এমনভাবে একটি অসম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে, যা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কল্পনাতেও ছিল না, ছিল না বিশ্ববাসীর চিন্তাতেও। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি পায় বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ’ নামে এক নতুন রাষ্ট্র। সেদিন ঢাকা শহরের হাজার হাজার জনতা রমনার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে, মুখে নিয়ে স্লোগান ‘জয় বাংলা’।
আজকের দিনের মতো এমনই এক শীতের বিকেলে, ৫৩ বছর আগে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের গঠিত মিত্রবাহিনী বা যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ও তার বাহিনী তাদের অস্ত্র রমনার মাটিতে রেখে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিকেল ৪টে ১ মিনিটে এই রমনার মাঠে; স্বাক্ষর হল ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ চুক্তি। যা আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম সত্যিকারের যুদ্ধ জয়। এমনভাবে একটি অসম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে, যা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কল্পনাতেও ছিল না, ছিল না বিশ্ববাসীর চিন্তাতেও। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি পায় বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ’ নামে এক নতুন রাষ্ট্র। সেদিন ঢাকা শহরের হাজার হাজার জনতা রমনার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে, মুখে নিয়ে স্লোগান ‘জয় বাংলা’।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। সেদিন ঢাকা কেমন ছিল, তা দেখে নিতে পারি জননী জাহানারা ইমামের লেখা বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’-র পাতা থেকে– ‘‘আজ সকাল ন’টা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেল তিনটে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাক আর্মি নাকি সারেন্ডার করবে বিকেলে। সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এল সবার মুখেই এক কথা। দলে দলে লোক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে। পাকসেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে। পালাতে পালাতে পথেঘাটে এলোপাতাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন। বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময় বেপরোয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লোক জখম করেছে।
মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।’
আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে আসতে। এ. কে. খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে।
জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল তিনটের সময়।’’
রমনা বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ও সভা-সমাবেশের সাক্ষী। রমনা আমাদের বিদ্রোহ, বিপ্লব, বিজয় ও স্বাধীনতার মাঠ। ’৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মাঠেই জনসম্মুখে মুক্তিকামী জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের হল। ’৫২ থেকে ’৭১– ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম বিজয়গাথা হল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়।
১৭ মার্চ, ১৯৭২। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে এলেন মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। রমনার মাঠের এক পাশে নৌকার আকারে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়। মঞ্চের নাম দেওয়া হয় ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। বিকেল তিনটেয় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী। এর আগে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে, দিল্লি বিমানবন্দরে। সেদিনও দু’জন একই মঞ্চে বক্তৃতা করেছিলেন।
১৭৬০ সালের দিকে ইংরেজি কুঠি আক্রমণের জন্য সন্ন্যাসীরা মিলিত হয় এই রমনার মাঠে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম বক্তৃতা দিলেন এই রমনার মাঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই রমনা এলাকাতেই ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর পাকিস্তানি আর্মি প্রথম আক্রমণ চালায়। রমনার কালীবাড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল এবং শিক্ষকের বাস ও কর্মচারীদের আবাসস্থলে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সেনা এই বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে নির্মম নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও গণহত্যা চালায়, যা চলে দীর্ঘ ৯ মাস জুড়ে।
এই রমনা এককালের রেসকোর্স ময়দান, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। শতবর্ষ আগে এই রমনা এলাকায় গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে ওঠে ঢাকার নবাবদের শাহবাগের বাগানবাড়ি। আর রমনার কালীবাড়ি যা এখনও টিকে আছে রমনার কালীমন্দির হিসেবে। ছয়ের দশকের এই রমনা ছিল কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা। ঢাকা শহরের আর এমন কোনও জায়গা নেই, যার উৎপত্তি থেকে এখনও পর্যন্ত এমন উন্মুক্ত এবং মুক্ত জায়গা হিসেবে টিকে আছে। চারশো বছরের পুরাতন এই শহর চারবার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী সমূহের মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে পুরনো। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতিকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন এবং ঢাকাকে করা হয় সুবা বাংলা বা বাংলা প্রদেশের রাজধানী। তখন ঢাকা নগরের নামকরণ হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর’।
১৬১০-এ মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতি প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করেছিলেন। এরপর আরও তিনবার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে ঢাকা।
১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক পুনর্গঠন করে ঢাকার প্রশাসক হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিয়োগ করে। ঢাকা পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৮৪-তে জারি হয় মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। নতুন প্রদেশের নামকরণ করা হয়েছিল ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’; ঢাকা ছিল প্রদেশের রাজধানী।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়েছিল বাংলাভাগ। ঢাকা আবার হারিয়েছিল রাজধানীর মর্যাদা। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ এবং রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে ঢাকা পায় এক অমূল্য জিনিস, যা আগে এই বাংলায় কখনও ছিল না। পায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। ব্রিটিশরা এই বঙ্গের মানুষকে খুশি রাখার জন্য ১৯২১ সালে স্থাপন করে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৪৭ সালে, ভারতীয় উপমহাদেশকে ইংরেজরা দু’’ভাগ করে স্বাধীনতা দিয়েছিল। জন্ম হয় দু’টি দেশের ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের ছিল দু’টি প্রদেশ– পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। সেই সময়ে ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী।
১৯৭১ সালেই ঢাকা প্রথমবারের মতো রাজধানী হল স্বাধীন একটি দেশের। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
’৭১-এর ডিসেম্বরর শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সম্মুখ যুদ্ধে পরাজয় শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সোমবার। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ভারত। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আরও বেগবান করে তোলে। ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ সময় শহরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসে সমবেত হয়। এরপর রাতের অন্ধকারে তাদের বেশিরভাগই সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১,৮০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। জামালপুরে ৬০০, লাকসানে ৪০০, বাকি ৮০০ নোয়াখালী, হিলি, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও চাঁদপুরে। ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার কাছাকাছি টাঙ্গাইল সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার প্রশাসন একদম ভেঙে পড়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠিক করে আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সমুদ্র পথ বাদে বাকি তিনদিক থেকে ঢাকার দিকে ভারতীয় সৈন্য এগোচ্ছে। বিমান আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। আর রয়েছে ঢাকা শহরের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা সদস্যদের আক্রমণ।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল নিয়ে লেখক আহমদ ছফা তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেন– ‘ইতিহাসে কোন কোন সময় আসে যখন এক একটা মিনিটের ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং ঘনত্ব হাজার বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জীবনে একাত্তর সাল সে রকম। একাত্তর সাল যারা দেখেছে, ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যারা বড় হয়েছে, একাত্তর সালের মর্মবাণী মোহন সুন্দর বজ্রনিনাদে যাদের বুকে বেজেছে, তারা ছাড়া অন্য কেউ একাত্তরের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। …চোখ বুজে একাত্তরের কথা চিন্তা করলে আমার কানে মহাসিন্ধুর কল্লোল ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। একাত্তর সাল পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সে একাত্তরের কথা বলার চিন্তা যখন করি, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা প্রবল আতঙ্কস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, একটা মহান পবিত্র ভীতি সর্বসত্তা গ্রাস করে ফেলে, আমার মনে হয় একাত্তর সম্পর্কে কোন কিছু আমি কস্মিনকালেও ভুলতে পারব না।’