১৯১৯ সাল। নিকোলাই পডিয়াপোলস্কি নামে একজন তরুণ কৃষিবিদ ভলগা নদীর ব-দ্বীপ থেকে উত্তরে ভ্রমণ করছিলেন। তিনি গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, নির্বিচার প্রাণীহত্যা, শিকার ও বৃক্ষ ছেদন অনেক প্রজাতিকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। মস্কোতে তিনি লেনিনের সঙ্গে দেখা করলেন। একটি নতুন এলাকা সংরক্ষণের অনুরোধ নিয়ে তিনি বলশেভিক নেতার অফিসে পৌঁছলেন। পডিয়াপোলস্কি চিন্তিত ছিলেন, আদৌ কি লেনিন তার কথার গুরুত্ব দেবেন?
সে ১৯৯০-’৯১ সালের কথা। প্রায় প্রত্যেকদিন খবরের কাগজে ‘বিশ্ব সংবাদ’ পাতায় ছবি ছাপা হত লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে, পূর্ব ইউরোপ এবং ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে। ইউক্রেনের কিয়েভে বিশাল লেনিন-মূর্তি মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে উন্মত্ত জনতা– এ ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার সংবাদমাধ্যমে। অবশ্য পৃথিবীর এ-প্রান্তে প্রাচীর-গাত্রে তখনও লেখা দেখতাম ‘মহামতি লেনিন’, সঙ্গে তাঁর ওভারকোট পরা স্টেন্সিলে বা লাল-কালো রঙে আঁকা ছবি। কেন তিনি ‘মহামতি’, কেন তিনি সবসময় ওভারকোট পরে থাকেন, তা বুঝতাম না। অনেক বেশি আকর্ষণ করত বরং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গলায় ‘রুশদেশের কমরেড লেনিন’ গানটা। সেই সূত্রেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হল আমেরিকান কবি ল্যাংস্টন হিউজেস-এর কবিতার কাছে। কৃষ্ণাঙ্গ কবি এই শোকগাথা লিখেছিলেন লেনিনের মৃত্যুকে স্মরণ করে। ‘I am Chico, the Negro,/ Cutting cane in the sun./ I lived for you, Comrade Lenin./ Now my work is done.’ বিষ্ণু দে-র অনুবাদে, ‘আমি চিকো কালো কাফ্রি/ রোদে আখ কাটি মুঠি মুঠি/ বেঁচেছি তোমারি তরে কমরেড/ আজকে আমার হলো ছুটি’।
এই কবিতা আর গান আমাকে জানাল লেনিন রাশিয়ায় আটকে নেই, জগদ্দল মূর্তিতেও না, তিনি আসলে চাষি আইভান, কৃষ্ণাঙ্গ চিকো, শ্রমিক চ্যাং-এর মুক্তির সংগ্রামের প্রেরণাদাতা। মৃত্যুর একশো বছরেও তিনি পৃথিবীর কত মানুষের চিন্তায় ও মননে ভাস্বর। লেনিনের মূর্তি থাকল কি থাকল না, তাতে কিছু যায় আসে না। বিগত কয়েক বছর আগে এদেশের ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার একটা ছোটখাটো উৎসব হয়েছিল। যারা লেনিন মূর্তি ভেঙেছিল, তাদের প্রতি করুণা হয় আজকাল। কারণ লেনিনকে তার জায়গা থেকে অপসারণ করা কিছু উন্মত্ত দক্ষিণপন্থীর পক্ষে সম্ভব নয়। ফরাসি দার্শনিক আঁলা বাদু-র একটি সাম্প্রতিক ভাষ্যের অনুসরণে বলা যায়, ‘হঠাৎ, হ্যাঁ, লেনিনকে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানোর চেষ্টাটা বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু তবুও একটি পাল্টা বয়ানও বর্তমান বুদ্ধিজীবী এবং আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে থেকে উঠে আসে, যা তথ্যের ভিত্তিতে দেখায় লেনিন নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে পাঁচ বা ছয়জন সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং বিপ্লবীদের একজন ছিলেন।’
…………………………………………………………………………………………………………………………………
তাঁর সোভিয়েত তাঁকে অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা লেনিনের ‘আপসহীন’ পরিবেশ-ভাবনার মূল্য অনুধাবন করতে পারছি। তিনি ‘মহামতি’ কি না জানি না, জেনে লাভও তেমন নেই, কিন্তু এটা দেখতে পাচ্ছি আরও অনেক কিছুর মতোই প্রকৃতি সংরক্ষণে তাঁর দূরদৃষ্টি আজকের দিনে সকলেই মেনে নিয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
এটা ঠিক যে, তাঁর হাতে গড়া সোভিয়েত ইউনিয়নেও তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে বারবার অবজ্ঞা করা হয়েছে। অন্যতম হল লেনিনের পরিবেশ ভাবনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ নীতি। ১৯১৯ সাল। নিকোলাই পডিয়াপোলস্কি নামে একজন তরুণ কৃষিবিদ ভলগা নদীর ব-দ্বীপ থেকে উত্তরে ভ্রমণ করছিলেন। তিনি গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, নির্বিচার প্রাণীহত্যা, শিকার ও বৃক্ষছেদন অনেক প্রজাতিকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। মস্কোতে তিনি লেনিনের সঙ্গে দেখা করলেন। একটি নতুন এলাকা সংরক্ষণের অনুরোধ নিয়ে তিনি বলশেভিক নেতার অফিসে পৌঁছলেন। পডিয়াপোলস্কি চিন্তিত ছিলেন, আদৌ কি লেনিন তার কথার গুরুত্ব দেবেন? কিন্তু লেনিন একমত হলেন যে প্রকৃতিকে রক্ষা করা ভীষণ জরুরি। আইন করে প্রায় তিরিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বন ও প্রকৃতি সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করা হল লেনিনের উদ্যোগে। কিন্তু স্তালিনের সময়ে তার মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটার কেবল সংরক্ষণের আওতায় রেখে বাকিটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল! স্তালিনের মৃত্যুর পর লাগাতার প্রতিবাদে নিকিতা ক্রুশ্চেভের সময় সংরক্ষিত এলাকা কিছুটা বাড়িয়ে পনেরো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার করা হল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বিষাদ এবং বিরোধিতা কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পারব এই উদ্দেশ্যেই মান্টো নিয়ে কাজ শুরু
……………………………………………………………………………………………………………………………………
তাঁর সোভিয়েত তাঁকে অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা লেনিনের ‘আপসহীন’ পরিবেশ-ভাবনার মূল্য অনুধাবন করতে পারছি। তিনি ‘মহামতি’ কি না জানি না, জেনে লাভও তেমন নেই, কিন্তু এটা দেখতে পাচ্ছি আরও অনেক কিছুর মতোই প্রকৃতি সংরক্ষণে তাঁর দূরদৃষ্টি আজকের দিনে সকলেই মেনে নিয়েছে। তিনি আর কেবল ‘রুশদেশের লেনিন’ নেই, তিনি বিশ্বজনীন। ‘লেনিনের জন্য গাথা’ কবিতায় পাবলো নেরুদা যেন সে-কথাই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘Lenin, to sing to you/ I must say farewell to words:/ I must write with trees, with wheels,/ with plows, with cereals./ You’re concrete/ as facts and earth./ There never was/ a more earthly man/ than V. Ulyanov.’
ব্রের্টোল্ড ব্রেখট লেনিনকে স্মরণ করে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন, পরে সেগুলি গুচ্ছ কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে একটি কবিতার নাম ছিল, ‘লেনিনের প্রতি কুয়ান বুলাকের কার্পেট-বয়নকারিদের শ্রদ্ধার্ঘ’। কুয়ান-বুলাক দক্ষিণ তুর্কিস্তানের ফারঘনার একটি ছোট রেলওয়ে স্টেশন। সেই স্টেশনে একটি প্রস্তর ফলকে লেখা ছিল ঘটনাটি– ‘এই স্থানে লেনিনের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কথা ছিল, কিন্তু স্মৃতিসৌধের পরিবর্তে সেই অর্থে পেট্রোলিয়াম এনে জলাভূমির ওপর ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে কুয়ান-বুলাক, লেনিনের স্মরণে এবং তাঁর নামে ম্যালেরিয়াকে দমন করেছিলেন।’ কবিতায় ব্রেখট ঘটনাটির বর্ণনা করেছেন, ‘লেনিন সর্বত্র সম্মানিত/ চারিদিকে তার আবক্ষ মূর্তি/ শত শহর আর শিশুদের নাম তার নামে/ তাকে নিয়ে কথকতা ও বক্তৃতা/ মিছিলে প্রতিবাদে সাংহাই থেকে শিকাগো/ তার কথা আর নাম আগে/ কিন্তু কুয়ান-বুলাকের কার্পেট-বয়নকারিরা/ তুর্কিস্তানের ছোট্ট গ্রামে/ তাকে সম্মানিত করল অন্য এক রঙে।’ এখানে গদ্যে বলি বাকি কাহিনিটা।
লেনিনের মৃত্যুর পর ওই গ্রামের মানুষগুলো ঠিক করল, তাঁর সম্মানে তারা তাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে একটা আবক্ষ-মূর্তি নির্মাণ করবেন। ‘That for the Comrade Lenin also in their village/ A gypsum bust would be installed.’ এক সন্ধ্যায় কুড়িজন গ্রামবাসী জমা হল। ম্যালেরিয়া জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে তারা সামর্থ্য অনুসারে কয়েক টাকা করে চাঁদা তুলতে শুরু করল। স্টেশনের পাশেই ছিল একটা পচা জলাভুমি। মশা আর ম্যালেরিয়ার আঁতুড়ঘর। যাই হোক, কষ্টার্জিত অর্থ তারা ব্যয় করবে প্রিয় নেতার স্মৃতিতে। সেখানে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল লাল ফৌজের এক সাধারণ কর্মী স্তেপা জামাল। অর্থ সংগ্রহ শেষে সে একটা প্রস্তাব করে বসল, বললে, ‘এস, এই টাকায় আমরা পেট্রোলিয়াম কিনি, আর তা ছড়িয়ে দিই জলাভূমির ওপর, যাতে মশার বংশ নাশ হয়, আমাদের গ্রাম ম্যালেরিয়া-মুক্ত হয়।’ ‘Thus to combat the fever in Kuyan-Bulak, and indeed/ To honour the late, but/ Not to be forgotten/ Comrade Lenin’, তারা তাই করল। বালতি বালতি পেট্রোলিয়াম কিনে এনে তারা জলাভূমির ওপর ছড়িয়ে দিল। গ্রাম ম্যালেরিয়া-মুক্ত হল। আর এই ঘটনাটা তারা একটা ফলকে লিখে রাখল কুয়ান-বুলাক স্টেশনে। এইভাবে তারা লেনিনকে সম্মান জানাল। পাবলো নেরুদার কথাগুলো, ‘দেয়ার নেভার ওয়াজ এ মোর আর্থলি ম্যান দ্যান ভি উলিয়ানভ’, কতটা সার্থক তা ব্রেখটের কবিতায় উল্লিখিত গল্পটা থেকে বোঝা যায়।
আর এইখানে ঋত্বিক ঘটকও বোধহয় গলা মেলান নেরুদা আর ব্রেখটের সঙ্গে। মনে করুন তাঁর ছবি ‘আমার লেনিন’-এর একেবারে শেষ অংশটা, গ্রাম বাংলার কৃষকের মিছিল, সঙ্গে উচ্চারিত হয়, ‘ওরা তো একা নয়, ওরা কখনও একা নয়। পৃথিবীর সব কোণা থেকে ওরা চেঁচিয়ে ওঠে আমার, আমার লেনিন।’ কবি বীরেন্দ্র চট্টপাধ্যায় এই আবেগকে প্রকাশ করেছেন, ‘যে-দেশে শিশু জন্ম নিলে/ জননীর মুখের হাসি মানিক হয়ে ঝরে/ …সে-দেশের একটি মানুষ অনেকদিন কবরের নিচে শুয়ে আছেন/ কিন্তু তিনি কখনো ঘুমান না, পাহারা দেন।’