কে এই স্বপনকুমার ও শ্রী ভৃগু? দু’জনই সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে, যাঁর অভিশাপে বাঙালির নিত্যসঙ্গী বই আজ শহর থেকে নির্বাসিত হতে চলেছে। আরও নাম আছে তাঁর। ‘শ্রী ভৃগু’ হয়ে তিনি জ্যোতিষ করেছেন। আরও অন্য নামে ডাক্তারি বই থেকে বাগান করা, পশুপালন, টেক্সট বই, হাত দেখা– কিছুই বাদ দেননি! আর স্বপনকুমার হয়ে অজস্র সস্তার ট্র্যাশ রহস্য-রোমাঞ্চ চটিবই লিখেছেন, যার না আছে মাথা না আছে মুন্ডু, যাকে বলে চূড়ান্ত গাঁজাখুরি! অথচ ষাটোর্ধ্ব ১০ জনকে জিজ্ঞেস করলে ৮ জনের চোখ চকচক করে উঠবে স্বপনকুমারের নাম শুনে।
বেশ কিছু বই বাঙালি লুকিয়ে পড়েছে। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’, ‘চরিত্রহীন’, ‘রাতভোর বৃষ্টি’, ‘বিবর’ আরও অনেক আছে নিশ্চয়ই। বিদেশি বইয়ের মধ্যে ‘লেডি চ্যাটারলিস লাভার’ অগ্রগণ্য। লুকিয়ে পড়তে হয়েছে কেন? আর যারা পড়েছে তারা কি পড়ে খারাপ হয়ে গ্যাছে? তাহলে সমাজ কেন এগুলোকে তখন লুকোতে চেয়েছিল? কেন লুকিয়ে রাখতে হয়? তবে এদের ভাগ্য ভালো, এরা ধীরে ধীরে বাঙালির বুক সেলফ-এ জায়গা করে নিয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলির পাশে। তাতেও কি ভালো কিছু হয়েছে?
হেসেছেন স্বপনকুমার নিভৃতে তার এক্সাইল (exile) থেকে। তারপর একটা সময় বাঙালির শোকেস ভরে গ্যাছে। আর বই কেনা যাবে না। যা আছে, তাই দিয়েই চলে যাবে। সংস্কৃতির মহামদিরে জায়গা হয়নি স্বপনকুমারের। (কারা কারা জায়গা পেল, কেন পেল– তাই নিয়ে ছোট্ট আলোচনায় বসব কোনও দিন)।
এদিকে শহরের বইয়ের দোকানগুলো সব গিফট শপ হয়ে যাচ্ছে। এটা কি স্বপনকুমারের অভিশাপ? এগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে কে? কালনাগিনী? ড্রাগন? কলকেতু? বাজপাখি? কিন্তু গিফট শপে ঝুলতে থাকা সফট-টয়ে এরা কেউ নেই। অমল, দইওয়ালা, ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা হাঁসজারুও নেই। যারা ঝুলছে তারা নতুন বাঙালির নতুন শোকেসের নতুন আইকন। বই নয় শোকেস ভরে উঠেছে সফট টয়ে। শ্রীভৃগু গণৎকার সব জানতেন।
কে এই স্বপনকুমার ও শ্রী ভৃগু ? দু’জনই সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে, যাঁর অভিশাপে বাঙালির নিত্যসঙ্গী বই আজ শহর থেকে নির্বাসিত হতে চলেছে। আরও নাম আছে তাঁর। ‘শ্রী ভৃগু’ হয়ে তিনি জ্যোতিষ করেছেন। আরও অন্য নামে ডাক্তারি বই থেকে বাগান করা, পশুপালন, টেক্সট বই, হাত দেখা– কিছুই বাদ দেননি! আর স্বপনকুমার হয়ে অসংখ্য অজস্র সস্তার ট্র্যাশ রহস্য-রোমাঞ্চ চটিবই লিখেছেন, যার না আছে মাথা না আছে মুন্ডু, যাকে বলে চূড়ান্ত গাঁজাখুরি! অথচ ষাটোর্ধ্ব ১০ জনকে জিজ্ঞেস করলে ৮ জনের চোখ চকচক করে উঠবে স্বপনকুমারের নাম শুনে। শুরু হয়ে যাবে স্মৃতিচারণ।
আরও পড়ুন: লকআপে বসে স্টোরিটেলিংয়ের জোরে পুলিশকে বন্ধু বানিয়েছিলেন রাম গোপাল বর্মা
আহা কী দিন ছিল! ঝাঁকামুটে মাথায় করে এই বই নিয়ে গিয়ে বসত ইশকুলের গেটের সামনে। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যেত তার পশরা। সেই বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে অভিভাবকের হাতে প্রহৃত হত বিপ্লবী কিশোর পাঠক। বাজেয়াপ্ত হত সেই বই। রাতে সেই বই অভিভাবক নিজে লুকিয়ে পড়তেন। তার থেকে যেত তার স্ত্রীর কাছে, সেখান থেকে মেজদিদি ও ছোট কাকিমা হয়ে পাশের বাড়ি। এদিকে কিশোরের হতে নতুন বই ( দু’আনা আসতেই পকেটে)। সেটা এক নিশ্বাসে শেষ হয়ে যেতেই পাচার হয়ে যেত ভাইবোন হয়ে বন্ধুদের হাতে। কী কী ভাবে হাতে আসত এই বই, গোগ্রাসে পড়া হয়ে যেত, আবার হয়ে যেত হাতবদল। নিষিদ্ধ ইশতাহার হয়ে ঘুরেছে এই শহরের অন্দরে-বন্দরে এসেছে আবার মিলিয়ে গ্যাছে দীপক চ্যাটার্জি ও তার সঙ্গী রতনলালের দুর্ধর্ষ কাহিনি। বাজপাখি ড্রাগন কালনাগিনীর মতো ভয়ংকর সব ভিলেন ত্রাস সৃষ্টি করেছে।
একটা নয়, দুটো নয়, দু’-তিন যুগ ধরে অসংখ্য রোমাঞ্চ, এক আশ্চর্য জগৎ, একটা অন্য শহর গড়ে উঠেছে এই শহরের বুকে মোরাল পুলিশের রক্তচক্ষুর আড়ালে। তারপর হারিয়ে গ্যাছে চিরতরে, কারণ তাদের কেউ রাখেনি নিজের জিম্মায়, হাতকড়া পড়ার ভয়ে, দ্য ফিয়ার অফ বিয়িং জাজড । কারণ বাঙালি রুচিশীল। আর রক্ষণশীল!
দীপকের গপ্প সব ফ্যান্টাসি, অতিরঞ্জন। কিন্তু ফ্যান্টাসিতে ক্ষতি কী? ত্রৈলোক্যনাথ, সুকুমার রায় পড়তে তো আমাদের রুচিতে আঘাত লাগেনি? হ-য-ব-র-ল লুকিয়ে পড়তে হয়নি। কারণ সেটা হাস্যরস ছিল?
আরও পড়ুন: ভদ্রলোকের ময়নাতদন্ত, ছোটলোকের খোলা আকাশ
আমবাঙালির সাহিত্য চর্চা শুরু বটতলা বই থেকে। তারপর রেনেসাঁস ও পরবর্তী ভিক্টোরিয়ান মরালিটি এক রুচিশীল বাঙালির কালচারের প্রতিষ্ঠা করে। সেখান থেকে প্রথমেই বাদ যায় আদিরস। যৌনতা ও ভায়োলেন্স নিষিদ্ধ হয়। স্বপনকুমারের লেখায় ক্রাইম হিংসা ও হালকা যৌনতার গন্ধ ছিল। তা পরিত্যাজ্য। বরং বাঙালির তার সন্তানদের জন্য প্রয়োজন ছিল এক কুইজ মাস্টার ডিটেকটিভ– যার গোটা সমগ্র ঘাটলে একটি নারী চরিত্র নেই। আর হিংসা নয় জীবনের সব মীমাংসা হবে গোল হয়ে বসে মগজাস্ত্র দিয়ে। বাঙালির নিজের বাহুবল না বুদ্ধিবলের ওপর বিশ্বাস চিরকাল।
নেতাজি, সূর্য সেন, বাঘাযতীন আদতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল। বাকি বাঙালি সন্তান তাদের পুজো করেছে কিন্তু বাড়িতে বসে। ঘর থেকে বেরতে দেয়নি তাদের মা বাবা। বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তাড়াতাড়ি। বয়স বাড়লে তারা স্মৃতি হয়ে গ্যাছে। আমি নেতাজিকে দেখেছি। খুঁজেছি। দার্জিলিং অবধি গেছিলাম। দীপক চ্যাটার্জী সাবমেরিনে বর্মা চলে যায়, যত আজগুবি, নেতাজি না কি?
ভায়োলেন্স আবার কড়া নাড়ল সত্তরে। একদম ঘরের পাশে। ঘরের মধ্যে। নকশাল বাঙালির কাছে থ্রেট ছিল। তাই বরানগরে যখন ১৯৭২-এ গণহত্যা হচ্ছিল, সেদিন রাতে সাউতে ‘ইন্দিরা’, ‘বিজলী’, ‘বসুশ্রী’ হাউসফুল ছিল উত্তমকুমারের ছবিতে। সন্তানহারা মায়ের চোখের জল দেখে শুধুমাত্র রাজেশ খান্না বলেছিল ‘পুষ্পা আই হেট টিয়ার্স’। আর সবাই চুপ ছিল। মগজাস্ত্রে শান দিচ্ছিল। সিনেমা, গল্পে সত্তর এখন সবচেয়ে ‘ভালো খায়’। (বলে রাখা ভালো, এই সেই ‘বসুশ্রী’ যেখানে ‘পথের পাঁচালী’ এক দশক আগে রিলিজ হয়ে হলে মাছি তাড়াচ্ছিল। তারপর সাহেবরা বলল, ‘ব্রাভো। বাঙালি বলল ব্রাভো। আসলে সাহেব বলেছিল– ভাবো। ভুল বুঝেছিল বাঙালি)
এগুলো সব স্বপনকুমারের হাসি।
হাসছেন কেন স্বপনবাবু? আপনার লেখা লোকে মনে রাখেনি বলে? তেজপাতা বই জন্মদিনে কাউকে গিফট করেনি বলে। আপনিও কালচার হতে চান?
শ্রীস্বপনকুমার বিস্মিত তার ডিটেকটিভ দীপক চ্যাটার্জীকে নিয়ে বাংলায় সিনেমা হচ্ছে। এই নির্বাসিত লেখক আর তাঁর বিস্মৃত জগৎকে হঠাৎ প্রয়োজন পড়ল কেন আবার? বাঙালির স্মৃতির ভাঁড়ারে কি টান পড়েছে? সাতের দশক, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশভাগ, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ সব কভার হয়ে গ্যাছে? সব ডিটেকটিভ গল্প শেষ হয়ে গ্যাছে? আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে– এই ছবি কি লুকিয়ে দেখেবে লোকে? না। দেখলে প্রকাশ্যেই দেখবে। কারণ এখন স্বপনকুমার স্মৃতি হয়ে গ্যাছেন। আর এখন তাঁর উত্তেজক জগৎটা নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গ্যাছে। তার দাঁত-নখ ভোঁতা হয়ে গ্যাছে? তিনি আর ‘বিপদজনক’ নন। তাঁর বইগুলো বাড়ির ছেলেকে নষ্ট করতে পারবে না। বাঙালি জিতেছে। যা যা অস্বস্তিকর ছিল, তাকে সরিয়ে রেখে বাড়ির ছেলেকে গুপ্তধন খোঁজায় লাগিয়েছে। ঠিক যেমন একসময়ের পর্নগ্রাফি চরিত্রহীন এখন জলভাত। বাঙালির স্মৃতিতে শরৎবাবু মহান লেখক আমাদের কালচার। সেদিনের সন্ত্রাসবাদী আজকের বিপ্লবী ও আমাদের ইতিহাস।
আসলে স্মৃতি সতত রুচিশীল। স্মৃতিতে হিটলার চার্লি চ্যাপলিন। নস্টালজিয়া জিন্দাবাদ।
পুনশ্চ: আসলে স্বপনকুমার ‘সাহিত্য’ করেননি। তিনি সাহিতিক নন। তিনি একজন ড্রিমার। উনি স্বপ্ন লিখতেন। একটা ক্লান্ত, ম্লান, বিরক্তিকর শহরের মধ্যে বৃষ্টিভেজা এক রোমাঞ্চকর গাঢ় শহর। প্রগাঢ় হলে কাব্য হয়ে যেত। গাঢ় বলে গদ্য হয়েছে। তার রহস্য রোমাঞ্চ স্মৃতিতে কমেডি হয়ে গ্যাছে কারণ আমরা বিশ্বাস করতে, কল্পনা করতে ভুলে গেছি, তিনি এখন হাস্যকর বড়জোর। তাই তাকে ফিরিয়ে আনতে আর ভয় নেই। বাড়ির ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে না।