটত অবসরে-অনবসরে। মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছে তা সংকলন হল প্রথম। তারপরের দশকে আরও একটি। সুচিত্রা বলছেন– ‘ছেলেবয়সের সেই খ্যাপামি… কোনওদিনই আমাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি– আমি তাকে ছেড়ে যেতে দিইনি; ঝড়ঝঞ্ঝা যতই উঠুক না কেন।’
আত্মস্ফূর্তির এই তাগিদ ছাড়াও আর একটি প্রেরণার সূত্রও কিন্তু উঠে আসে তাঁর লেখায়, সেটি বিশেষ অভিনিবেশের দাবিও রাখে। রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী তিনি৷ কিন্তু সে গান তো তাঁর নিজের জিনিস নয়। ‘চিরদিনই কি ঋণী হয়ে থাকব সেই স্রষ্টার কাছে? আমার সত্তা, আমার আত্মপ্রকাশ কই? যা ভাবি, যা বলতে চাই তার ভাষা কি আমার অনায়ত্তই থেকে যাবে?… আমার বলার কথা সাধারণ। সেই কথা আমার মতো করেই আমি বলতে চাই। এই তো আমার খেয়াল, এই তো আমার খুশি।’
এ তো নিজের সঙ্গেই দারুণ এক চ্যালেঞ্জের কথা!
রবীন্দ্রসংগীতের সুচিত্রা মিত্রের পাশে আর এক সুচিত্রা মিত্র এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছেন শুধুমাত্র নিজের সৃষ্টির সম্বল নিয়ে। এ তাঁর নিজের কাছে যেমন, তেমনই তাঁর শ্রোতা আর পাঠকদের কাছেও এক সমান চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৮-এ প্রথম বই প্রকাশের মুহূর্তে তাঁর পাঠক কোথাও ছিল না বললেই চলে। তাঁর শ্রোতারা ছিল– তিনি জানতেন, এঁদেরই মধ্য থেকে হয়তো তাঁকে এক নতুন চারণভূমি সৃষ্টি করতে হবে– নিজের লেখার– তৈরি হবে তাঁর পাঠককুল।
অবশ্যই সুচিত্রা মিত্র কেবল এক ধরনের লেখাই যে লিখে গিয়েছেন তা নয়।পদ্য লিখেছেন, যার মধ্যে স্বরচিত ছড়া-কবিতা ছাড়াও আছে ভিনদেশি কবিতার অনুবাদ। গদ্য লিখেছেন–আত্মস্মৃতিমূলক গদ্য, ছোটদের জন্য গল্প, রূপকথা। লিখেছেন দিনলিপি, যার কিছু অংশ প্রকাশিতও হয়েছে, অনেকটা রয়েছে অপ্রকাশের অন্ধকারে, অনেকটা হারিয়েও গিয়েছে। এর বাইরে অবশ্যই তাঁকে লিখতে হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত– শিক্ষাক্রমের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক, রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক ফরমায়েশি নিবন্ধ, সমালোচনা, রবীন্দ্ররচনাভিত্তিক গীতি-আলেখ্যের ভাষ্য ইত্যাদিও। কিন্তু এই শেষেরগুলি নিতান্তই তাঁর পেশাগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উঠে আসা লেখা যেখানে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে সম্পূর্ণ ভুলে থাকা অসম্ভব।
সুচিত্রা মিত্রের গানে ছিল ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’।
এই আনন্দটা ভরপুর পাওয়া যায় তাঁর কলমেও। নিজের চারপাশটাকে জ্যান্ত বয়ে নিতেন সুচিত্রা তাঁর লেখায়। তাই সহজ স্বতঃস্ফূর্তির ছটায় সুচিত্রা মিত্রের রচনাবলি বর্ণিল। এই পরিসরে সেই রচনাবলির পূর্ণাঙ্গ ছবি ফুটিয়ে তোলার দুশ্চেষ্টায় এ লেখা যাবে না। তাঁর দু’টি মাত্র বইকে একটু নেড়েচেড়েই এ যাত্রায় থামব আমরা। ‘গুড়ের পুতুল’ আর ‘রতনপুরের রহস্য’। দু’টিই ‘আনন্দ’-এর ‘কিশোর কাহিনী সিরিজ’-এর অংশ। এই দু’টি বই-ই প্রকাশের আলো দেখেছিল বর্তমান সহস্রাব্দের গোড়ায়, সুচিত্রা তখন পঁচাত্তরের ‘তরুণী’। তবে গল্পগুলির সূত্রপাত হয়েছিল আরও প্রায় আড়াই দশক পিছনে। ট্রেনে যেতে যেতে, অসুস্থতার দিনে হাসপাতালের বিছানায় কিংবা শিশু ভাইঝিকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই এদের হয়ে ওঠা। ব্যক্তি সুচিত্রা মিত্রর কথনের সহজতা, তাঁর গদ্যকে স্বচ্ছন্দ করেছিল তাঁর ছড়ার তুলনায় ঢের বেশি, ছড়াশিল্পী হিসেবে সুচিত্রা অধিক চর্চিত হলেও এটা অনস্বীকার্য। গল্প বলায় সুচিত্রা মিত্রর এই স্বাচ্ছন্দ্য চিহ্নিত আছে ‘গুড়ের পুতুল’-এর রূপকথা-উপকথা ধরনের গল্পগুলোতে। কিছু গল্প মায়ের মুখে শোনা, কিছু বিদেশি গল্পের চমৎকার দেশি রূপায়ণ।মায়ের বলা গল্প-প্রসঙ্গে সুচিত্রা-জননী সুবর্ণলতার একটি ভারী মমতাময় ছবি ফুটেছে বইটিতে।– ‘মনে পড়ছে একটি গল্পের কথা, যে গল্প, আমার জ্বর হলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে, আমার পাশে বসে আমার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে মা বলতেন মৃদুকণ্ঠে, ঘুমপাড়ানি গানের সুরে। সে গল্প কতবার যে শুনেছি, মনে নেই। কিন্তু, যখনই শুনেছি তখনই মনে হয়েছে– আহা এমন গল্প কি আর কেউ এমন করে বলতে পারে?’ মায়ের সঙ্গে তাঁর তফাত কোথায়, সেটা এর পরেই স্পষ্ট করেছেন সুচিত্রা।– ‘মা যেমন সহজ সাবলীল ভাষায় বলতেন গল্পটি, সে ভাষায় বলতে পারব না। কারণ,আমরা বহু কেতাব-পড়া মানুষ তো, তাই সেই সহজ মা-দিদিমার ভালোবাসার ভাষা আমাদের জানা নেই।’
‘ভালোবাসার ভাষা’– সুচিত্রা মিত্র ব্যবহৃত এই শব্দবন্ধটি বড় চমৎকার। এ ভাষা যে কেমন সে আমরা ভুলে গিয়েছি কিন্তু ভাষায় যে সহজ স্নেহ-ভালোবাসা ছোঁয়ানো যায় মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে মায়ের গল্প-বলার মতো– তা সুচিত্রা মিত্রের এ বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। ‘গুড়ের পুতুল’,‘গল্প শোনা’-র বোকা রাজা আর মন্ত্রীর বুদ্ধিমতী মেয়ের গল্প, ‘দোতারা বাজিয়ে কানাই’,‘মোরগ আর মুরগি’,‘তিন কন্যা’,‘গুনগুনে মৌমাছি’– এগুলি সবই নীতিমূলক নিটোল গল্প হলেও বলার ভঙ্গিটির গুণেই এরা আন্তরিক।– ‘এক বাজিয়ে। নাম কানাই। ভারী গরিব। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব বলতে কেউ নেই। একটি কেবল দোতারা যন্ত্র আছে। কানাই সেটিকে ঝেড়ে-পুঁছে ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়ায়। যখন দোতারা বাজিয়ে গান ধরে তখন মানুষ কেন, গাছপালা জন্তু জানোয়ার পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে শোনে।’
এই ভাষা একেবারে রূপকথা বলারই ভাষা। ছোটদের কাছে গল্প করার ভাষা। জানা নেই, মূলের প্রভাবেই এ ভাষাটি সুচিত্রা মিত্রের কলমে এসেছিল কি না। কিন্তু এত আটপৌরে বলেই এ ভাষার হৃদস্পন্দনে আমরা সাড়া দিতে পারি। ‘চালিয়াত চন্দর’ কিংবা ‘মা কালীর খাঁড়া’-র মতো জনপ্রিয় বইয়ের লেখক পিতা সৌরীন্দ্রমোহনের উত্তরাধিকার হিসেবে লেখার নেশা সুচিত্রা-তে হয়তো বা বর্তেছিল, কিন্তু পিতার ভাষাটি তিনি নেননি। এ তাঁর মায়ের ভাষা। তাই বলাই যায়, গানের মতোই লেখাতেও সুচিত্রা মিত্র মাতৃতান্ত্রিক।
‘রতনপুরের রহস্য’ বইতে গল্পকথনের এই কুশলতা আরও প্রমাণিত। এ বইটির আবহাওয়া একটু ভূতুড়ে। অর্থাৎ ভূতের গল্প, ভূতকে নিয়ে গল্প। নাম-গল্পটিতে ভূত আছে কি নেই, সে নিয়ে ভূমিকা একটু বেশি দীর্ঘ হয়ে গেলেও গল্পের তীব্র কৌতূহলকে কোথাও পড়তে দেননি সুচিত্রা। তাঁর যেটি সম্পদ, সেই নাটকীয়তার পরিচিত কুশলতা এ বইয়ের প্রায় প্রতিটি গল্পেই আমরা পাই।– “আরে রাত ফুরোলেই তো মজা মাটি। যা করছিলি কর না, এঁরা তো কোনও ক্ষতি করেননি এ পর্যন্ত। রোজকার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা বড় একটা হয় না তো, তাই…। হঠাৎ রমেশ চুপ করে গেল। তার এই স্তব্ধতায় আবার একটা অজানা অচেনা কিছু এসে যেন আরাম করে বসে পড়ল– সেটা যে কী, তা আজও বলতে পারব না। তবে চোখে দেখছি না কাউকে অথচ অনুভব করছি কারুর উপস্থিতি— অনুভূতিটা এই গোছের।’’
উল্টোদিকে ভূত নিয়ে হাসিঠাট্টা-রঙ্গব্যঙ্গের মজাও সুচিত্রা সুন্দর তৈরি করেন ত্রৈলোক্যনাথ থেকে শিবরাম পর্যন্ত ঐতিহ্য ধরে– বিশেষত শেষদিকের গল্পগুলিতে (‘দশ ভূতের কাণ্ড’, ‘ভূত কে?’)। ‘পাগলাডিহির রহস্য’ গল্পটির কথা আলাদা করে বলতে হবেই। বিদেশি গল্পের ছায়ানুসরণে গড়া এ গল্পে সাসপেন্স আর ভয়ের মিশেলে শিরশিরে রহস্য দানা বাঁধানোর মুনশিয়ানা শিশু-কিশোর সাহিত্যের আঙিনায় সুচিত্রা মিত্রের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবেই।– ‘ড্যাশবোর্ডে আলো নেই। স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখি না কিন্তু আন্দাজ করা যায় আশি মাইলের কোঠায় কাঁটা উঠেছে। যেন ঝড়ে উড়ে যাচ্ছি। যেন জিপের চাকা মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ও কি পাগল হয়ে গেছে? ওকে থামাব কেমন করে? মুহূর্তের জন্য বাণীর টলটলে মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ চারদিকের নিস্তব্ধতা চিরে চিরে শুনলাম অদ্ভুত এক অট্টহাসি। ভাঙা গলায় অনিমেষ হাসছে— পাগলের মতো হাসছে। সে হাসি কি মানুষের না পিশাচের? সহ্য করতে পারছি না। লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার এক অদম্য ইচ্ছে হচ্ছে। মরি– মরব। কিন্তু এ যন্ত্রণা– এই নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম অনিমেষের সাহচর্যে আমার ভয় হচ্ছে। আমি ভীত। আমি… আমি…। আবার অনিমেষের গলা শুনতে পেলাম। খুব কষ্ট করে সে হাসি চাপবার চেষ্টা করছে। দৈববাণীর মতো তার গুরুগম্ভীর গলার তলায় তলায় যেন ঝরনার ছলছল চাপল্য।’
সুচিত্রার নিজের কথা– ‘ছোটবেলা থেকেই আমার গল্প ভালো লাগে। (আজ) বুড়ো হয়েও সে সব গল্প রোজই মনে জাগে। (এখন) গল্প আমায় কেই বা বলে? গল্প শোনাই তাই। এই ব্যাপারে আমার কাছে শিশু বুড়ো নাই। ভালবাসে গল্প যারা তারাই কাছে আসে– আর নানা রঙের গল্প শুনে মাতে রঙিন রসে।’
সুচিত্রা মিত্র কতটা কুশলী ভাষাশিল্পী ছিলেন, তার তৌলন অথবা স্বহস্তের কলম তাঁর কণ্ঠের প্রতিস্পর্ধী কি না, এ জাতীয় অযথা তর্কে এ লেখা যায়নি। কারণ সে নিষ্পত্তি সময়ের হাতে হয়েই গিয়েছে। কেবল আশ্চর্য ঐশ্বর্যময় প্রকাশপ্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন যে সুচিত্রা মিত্র, চোখ-ধাঁধানো রবীন্দ্রসংগীত-গায়নের অতিচর্চিত আখ্যানের সমান্তরালে লেখক হিসেবে তাঁর আত্ম-উন্মোচনও কতটা মনোজ্ঞ হতে পারে, শতবর্ষ-পালনের সাংগীতিক মুখরতার মধ্যে তার একটুখানি সাক্ষী হতে পারাটাই এর একমাত্র লাভ।