১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সাময়িকপত্রগুলিতে টোকাই আঁকছেন রনবী। যে চরিত্র ৮-৯ বছরের পথবালক বা শিশু। গোলমাথা, মাথায় কয়েকটি খোঁচা চুল, সামনে উঁচু দাঁত, খালি গা, পরনে চেক লুঙ্গি, ভোটের সময় বিলি করা জামা গায়ে দেয়, যা অনেক বড় সাইজের, কাঁধে বস্তা। কিংবদন্তি শিল্পীর কার্টুন চরিত্রের থাকার, বসার, শোয়ার জায়গা বা আশ্রয় ডাস্টবিনের গা ঘেঁষা, কখন খেলার মাঠ, পার্কের বেঞ্চি, অজগরের পেটের মতো বড় পাইপ বা নালা, শহিদ মিনারের সিঁড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ক’দিন আগের কথা। জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে দিল্লিতে হাজির হন বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতা। শোনা যায়, সেই সময় দেশের ‘সম্মান’ রাখতে শীর্ষ সম্মেলনের আগেভাগে রাজধানী থেকে পথশিশুদের অন্যত্র সরানোর উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। রাষ্ট্রসংঘের একটি পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বিশ্বের ১৬ শতাংশ শিশু শ্রমিকই ভারতের। একাধিক বেসরকারি সংস্থার দাবি, ভারতে পথশিশুর সংখ্যা কয়েক লক্ষ। সরকারি পরিসংখ্যান অনেক কম। কেন্দ্রের স্বরাজ পোর্টালের চলতি বছরের রিপোর্ট- এ দেশে পথশিশুর সংখ্যা ২০ হাজার। এর মধ্যে দিল্লির পথেঘাটে, খোলা আকাশের নিচে দিন কাটায় ১ হাজার ৮৫৩ শিশু। প্রশ্ন উঠবে, উৎসবের মরশুমে এমন মনখারাপ করা পরিসংখ্যান কেন?
হেতু– ১৪ নভেম্বর। শিশু দিবস। শিশুদের একটা অংশ আবার ‘টোকাই’। টোকাই কে-কী-কেন বিষয়টায় পড়ে আসা যাবে। আগে বলে নিই- শিশু দিবস নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলেও কাজে আসবে ওপরের পরিসংখ্যান। জরুরি। ‘তারে জমিন পর’-দের নিয়ে আবেগ প্রকাশের আগে তাদের সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো। যেমন, একশ্রেণির শিশু বেশি খাচ্ছে না, আরও খাচ্ছে না বলে বাপ-মা বিরাট চাপে। খাওয়ানোর ফন্দি খুঁজতে ডাক্তার, ডায়েটেশিয়ানের খোঁজ খোঁজ খোঁজ। আরেক দল, তারাও শিশু, খিদে মারতে ‘ড্যান্ডি’ টানছে। ড্যান্ডি কী? ভারতে পথশিশুদের একাংশ ডেনরাইটের নেশা করে, বাংলাদেশের ‘টোকাই’রা ‘ড্যান্ডি’ টানে। ‘ড্যান্ডি’ হল ডেনরাইটের নেশার বাংলাদেশি নাম। এইবারে টোকাইদের কথা বলতেই হয়।
টোকাইরা বাংলাদেশে থাকে। স্বাভাবিক। জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। ২০১৯ সালের মিডিয়া রিপোর্ট বলছে,বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি। এদের একটা বড় অংশই অনাথ। বাড়ি মানে খোলা আকাশ, রেল স্টেশন, বাস গুমটি, পার্ক, পরিত্যক্ত ছাউনি ইত্যাদি। ডাস্টবিনের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ভারি গভীর! প্রথমত, শহুরে ভদ্দরলোক ডাস্টবিনে যে উচ্ছিষ্ট ফেলেন, তাই এদের খাবার। দ্বিতীয়ত, ডাস্টবিন থেকে প্ল্যাস্টিকের বোতল, পলিথিন– এমন টুকিটাকি ফেলা দেওয়া জিনিস টুকিয়ে (পড়ুন কুড়িয়ে) বিক্রি করে সামান্য আয় করে। সেই টোকাই অন্তর্ঘাত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিত্রী এবং কার্টুনিস্ট রফিকুন নবীর হাতে।
হ্যাঁ। টোকাই এক অন্তর্ঘাত। সে আদতে তৃতীয় বিশ্বের অতি চেনা পথশিশু। অনাথ, হাড়-হাভাতে, ধরুন গে যার বাপ-মা-ভাই-বোন-বিয়াই-বোনাই-জগাই-মাধাই কেউ নেই। আছে বলতে অপুষ্টিতে ভোগা হাড় জিরজিরে শরীর। অথচ পেট ফোলা। তার ভিতর খিদে গিজগিজ করছে। সেই খিদে মেটাতে ভরসা নগর সভ্যতার আস্তাকুঁড় ডাস্টবিন, কখনও ড্যান্ডি। ভারত হোক বা বাংলাদেশ, সোমালিয়া কিংবা প্যালেস্টাইন, টোকাইদের সবাই দেখেছেন। ঝা-চকচকে শহরে ভদ্দরলোকদের চলমান দৃশ্যদূষণ হয়ে এরা ঘুরঘুর করে।
বিশেষত ঢাকা শহরের ভদ্দরলোকেরা পথশিশু টোকাইদের বাঁচা-মরার আশপাশ দিয়ে নিত্য যাতায়াত করেন। তবে কিনা ঝলমলে নগর সভ্যতায় পথশিশু বা ‘টোকাইরা’ যে এক অন্তর্ঘাত, সেকথা অনেকে বুঝলেও সরাসরি বলার মতো একটা সাহসী লোকের দরকার ছিল। সেই কঠিন কাজ করেছেন রফিকুন নবী ওরফে রনবী। কেমন সেই কার্টুন?
পুচকে টোকাইকে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা প্রশ্ন করেন, ‘তুই ভাত খাস না রুটি?’ টোকাইয়ের উত্তর– ‘যে যখন যেইটা ফেলায়…।’ একজন স্যুট-বুট, মুখে পাইপ টোকাইকে বলেন, ‘বুঝলি টাকা পয়সা হাতের ময়লা।’ কথা শুনে অবাক টোকাই, সে ডাস্টবিনের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ময়লা? তো কই… কেউ ডাস্টবিনে ফালায় না কেন?!!’
১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সাময়িকপত্রগুলিতে টোকাই আঁকছেন রনবী। যে চরিত্র ৮-৯ বছরের পথবালক বা শিশু। গোলমাথা, মাথায় কয়েকটি খোঁচা চুল, সামনে উঁচু দাঁত, খালি গা, পরনে চেক লুঙ্গি, ভোটের সময় বিলি করা জামা গায়ে দেয়, যা অনেক বড় সাইজের, কাঁধে বস্তা। কিংবদন্তি শিল্পীর কার্টুন চরিত্রের থাকার, বসার, শোয়ার জায়গা বা আশ্রয় ডাস্টবিনের গা ঘেঁষা, কখন খেলার মাঠ, পার্কের বেঞ্চি, অজগরের পেটের মতো বড় পাইপ বা নালা, শহিদ মিনারের সিঁড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বিজয় দিবস টোকাইয়ের কাছে ছুটির বাজার, রমজান মাস বোঝা যায় দোকানদারদের দেখে। টোকাই বলে, ‘ঈদ অইলো গিয়া কার কত পয়সা আছে তা দেহানের একটা মওকা।’ বুঝতে বাকি থাকে না টোকাইয়ের চোখ আসলে কিংবদন্তি শিল্পীর চোখ। সভ্যতাকে গভীর বেদনার এবং হাস্যকর করে তোলেন তিনি। যে সভ্যতা নিদেন এক শিশুর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে রনবীর কার্টুন আমাদের ভিতরে হাসি-কান্না-রাগ-দুঃখের খিচুড়ি পাকিয়ে দেয়। একটি কার্টুনে এক ভদ্দরলোক প্রশ্ন করেন, ‘সমাজ সম্পর্কে তোর ধারণা কী?’ টোকাই জানায়, ‘কুন সমাজ আপনাগো না আমাগো?’ এ এক কঠিন প্রশ্ন। যার জবাব দেওয়ার দায় রাষ্ট্রনেতাদের, আমার-আপনার মতো ভদ্দরলোকেদের। কেন ‘বিশ্ব শিশু দিবসের বক্তৃতা খেয়ে পেট ফুলে ওঠে’ টোকাইয়ের? এই জন্যই বুঝি জি-২০ সম্মেলনের আগেভাগে দিল্লি শহর থেকে সরাতে হয় পথশিশুদের!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved